‘অর্থা’কে টপ অফ দ্যা মাইন্ডে পরিণত করতে চাই : পার্থ

0
'অর্থা'কে টপ অফ দ্যা মাইন্ডে পরিণত করতে চাই : পার্থ

নিতাই সরকার পার্থ। অর্থা ই-কমার্সের সত্ত্বাধিকারী। ব্যাবসায়ী জীবনের নানান অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন নিউজইনসাইড ২৪ এর সাথে। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন ইসমাইল উদ্দীন সাকিব।

শুরুর গল্পটা ছোট্ট করে শুনতে চাই…

-স্বপ্নটির শুরু ২০০৮ সাল থেকে। ২০১২ সালে বিবিএ করার পর মনের ভিতর স্বপ্নটা আরো পাকাপোক্ত হয়। এরপর ঠিক করলাম, আগে এমবিএ করবো। এরপর কিছুদিন চাকরির অভিজ্ঞতা অর্জন করে কিছু শুরু করাটা ভালো হবে। পরিকল্পনার মতোই সবকিছু হয়েছে। এমবিএ করার পাশাপাশি ২০১৩ থেকে একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করি, ২০১৫ সালে এমবিএ শেষ হয়। ২০১৫ সালে আমার ভাবনার বাস্তবায়ন শুরু হয়। বাকিদের মতোই আমিও স্বপ্ন দেখতাম, তবে ঘুমিয়ে দেখার পরিবর্তে আমি স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমে ঢলে পড়তাম। ঘুমানোর জন্য যে বালিশ, মশারি প্রয়োজন; একটা ঘরের জন্য যে পর্দা, তোশক প্রয়োজন এসব নিয়েই কিছু করার স্বপ্ন দেখতাম।

চাকরি জীবন নিরাপদ এই ধারণা আমাদের দেশে প্রচলিত। ব্যাবসায়ী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?

-পড়াশোনা করার পর ব্যবসা আমাদের সমাজে প্রচলিত নয়। আমাদের বাবা-মা সহ সকলেই ভাবে যে চাকরি জীবন নিরাপদ। আমরা ব্যবসায়ীরাও বুঝতে পারি যে চাকুরিজীবনটা অনেক নিরাপদ। তবে আপনার যদি বড় কোন স্বপ্ন থাকে, কোন একটি বিশেষ আকাঙ্খা থাকে, সেটি তো চাকরী দ্বারা কখনোই পূরণ করা সম্ভব নয়। এর জন্যে আপনাকে ঝুঁকি নিতে হবে। আমিও ঝুঁকি নিয়েছিলাম, তাই চাকরিটা ছেড়ে ব্যবসাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। যখন পড়াশোনা করছিলাম তখন ইচ্ছে ছিল চার্টার্ড একাউন্টেন্ট হবো। হয়তো কোন কারণে আমি ইচ্ছেটা থেকে সরে আসলাম।

ই-কমার্সে আসলেন কেন?

-আমার চাকরিটা ছিল ই-কমার্স ভিত্তিক। ওখান থেকেই আমার হাতেখড়ি। প্রোডাক্ট ফটোগ্রাফি, ই-কমার্স বেজমেন্ট থেকে সবকিছুই আমার ঐ চাকরি জীবন থেকেই শেখা। ঐ কাজটা আমার অনেক বড় অভিজ্ঞতা ছিল, ওটা ছাড়া হয়তো এই পর্যায়ে আসাটা এত সহজ হতোনা।

এতদূর আসতে কিধরণের বাধার মুখোমুখি হয়েছেন?

-আসতে অবশ্যই অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। কারণ ব্যবসায় আমার সাথে যারা জড়িত তাদের পরিবারকে ভালো রাখা, নিজের পরিবারের ভালো থাকা সবই খেয়াল রাখতে হয়। প্রথমদিকে পরিবারের কেউই ব্যবসার বিষয়টা মেনে নেয়নি। সরকারী চাকরি নিয়েই তাদের আশা ছিল। কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাকরি করাটা কেন জানি আমার ভালো লাগতো না। আমি নিজেকে নিজের মতো তৈরী করতে চেয়েছিলাম। শুরুর দিকে অনেক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। তবে মাকে কোনভাবে রাজি করানোয় মা সবসময় সহযোগিতা দিয়েছেন, আরো বেশ কিছু মানুষও তখন পাশে ছিল। অনেক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি ছিল চাকরি ছেড়ে ব্যবসা নিয়মিত করা ও তা পরিবারকে বোঝানো। তবে পরিবার এক সময় বিষয়টি মেনে নিয়েছে।

ব্যাবসার পুঁজি কিভাবে পেলেন?

-২০১৫ সালে, একদিন আমি কাপড়ের দোকানে গিয়েছিলাম। কেনো জানি ওখানেই ব্যবসা শুরু করার ধারণাটা মাথায় আসে। তখন হাতে কোন পুঁজিই ছিলোনা। এসময় আমার মা আমার পাশে এসে দাড়ায়।

ব্যাবসার ধরণ নির্বাচন করলেন কিভাবে?

-কিছু লেডিস আইটেম নিয়ে আমি প্রথম কাজ শুরু করি। বেশ কিছুদিন পর, দেবাশিষ ফনি, আমার একজন মেন্টর বলা চলে, তার পরামর্শে আমি লেডিস আইটেমের ব্যবসার মায়া ত্যাগ করে হোম ডেকর নিয়ে কাজ শুরু করি। এরপর ধারাবাহিকভাবে বেডশিট নিয়ে কাজ শুরু করি। এসবের জন্য আমি সবসময় দেবাশিষ দাদাকে স্মরণ করি। উনি যদি ঐদিন আমাকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত না করতেন, তাহলে আমি আজকের আমি হতাম না। এরপরও আমার আরো কিছু সমস্যা ছিল। ছবি তোলার মতো কোন খাট আমার ছিলনা। ঢাকায় মেসে থাকতাম, ব্যাচেলর জীবন বলে ডেকোরেট কোনকিছু ছিলোনা। অনেকের বাসায় গিয়ে ছবি তুলতাম, বিষয়টা খারাপ দেখালেও। অপারগ হয়ে তাদের অনুনয় বিননয় করতাম। এরপর ২০১৬ সালে ঈদের আগে আমি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিই আমার একটি মেশিন ও একটি খাট দরকার, ফটোশ্যুট এর জন্যে। আমার দুটি জিনিস একসাথে কেনার সামর্থ্য তখন ছিলোনা।

সোশাল মিডিয়া অনেকেই অনেকভাবে ব্যবহার করে। কিন্তু আমার জন্য এটি একটি বড় আশির্বাদ ছিলো। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা, জেফরিন ফরিদ ম্যাডাম, তাকে আমার ব্যবসা যতদিন থাকবে, এমনকি আমার মৃত্যুর পরও তাকে স্মরণ করতে হবে। কারণ, তিনি ঐ ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখার পর ঐদিন রাতেই আমাকে মেসেজ দেন। তিনি বলেন, ‘পার্থ আপনি যদি কিছু মনে না করেন, আমি আপনাকে একটি খাট দিতে চাই।’ আমি আসলে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, কান্না চলে এসেছিল। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায়ই ম্যাডাম আমার জীবনে আশার বাণী হয়ে এসেছিল। তিনি আমাকে শুধু খাট নয়, বেডরুম সাজাতে যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই দিয়েছিলেন। এটি আমার জন্যে অনেক বড় অনুপ্রেরণা। ম্যাডামসহ কিছু মানুষ আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। এইধরণের কিছু মানুষ আছেন বলেই আমরা উদ্যোক্তারা এখনো স্বপ্ন দেখি, অর্থনীতিকে আরো বেশি বেগবান করার মাধ্যমে সুন্দর একটি বাংলাদেশের।

একজন ভালো ব্যবসায়ীর কি কি বৈশিষ্ট্য থাকা উচিত?

উত্তরঃ আমি তো এখনো শিখছি। শেখার কোন শেষ নেই, মাত্র পাচবছর চলছে আমার ব্যবসার। তবে ব্যবসায়ীদের প্রথমেই তার পণ্যগুলো ক্রেতাদের কতটুকু খুশি করতে পারবে, ক্রেতারা তার পণ্য নিয়ে কি ভাবছে, এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এবিষয়টি নিয়ে একজন ব্যবসায়ীর সবচেয়ে বেশি কাজ করা উচিত বলে আমি মনে করি। ক্রেতাদের জীবনের সাথে যদি আমার পণ্যগুলোকে মিশিয়ে দিতে পারি, তাহলেই ব্যবসা থেকে ভালো কিছু সম্ভব। রণদাপ্রসাদ সাহা, জহুরুল হক, মুকেশ আম্বানি এদের সবসময় আমি অনুসরণ করি। তাদের যে বৈশিষ্ট্যগুলো রয়েছে, তা যদি বিবেচনা করি, তাহলে একজন ব্যবসায়ীর সততা ও প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখার গুণ থাকতে হবে। একজন ভালো ব্যবসায়ীর এই গুণদুটো থাকা আবশ্যক। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমি এখনো পর্যন্ত এটা বজায় রেখেছি, আমি চাই যে আমৃত্যু যাতে এটা বজায় রাখতে পারি। একজন ব্যবসায়ীর সবসময় উচিত তার প্রতিশ্রুতি ঠিক রাখা। সেটা একজন সাপ্লাইয়ারের সাথে হতে পারে, ডিজাইনারের সাথে হতে পারে, যে কারো সাথেই। একইসাথে সততাও বজায় রাখতে হবে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকলে আজ হোক বা কাল, যে কারো পক্ষে একজন ভালো ব্যবসায়ী হওয়া সম্ভব।

অন্যান্য উদ্যোক্তাদের থেকে হয়তো আমি কিছুটা ভাগ্যবান। শুরুতে যখন পুঁজির সংকট ছিল, আমার মা আমাকে ৬০হাজার টাকা দিয়েছিলেন। কিছুদিন পরে হলেও আমার পরিবার আমাকে উৎসাহ দিয়েছে, মেনে নিয়েছে। তারা এখনো আমার পাশে আছেন। তবে মাঝেমাঝে সমাজের কাছে তারা কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন। অনেকে জানতে চায়, ‘আপনাদের ছেলে বিবিএ এমবিএ করে এখন কি করছে? কিসের ব্যবসা? ই-কমার্স কি?এসব হয়তো মা-বাবাকে আরো বেশ কিছুদিন ভোগাবে, যতদিন না ঐভাবে প্রতিষ্ঠিত কিছু হতে পারছি। আমি বিশ্বাস করি, যেহেতু এত মানুষের দোয়া, বাবা-মায়ের দোয়া পাচ্ছি; যদি লেগে থাকতে পারি একদিন হয়তো অনেক বড় পর্যায়ে পৌছাব।

পাঁচ বছর পর কোথায় দেখে চান নিজেকে?

  • পাচবছর তো খুবই কম সময়। আসলে আমার একটিই লক্ষ্য, বাংলাদেশের প্রতিটি গৃহে ‘অর্থা’কে পৌছে দেয়া। আমি চাই যে মানুষ যেন ‘অর্থা’ কে মনে রাখে। এই স্বপ্নটি আমি দৃঢ়ভাবে লালন করি। পাচবছর পর যখন মানুষ অনলাইনে হোম ডেকোর কেনাকাটা করবে, তারা যেন সবার আগে ‘অর্থা’র কথাই ভাবে। এই শীর্ষস্থানটি আর মানুষের এই ভালোবাসাটি আমি পেতে চাই। আমাদের মূল পণ্য যেহেতু বেডশিট, বিভিন্ন উৎসবে-বিভিন্ন ঋতুতে কিভাবে আরো বর্ণিল ও ভিন্ন ধরণের বেডশিট আনা যায়, তা নিয়ে কাজ করছি। আমাদের সামনে ফার্নিচার নিয়েও কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা অনেক খরচ করে পোশাক-আশাক কিনি। কিন্তু জীবনের অনেকটা সময় যে ঘুমিয়ে কাটাই, সেই ঘুম আরামদায়ক ও নির্বিঘ্ন হওয়ার জন্য যা দরকার তা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাই না। হতাশা, অসুস্থতা সহ নানা সমস্যায় জনসংখ্যার বিশাল একটা অংশ নিদ্রাহীনতায় ভুগছে। অথচ ঘুম নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবি না। এরজন্য যে রঙের সমন্বয় দরকার, সাজানো দরকার তা নিয়ে ভাবতে হবে। আপনার কি ধরণের রং পছন্দ, ঘরে সূর্যের আলো প্রবেশ করবে কি করবেনা, মাথার বালিশটি কেমন হবে সবই কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসে টুনি মন্টুকে যেই বালিশটি দেয়, বাংলাদেশের ৯৯% ঘরেই এই অবস্থা দেখা যাবে। খুব কমসংখ্যক পরিবার, যারা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে তারাই হয়তো প্রতিনিয়ত বালিশ পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু আমাদের সকলেরই ছয়মাস পরপর বালিশ পরিবর্তন করা উচিত, প্রতি সপ্তাহে রোদে শুকানো উচিত। এই ছোট ছোট দিকগুলো খেয়াল করলে জীবন থেকে হতাশা, অসুস্থতা অনেকাংশে কমে যাবে। পণ্য বিক্রি করাই আমাদের একমাত্র উদ্দ্যেশ্য নয়, আমরা ক্রেতাদের কিছু সাধারণ পরামর্শও দিতে চাই। পণ্য দেয়ার পাশাপাশি কিভাবে সুস্থ থাকা যায়, অন্দরমহল সাজানো যায় এসব পরামর্শ দিয়ে পাচবছর পর এদেশের ঘরে ঘরে আমরা গেথে যেতে চাই।

তরুণদের কি পরামর্শ দেবেন?

  • আসলে আমি নিজেই তরুণ (হাসি)। তারুণ্যের উদ্দিপনা সবার মাঝে থাকুক এটাই চাই। তরুণরা ব্যবসা করার আগে, কোন প্রতিষ্ঠানে যদি কিছুদিন কাজ করতে পারে, সততার সাথে অভিজ্ঞতা নিতে পারে, তবে অভিজ্ঞতাগুলো তার ব্যবসায় অনেক বেশি কাজে দিবে। সামনের চ্যালেন্জগুলো মোকাবিলা করা অনেক সহজ হবে।

ই-কমার্স নিয়ে সকলের উদ্দেশ্য কি বলবেন?

-অনেকেই ই-কমার্স নিয়ে বাজে ধারণা পোষণ করেন। কেউ কেউ ছবি দেখেই পণ্য সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে বসেন। তবে অনেক তরুণই অনেককিছু ভাবছে, করছে। তারা ভালো পণ্য দিতে চায়, ভালো সেবা দিতে চায়। তবে ব্যবসায় সকলেই কিন্তু ভালো করতে পারেনা, সেটা সাধারণ হোক অথবা ই-কমার্সই হোক। যেহেতু ই-কমার্সে আসাটা খুবই সহজ, সকলেই আসতে পারে। তাই পণ্য কেনার আগে যদি ক্রেতারা পেইজ বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে একটু জেনে নেন, তবে আর প্রতারিত হবেন না। আমি চাই তরুণরা এমন একটা পরিস্থিতি তৈরী করুক যেখানে মানুষ ই-কমার্স নিয়ে আরো বেশি উদ্বুদ্ধ হবে। নিরাপদ বোধ করবে। আর ‘অর্থা’ যাতে দেশের সকলের সুস্থতা, সুখ বজায় রাখার জন্য দেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে পৌছে যায়, এটাই আমার প্রত্যাশা।