রক্তেভেজা বগিগুলো ধোয়ার নির্দেশ দিয়ে শেষ হয় “অপারেশন খরচাখাতা”

0
রক্তেভেজা বগিগুলো ধোয়ার নির্দেশ দিয়ে শেষ হয় “অপারেশন খরচাখাতা”

হাসান হাফিজুর রহমান

মন ভালো নেই রজনী সিংহানিয়ার, চরম আতঙ্কে দিন কাটছে তার, নীলফামারি জেলার ছোট্ট একটা শহর সৈয়দপুর গত কয়েক মাস এক আতঙ্ক নগর। বলা যায় না কখন কাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে, জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দেবারও সাহস হচ্ছে না। যদি কোন উর্দুভাষীর কুনজরে পড়ে যায়। প্রিয় শহর সৈয়দপুরে অনেক শান্তিতেই ছিলো ওরা। ১৮৭০ সালে ব্রিটিশ রাজের রেলওয়ের ওয়ার্কশপ, পরে পাটকলসহ নানান কলকারখানা গড়ে উঠায় এলাকাটি বাণিজ্যিক নগর হয়ে উঠে। মূলত ব্যবসা, সমাজসেবায় প্রাধান্য ছিলো সিংহানিয়া, কেডিয়া, আগরওয়ালা পরিবারের হাতে। এই পরিবারের হাতে গড়া “তুলশিরাম বালিকা বিদ্যালয়” এর প্রতিষ্ঠাতা সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী ও শীর্ষ ব্যক্তিত্ব তুলশীরাম আগরওয়ালা, নবনির্বাচিত এমপিএ ডাঃ জিকরুল হকসহ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা রেলের কয়েকজন অফিসারের সাথে ব্যবসায়ী যমুনা প্রসাদ কেডিয়াদের আর্মি উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তাদের খোঁজ নেই, শোনা যাচ্ছে উনাদের ক্যান্টনমেন্টে কোয়ার্টার গার্ডে কদিন আটকে রেখে, গত ১২ এপ্রিল মধ্যরাতে রংপুর নিসবেতগঞ্চ নিয়ে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়েছে। শহরটা নেতা শূন্য হয়ে গেলো। টুঁ শব্দ করার মতো কেউ রইলো না। কে কখন আর্মি স্পাইদের নজরে পড়ে যায় বলা যায় না।

তার মতোই আতঙ্কে নববধূ কাঞ্চন দেবী সিংহানিয়া, মাত্র দুমাস হলো গৌরী শংকর সিংহানিয়ার ঘরে লক্ষ্মী হয়ে এসেছে। বগুড়া দুপচাঁচিয়ার তালোড়া থেকে শান্তির শহর সৈয়দপুরে স্বামীর ঘরে এসেও শান্তিতে নেই। কখন না জানি দলবেঁধে বিহারিরা এসে সব লুটে নেয়। প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। ক’দিন আগেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে আর্মির হাতে ধরা পড়েন সাতনালার চেয়ারম্যান মাহতাব বেগ (সৈয়দপুরে প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রথম শহীদ, তৎকালীন দিনাজপুর জেলার চিরির বন্দর থানার সাতনলা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, বর্তমান আলোকদিহি ইউপি) পরে বিহারীরা তার মাথা কেটে নিয়ে শহরময় আনন্দ উল্লাস করেছে। কার কাছে নিরাপত্তা চাইবে এ শহরে? নিরাপত্তা দেবার লোকেরাই এখানে নিরাপত্তাহীনতার কারণ…

একই আতংকে শ্যামলাল আগরওয়ালা, আরো ১৮৫ জন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীর মতো তাকেও ডেকে এনে আটকে রাখা হয়েছে ক্যান্টনমেন্টে। তাদের’কে দিয়ে সারাদিন এয়ারপোর্টের রানওয়ের জন্য মাটি কাটানো হচ্ছে। এমন গতর খাটানো কাজ জীবনেও করতে হয়নি তার। পাশেই চকচকে রাইফেল হাতে পায়চারি করছে খানসেনা। একটু পর পর একেক জনের ডাক পড়ছে মেজর গুল সাহাবের টেবিলের সামনে। তিনি শুনে নিচ্ছেন কার কোন ব্যাংকে ডিপোজিট কতো, বাড়িতে কত ভরি সোনা আছে? লুকানো কোথায়? সব শুনে তাকে জিপে তুলে ছুটছেন ব্যংকে, বাড়িতে। ব্যাংক একাউন্ট আর সিন্দুক শূন্য করে টিনের ট্রাংক ভর্তি টাকা আর গহনা নিয়ে বিজয়ের ভঙ্গিতে ফিরছে ক্যান্টনমেন্টে! এরপর ডাক পড়ছে আরেকজনের…
রাতে কোয়ার্টার গার্ডের ছোট্ট কুঠুরিতে ঘুম আসে না ওদের, কখন না জানি আবার মাঝ রাতে দরজায় টোকা পড়ে, “ফরেন বাহার আও, নিসবেতগঞ্চ যানা হ্যায়”
১লা জুন থেকে এভাবেই চলছে ওদের আশা নিরাশার জীবন…
মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়ানো মানুষগুলোর মনে হঠাৎ আশার আলো ছড়ালো একটি মাইকিং। শহরজুড়ে খান সেনা ও তাদের সহযোগী বিহারিরা জুনের ১০ ১১ ও ১২ তারিখে মাইকিং করলো, যে সমস্ত হিন্দু মাড়োয়াড়ি ভারতে যেতে চান, তাদের জন্য জলপাইগুড়ি অব্দি যাবার স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রেনটি ১৩’ই জুন ১৯৭১ সকাল ৭ টায় সৈয়দপুর থেকে চিলাহাটি হলদিবাড়ি সীমান্তের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে…

নিভন্ত প্রদীপে আশার আলো দেখা দিলো, হিন্দু ও মাড়োয়াড়ী পরিবারগুলোতে আশার সঞ্চার হলো। লুটপাট হয়ে যাবার পর, ঘরে সামান্য যা কিছু অবশিষ্ট ছিলো, তা গোছানো শুরু হলো। এবার হয়তো নিরাপদ অঞ্চলে ঠাঁই হবে। এখন ঘরে ঘরে শুধু ১৩ তারিখের অপেক্ষা…
এপ্রিলের ১২ তারিখ মধ্য রাতে এয়ারপোর্টের মাটি ভরাটের কাজ থেকে অব্যাহতি মিললো ওদের। মেজর গুল বলে দিলেন, যত দ্রুত সম্ভব নিজ নিজ পরিবার নিয়ে সৈয়দপুর রেল স্টেশনে হাজির হতে, দেরী করলে ডাব্বায় (বগি) জায়গা মিলবে না। রুদ্ধ শ্বসে শ্যামলালসহ অন্য ১৮৫ জনও নিজ নিজ বাড়ির দিকে ছুটলো। ১৩ ই জুন ভোরের আলো ঠিকমতো ফোঁটার আগেই গণেশ চরণ আর তুলসীতলায় শেষ বারের মতো প্রণাম করে স্টেশনের দিকে পা বাড়ালো কাঞ্চন ও রজনী দেবী। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে ওরা স্টেশনে পৌঁছলো, কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের মতো হিন্দু মাড়োয়াড়ী পরিবারের প্রায় ৪৬৮ জন সদস্যও প্লাটফর্মে হাজির হলেন।

তাদের সাথে যোগ দিলেন আরও একজন, তিনি রংপুর শহরের মুলাটোল এলাকার চিন্তাহরণ দাস, একসময় বেত পট্টি রোডে আরকে বণিকের Caltex কোম্পানিতে চাকরি করতেন তিনি। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় সামরিক সরকার কোম্পানিটি নিয়ে নিলে তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। সেখান থেকে সৈয়দপুর এসে যমুনা প্রসাদ কেডিয়ার “খেলারাম জগন্নাথ’’ নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ক্যাসিয়ার পদে যোগ দেন। সেই থেকে আজও কেডিয়া পরিবারের সঙ্গী। পুত্র বীরু, হারু, কন্যা লক্ষ্মী ও পুতুল (পূর্ণনাম বীরেশ্বর দাস বীরু, কালিনাথ দাস হারু, লক্ষ্মীরানি পাল ও পুতুল সেনগুপ্ত) আর স্ত্রী রংপুরে থাকতো, ওরা ইতিমধ্যেই ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এখন তাকেও যেতে হবে, এখানে থাকার মতো পরিবেশ নেই। চেনামুখগুলো অচেনা হয়ে গেছে, যারা কয়্যি ছোটামোটা নকরি কি ধান্দায় গদিঘরের সামনে দিনভর ধর্না দিতো, এখন তারাই শহরের হর্তাকর্তা, কর্নেল সাহেব, মেজর সাহেব’দের সাথে ওঠাবসা। কাকে ধরবে, কার বাড়ি সার্চ করবে ওরাই ঠিক করছে। আজ ওরাও খানসেনা’দের সাথে স্টেশনে ঘোরাঘুরি করছে। প্রাণের আশা জাগানিয়া ট্রেনের অপেক্ষায় প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে চিন্তাহরণের চিন্তা শেষ পর্যন্ত পরিবারের কাছে পৌঁছাতে পারবে তো?

সকাল ৮টা নাগাদ ৪টা ডাব্বা (কম্পার্টমেন্ট) নিয়ে ট্রেন প্লাটফর্মে ভিড়লে, সকলের হৃদকম্পন বাড়তে শুরু করলো। মেজর সাব কা হুকুম সবাই এক ডাব্বায় উঠা যাবে না। প্রথম দুই বগিতে পুরুষদের, পরের দুটিতে নারী শিশুদের তুলে দিয়ে জানালা বন্ধ করতে বলা হলো। এর মাঝে আলাদা করা নারীদের মাঝ থেকে ২০/২২ জন তরুণীকে আর্মি গাড়িতে করে ক্যান্টনমেন্টে পাঠিয়ে দেয়া হলো। জীবনের মায়া প্লাটফর্ম দাঁড়ানো খানসেনার সামনে ওদের নীরব করে রাখলো।

সকাল ১০টা, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মাঝে প্রিয় শহর পিছনে ফেলে স্পেশাল ট্রেন যাত্রা শুরু করলো। জানালার ফাঁক দিয়ে প্রিয় জন্মভূমি দেখে নিলো অনেকেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই রেলওয়ে ওয়ার্কশপও পার হলো, চোখে স্বস্তির রেখা ফোটার আগেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে কালভার্ট-337 মাঝে রেখে ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়েছে (দুটি করে বগি দুইপাশে, মাঝে কার্লভার্ট) জানালা খুলে যা দেখা গেলো, তা কারো কল্পনাতেও ছিলো না…
রেললাইনের দুপাশে ভারি অস্ত্র হাতে খানসেনা আর বড় বড় ছোরা আর ড্যাগার হাতে বিহারিরা ট্রেনকে ঘিরে রেখেছে…
কেউ নামার আগেই বিহারিরাই ট্রেনে উঠে এলো, ট্রেন থেকে সবাইকে নামতে বললো। কেউ একজন কারণ জানতে চাইলে এলোপাথাড়ি কোপানো শুরু করলো। “তুম ইস মুলুক কা বাগী হো, তুমকো আয়সেহি মারা যায়েগা” বলেই একজন বৃদ্ধকে টেনেহিঁচড়ে নামিয়ে নিলো ওরা। কালভার্টের পাকার উপর দাঁড় করিয়ে এক কোপে ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিলো, মাথাটা খালের মধ্যে গিয়ে পড়লো, পরে ধাক্কা দিয়ে দেহটা নয়নজুলীতে ফেলে দিলো। নিমিষেই পুরো ট্রেনে মরণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো।

ট্রেন থেকে একের পর এক যাত্রী নামিয়ে জবাই করতে থাকলো। কান্নাকাটি করা শিশুদের মায়ের কোল থেকে কেড়ে রেলের পাতে অথবা কালভার্টের পাকা শানে জোরে আছাড় দিয়ে মারলো। এ দৃশ্য দেখে এক মা তার দুধের শিশুকে বুকে আঁকড়ে ধরলে মায়ের কোলেই কোপ দিয়ে শিশুটাকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেললো। মৃতদেহগুলো ট্রেন থেকে নামিয়ে সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে টেনেহিঁচড়ে খাল পর্যন্ত নেয়ায় দুপুর নাগাদ বগিগুলোর মেঝে আর রেললাইনের পাশের সবুজ ঘাস মানুষের রক্তে লাল হয়ে গেলো…
মৃত্যুর বিভীষিকা দেখে জীবিতরা করজোরে মিনতি করলো, এত কষ্ট দিয়ে না মেরে তাদেরকে গুলি করে মারা হোক। জবাব এলো, “তুম লোগো কো মারনে কি লিয়ে সারকার কা কিমতি গোলি কিউ খার্চ কারু?
“সরকারের মূল্যবান গুলি বাঁচিয়ে পাকি প্রেমিকেরা কসাইয়ের মতো জবাই করে,খুঁচিয়ে বা আছাড় দিয়ে হত্যা করে লাশগুলো নয়নজলী খালে ছুড়ে ফেলতে থাকলো। বাঁচার সব আশা ছেড়ে অভিশপ্ত ট্রেনের তরুণ যাত্রী কান্টু (তপন কুমার দাস), নিঝু আগরওয়ালা, শ্যামলাল আগরওয়ালা, বিনোদ আগরওয়ালা, শ্যামসুন্দর দাস, গোবিন্দ চন্দ্র দাস মৃত্যুর অপেক্ষায় ধৈর্য হারালো। কান্টু দাস তার প্রিয় দাদাকে মিনতি করেও পালাতে রাজি করতে পারলো না। স্ত্রী ছেলে মেয়েকে মৃত্যুর মুখে রেখে নিজের জীবন বাঁচানোর মানে হয় না। বংশ রক্ষার আশায় দাদার কথা রাজি হয়ে জানালা খুলে নিচে লাফ দিলেন তিনি, মাটিতে পড়েই পশ্চিম দিকে দৌড়, তার সাথে নিঝু, শ্যাম, বিনোদ গোবিন্দসহ আরও ২০/২৫ জন। ঠা ঠা গুলির আওয়াজ কানে এলো। কয়েক জন লুটিয়ে পড়ে কাটা মুরগির মতো ধড়ফড়াতে লাগলো। কাদায় পিছলে পড়ার সময় মাথায় গরম বাতাসের ছোয়া পেলেন, কিমতি গোলি টার্গেট ভেদ করতে পারেনি। তারমতো ভাগ্যবান ২১ জন পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হন।

সন্ধ্যা নাগাদ নয়নজুলী খালে নয়নের জল ফেলার মতো কেউ অবশিষ্ট রইলো না, ততক্ষণে খালের পানি আর রেললাইনের পাশের সবুজ ঘাস লাল বর্ণ ধারণ করেছে। খালে আর লাশ ফেলার মতো জায়গা না থাকায় তাদের জায়গা হলো রেললাইনের পাশে হাঁটু পরিমান গর্তে। ইতিমধ্যে ট্রেনে পড়ে থাকা মাল সামানার মালিক বনে গেছে দিনের কসাইরা। রাত ন’টা নাগাদ যাত্রীশূন্য ট্রেন সৈয়দপুর ফিরে এলে, রক্তেভেজা বগিগুলো দ্রুত ধুয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়ে শেষ হয় “অপারেশন খরচাখাতা”।

পুনশ্চঃ একজন মায়ের সরলতা প্রচণ্ড বিস্মিত করেছে, সৈয়দপুর মাড়োয়াড়ি পট্টির বাসিন্দা আচুকি দেবী (৯০) আজও বিশ্বাস করেন, ওই অভিশপ্ত ট্রেনের যাত্রী তার কন্যা কাঞ্চন দেবী সিংহানিয়া আজও বেঁচে আছে। বিয়ের সময় ওর বয়স ছিলো কুড়ি, একদিন সেভাবেই তার কাছে ফিরে আসবে। তার প্রশ্ন “তোমরা কি কেউ আমার কাঞ্চন কে দেখেছ…?

*তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ৮ম খণ্ড ও বীর মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবঃ) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির,বীরপ্রতীক মহোদয়ের লেখনী

** প্রিয় পাঠক, লেখার ভুল ধরিয়ে দিলে উপকৃত হবো এবং তা সংশোধন করবো, অনিচ্ছাকৃত ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখাসহ নিহতদের আত্মার শান্তি কামনার আবেদন রইলো। প্রত্যাশা সঠিক তথ্য উপস্থাপন।