গোলাপ ফুল বা গোলাপের গাছ চেনে না এমন মানুষ কি দুনিয়ায় আছে! কে জানে! যদি থাকে তবে সংখ্যাটা খুব কম হবারই সম্ভাবনা। গোলাপ পৃথিবীর সবথেকে পরিচিত ফুলগুলোর একটি এবং সবচেয়ে সমাদৃত ফুলগুলোরও। এটা যেমন গোলাপের রুপের কারণে তেমনি এর সুগন্ধ ও গুণের কারণেও।
পুরো পৃথিবীতে এ পর্যন্ত একশরও বেশি শ্রেণীর গোলাপ এবং এর হাজারো প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে আবার বর্ণ , গঠন ও আকারের ভিন্নতা রয়েছে। ভিন্নতা রয়েছে এর সৌন্দর্য ও মহোনীয়তায়। গোলাপ নিয়ে রয়েছে কত জানা-না জানা কথা।
আমরা সব সময় আমাদের অজানা বিষয় নিয়ে জানতে চাই। কিন্তু, আমাদের আশেপাশেই গোলাপের মত কত জানা বিষয় এর কত অজানা কথা যে থাকে, এগুলোও যে কত ইন্টারেস্টিং তা কি আমরা জানি? নিচে গোলাপ নিয়ে এমনই কিছু মজার তথ্য তুলে ধরা হলো –
• আমরা অনেকেই কালো গোলাপ এর কথা শুনেছি, আবার কেউ কেউ দেখেছিও। মজার ব্যাপার হলো গোলাপ কখনও কালো হয় না। কালো গোলাপ বলে যে গোলাপের কথা আমরা শুনি সেটি তুরস্কের অত্যন্ত বিরল প্রজাতির ”হাফেটি রোজ” (Halfeti Rose), যেটা খালি চোখে দেখতে কুচকুচে কালো মনে হলেও আসলে কালচে গাঢ় লাল রঙের।
• নীল যে শুধু অপরাজিতা হয় না, গোলাপ ও যে নীল হতে পারে এই ব্যাপারটা ক’জন জানি আমরা! প্রজননবিদরা বহু বছর আগে থেকেই বিভিন্ন প্রজাতির মিশ্রণ ঘটিয়ে নতুন নতুন রং ও আকৃতির গোলাপ তৈরি করেছেন। কিন্তু, গোলাপের পাপড়িতে এ্যানজাইমের অভাবে নীল রঙের গোলাপ তৈরিতে তারা বার বার ই ব্যর্থ হয়েছে। অবশেষে, জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিং এর উৎকর্ষের ফলে ২০০৭ সালে তারা প্রথম নীল গোলাপ ফলাতে সফল হয়েছে।
• একটা গোলাপের দাম কত হতে পারে? ১০ টাকা, ২০ টাকা , ৫০ টাকা? কিন্তু, এখন যে গোলাপ এর কথা বলব তার দাম কত জানেন?কল্পনা করুন তো।
গোলাপ প্রজননের জন্য বিখ্যাত, ডেভিড অস্টিন (Devid Austin), ২০০৬ সালে জুলিয়েট(Juliet Rose) নামে এ পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে দামী গোলাপটি চাষ করেন। এটি আবিষ্কার করতে তার ১৫ বছর সময় লেগেছিল এবং ব্যয় হয়েছিল ৫ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৪০ কোটি টাকা।
• আমাদের দেশে আমরা যারা ছোট ছোট গোলাপের গাছ দেখে অভ্যস্ত তাদের জন্য কল্পনা করাও কষ্টকর, “একটা গোলাপ গাছ , তার উচ্চতা ২৩ ফুট”। হ্যাঁ, সত্যি। সবচেয়ে লম্বা গোলাপ গাছের রেকর্ড এ পর্যন্ত ২৩ ফুট।
• ”লেডি ব্যাংকশিয়া” (Lady Banksia)নামে একটি গোলাপের ঝাড় আছে যেটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিস্মৃত গোলাপের ঝাড়। এটি ৮৫০০ স্কয়ার ফিট এলাকা নিয়ে বিস্মৃত। শুধুমাত্র এ গাছের গুড়ির পরিধি ই ১২ ফিটেরও বেশি এবং এ গাছে ২০০,০০০ এরও বেশি গোলাপ ফোটে।
• অনেক প্রাচীন যুগ থেকেই পৃথিবীতে গোলাপের অস্তিত্ব ছিল। গোলাপের এমন একটি জীবাশ্মের সন্ধান মিলেছে যেটি ৩৫ মিলিয়ন বছর পূর্বের বলে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছেন।
• গোলাপের অনেক প্রজাতি হাজার বছরেরও বেশি সময় বেঁচে থাকে। জার্মানির হিলশ্যাইম (Hillesheim) গীর্জার দেয়ালে থাকা গোলাপের ঝাড়টি ১০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে আছে।
• ব্যাক্তিমালিকানাধীন গোলাপের সবচেয়ে বড় বাগানটি রয়েছে ইতালির ক্যাভরিগলিয়ায় (Cavriglia)যে বাগানে ৭৫০০০ এর ও বেশি প্রজাতির গোলাপ ফোটে।
• সব গোলাপের ই পাঁচটি পাপড়ি থাকে। শুধুমাত্র “রোজা সেরিসিয়া” নামক একটি প্রজাতির গোলাপে চারটি পাপড়ি থাকে। এ প্রজাতির গোলাপের প্রথম সন্ধান মেলে হিমালয়ের পাশ্ববর্তী এলাকায় ।
• গোলাপ পৃথিবীর অনেক দেশে আয় ও জীবিকার প্রধান উৎস। জাম্বিয়ার মোট আবাদী জমির শতকরা ৮০ ভাগেই গোলাপের চাষ হয়। সে দেশের রপ্তানিকৃত ফুলের ৯৫ ভাগ ই গোলাপ। ইকুয়েডর এর ৫৪ ভাগ জমিতে গোলাপের চাষ হয়। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে গোলাপের ব্যবসা খুবই রমরমা । সেসব দেশে গোলাপ লাখ লাখ মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। ফ্রান্স, আমেরিকা, ইউরোপ এর মত উন্নত দেশে গোলাপের চাহিদা ব্যাপক।
• গোলাপ ফুলের গোড়ালি, যেটিকে গোলাপের বোটা বলে সেটি ভিটামিন সি এর উৎকৃষ্ট উৎস। গোলাপের বোটাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভিটামিন এ ও ভিটামিন বি এর ও সন্ধান মেলে।
• গোলাপ সালাদ, বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবার, ও কেক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। জ্যাম, জেলী ও বিভিন্ন রকম আচার তৈরিতেও গোলাপের পাপড়ি ব্যবহার করা হয়। আইসক্রিম তৈরিতে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হয় গোলাপের নির্যাস। গোলাপ জল ও অনেক খাবারে সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
• সুগন্ধি তৈরিতে গোলাপের তেল যুগ যুগ ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সামান্য পরিমাণ গোলাপের তেল তৈরি করতেও প্রচুর পরিমাণ গোলাপের প্রয়োজন হয়। মাত্র ১ গ্রাম তেল তৈরিতে প্রয়োজন হয় দুই সহস্রাধিক গোলাপ।
• শুধু পৃথিবী ই নয় , মহাশূন্য্ও জয় করেছে গোলাপ। ২০০২ সালে “ওভারনাইট সেনসেশন” নামক একটি ক্ষুদ্রাকৃতির গোলাপ মহাশূন্যে নিয়ে যাওয়া হয় শূন্য ম্যাধ্যাকর্ষণে গোলাপের সুবাসের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করার জন্য।
• রং ও সংখ্যাভেদে গোলাপ ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে।
যেমন,
লাল গোলাপ ভালবাসার প্রতীক আবার হলুদ গোলাপ বন্ধুত্বের বার্তাবাহক। কমলা রঙের গোলাপ উদ্দীপনা বা আগ্রহ প্রকাশ করে, গোলাপের সাদা রং পবিত্রতা বুঝায় , গোলাপি রং বুঝায় আনন্দ ।বেগুনি রঙের গোলাপ অনন্ত বা অসীম ভালবাসার প্রতীক, কাল রং এর গোলাপ মৃত্যু বা শোকের বার্তাবাহক, নীল রং এর গোলাপ রহস্য বোঝায় এবং সবুজ রং এর গোলাপ বোঝায় প্রশান্তি ও স্নিগ্ধতা।
আবার, এক লাল গোলাপেরই সংখ্যাভেদে কত রকমের অর্থ! বিভিন্ন সংখ্যক লাল গোলাপ দিয়ে নিজের মনের অনুভূতি প্রিয়জনদের সামনে উপস্থাপন করা যায়। যেমন-
একটি লাল গোলাপ মানে, “আমি তোমাকে ভালবাসি”।
একটি লাল গোলাপের কুঁড়ির অর্থ, “তুমি আমার প্রথম প্রেম”।
৬টি লাল গোলাপ- “আমি তোমাকে স্নেহ করি”।
১৫টি লাল গোলাপ অর্থ, “আমি দুঃখিত”।
২৫টি লাল গোলাপ মানে, “অভিনন্দন”।
৫০টি লাল গোলাপ মানে, “আমি তোমাকে ভালবাসি, কোন কিছুর পরোয়া করি না”।
১০০টি লাল গোলাপ অর্থ, “আমি তোমার জন্য পাগল”।
১০৮টি লাল গোলাপ এর অর্থ, “তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?”
ফরাসি শব্দ ”গোলাপ”(Rose) যার উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ”রোজা” (Rosa) থেকে। ল্যাটিন ভাষায় কাউকে আদর করে ডাকা হত ’রোজা’ যার অর্থ ’ভালবাসা’। তাই গোলাপ নামটার মধ্যেই একটা রোমান্টিক ব্যাপার-স্যাপার ঢুকে গেছে । গোলাপ নিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে কত-শত সাহিত্য। গোলাপকে নিয়ে পৃথিবীতে শুধু গানই নাকি রচিত হয়েছে ৪০০০ এর ও বেশি। মিশরের রাণী জগদিখ্যাত ক্লিওপেট্রা নাকি অ্যান্টনিওর আগমণ বার্তা শুনে তার পুরো প্রাসাদের মেঝেতে গোলাপের পাপড়ি বিছিয়ে রেখেছিলেন। সেই থেকে মিশরে গোলাপ রোমান্টিকতার রুপকে পরিণত হয়েছে। শুধু মিশরীয়দের কাছেই না রোমানদের কাছেও গোলাপ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নিজেদের গৃহসজ্জায় তারা্ও গোলাপের পাপড়ি ব্যবহার করে। গোলাপকে অঙ্গসজ্জার উপকরণ হিসেবেও তারা ব্যবহার করে।
গোলাপ তাই শুধুমাত্র একটি মামুলি ফুল নয়, মানুষের জীবনে সৌন্দর্য আর রোমান্টিকতার প্রতীক হিসেবেও এটি আলো ছড়ায়।
লেখকঃ ইতি মল্লিক