ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: গল্পটা প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের

0
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: গল্পটা প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক আবেগের নাম। শত শত শিক্ষার্থীর আবেগের সাথে মিশে আছে এই ঢাবি। ঢাবির রঙিন লাল দেওয়াল নজর কাড়ে সবার। তবে শত শত শিক্ষার্থীর আবেগের এই স্থানটির ইতিহাস আমরা কতজন জানি? আজ থেকে ১০০ বছর আগে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। তবে তার আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার দ্বার উন্মোচন হয়েছিল ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনার মধ্য দিয়ে। ১৯২১ সালের জুলাই মাসে ১২টি বিভাগ ও ৮৪৭ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা আরম্ভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে আলাদা রাজ্য গঠিত হয়েছিল এবং তা এ অঞ্চলের মুসলিমপ্রধান জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের চাওয়া–পাওয়ারই প্রতিফলন, যেটি এই অঞ্চলের মুসলমানদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে অনেক সহায়তা করেছিল এবং তাদের স্বাবলম্বিতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিশেষ সহায়তা ছিল। তবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিরোধিতার মুখে ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ ব্যবস্থাকে বাতিল ঘোষণা করে, যা বঙ্গভঙ্গ রদ নামে পরিচিত। উক্ত সময়ে কলকাতার উচ্চশিক্ষিত ও হিন্দু নেতারা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা রোধে স্মারকলিপি প্রদান করেই চুপ থাকেননি, প্রতিবাদ সভা থেকে শুরু করে র‍্যালি পর্যন্ত সব কিছুর আয়োজনই তারা করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ রদকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার মুসলিমেরা ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ ও আশাহত হন। পরবর্তীতে ‘বাংলার বাঘ’ খ্যাত এ কে ফজলুল হক ও সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে পুর্ব বাংলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। সর্বপ্রথম ৩১/০১/ ১৯১২ তারিখে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকায় আসেন এবং উক্ত সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি তোলা হয়। তখনকার সময়ে পূর্ব বাংলায় ৯টি কলেজ থাকলেও ছিল না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় । পরে এই অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের দাবিকে সম্মান এবং সমর্থন জানিয়ে লর্ড কার্জন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন গ্রহণ করেন। তার ফলে সেই বছরেরই ২ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় রাজ্য সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সপক্ষে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়। স্যার রবার্ট নাথানিয়েলের নেতৃত্বে ২৭ মে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট ‘নাথান কমিটি’ গঠিত হয় এবং এই কমিটি ১৯১২ সালের শেষ দিকে রিপোর্ট প্রদান করেন। পরবর্তীতে ১৯১৩ সালে জনমত গ্রহণের জন্য নাথান কমিটি তাদের রিপোর্টটি প্রকাশ করে আর ডিসেম্বরে তা অনুমোদন লাভ করে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে ঢাবি প্রকল্প স্থগিত থাকে দীর্ঘদিন।

ইংরেজ সরকার ‘স্যাডলার কমিশন’ গঠন করে পূর্ববর্তী ‘নাথান কমিশন’-এর রিপোর্টকে পর্যালোচনা করে । ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে ‘স্যাডলার কমিশন’ তাদের রিপোর্ট প্রদান করে। উক্ত বছরেই সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী Imperial Legislative Council-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও নিবন্ধনের জন্য আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্যে একটি বিল উত্থাপন করেন এবং এটি পাশ হয় ২৩/০৩/ ১৯২০ তারিখে। ২৩ মার্চ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট ১৯২০’ নামে, যার অধীনে পূর্ব বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে আজ থেকে ১০০ বছর আগে ১৯২১ সালের ১ জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পেছনে যে ব্যক্তিটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তিনি হলেন ‘স্যার খাজা সলিমুল্লাহ’। স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি মূলত ১৯১১ সালের আগস্টেই এক রাজনৈতিক সমাবেশে উত্থাপন করেছিলেন। বঙ্গভঙ্গ বাতিলের পর তার এই দাবি সর্বজনীন রূপ পায়।

স্যার সলিমুল্লাহর দান করা ৬০০ একর জমির উপর ১৯২১ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতে অক্সব্রিজ শিক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড এর নীতিবাক্য হচ্ছে ‘সত্যের জয় সুনিশ্চিত’ এবং স্লোগান হচ্ছে ‘শিক্ষাই আলো’। ঢাবি রাজধানী ঢাকার রমনা, ঢাকা, ১০০০, বাংলাদেশ ২৩°৪৩′৫৯″ উত্তর ৯০°২৩′২৮″ পূর্ব অবস্থিত। যার আচার্য রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ এবং উপাচার্য মোহাম্মাদ আখতারুজ্জামান। বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১২টি ইনস্টিটিউট, ৫৬টি গবেষণা বুরো ও কেন্দ্র, ২০টি আবাসিক হল ও ৩টি ছাত্রাবাস এবং ৭টি স্নাতক পর্যায়ের অধিভুক্ত সরকারি কলেজ-সহ মোট ১০৫টি অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে ঢাবিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ গ্রন্থাগার। বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এখানে পড়াশোনা করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছিল বিশেষ অবদান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি পদক লাভ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এশিয়া উইকের শীর্ষ ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল।