‘আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আমি ছাড়া আপনাদের কারোর নেই। আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য কোনও সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ করবেন না। বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করবেন না। আসানসোলে এখন শান্তির প্রয়োজন। আপনারা যদি আমায় ভালোবাসেন, তাহলে শান্তি বজায় রাখুন। আর যদি তা করেন তাহলে আমি আসানসোল ছেড়ে চলে যাব ৷”
পুত্রের জানাজায় এসে শান্তির জন্য এমন মহানুভবতার পরিচয় দিলেন আসানসোল মসজিদের ইমাম ইমদাদুল রাশিদি। প্রিয়জনের হত্যার বদলা নিতেই যেখানে মানুষ বেশি আগ্রহী থাকে সেখানে নিজের প্রিয় সন্তানের হত্যার বদলার পরিবর্তে শান্তির জন্য এমন আহবানই জানালেন পিতা। ইমামের এমন আহবানে আসানসোলের দাঙ্গা পরিস্থিতি এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। অনেক বড় সহিংসতা থেকে আসানসোল রক্ষা পেয়েছে।
গত মঙ্গলবার সন্ধ্যাবেলায় হিন্দু ধর্মের রামনবমী উপলক্ষে মিছিল বের হয় আসানসোল শহরে। মিছিল থেকে ধর্মীয় উষ্কানিমূলক স্লোগান দেয়া হতে থাকে। মুসলমানদের পাকিস্তান চলে যাওয়ার কথাও বলা হয়। এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মিছিলটি যখন চাঁদমারি এলাকা অতিক্রম করছিল তখন মিছিলের উপর ইটপাটকেল ছুড়ে মারা হয়। এরপরই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। শুরু হয় দাঙ্গা। দাঙ্গায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৪ জন। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় বেশকিছু বাড়ি ও দোকানপাট এবং গাড়িতে।


বৃহস্পতিবার খবর এলো, নুরানী মসজিদের ইমাম ইমদাদুল রাশিদির ষোল বছরের সন্তান সিবতুল্লাহ রাশিদির লাশ পড়ে আছে স্থানীয় হাসপাতালে। তাঁকে বলা হলো হাসপাতালে গিয়ে লাশ সনাক্ত করতে। আসানসোলের পরিস্থিতি তখনো দুদিনের হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের জের ধরে থমথমে। চারিদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে নানা গুজব। ইমাম হাসপাতালে গিয়ে সনাক্ত করলেন নিজের ছেলের ক্ষত-বিক্ষত লাশ। নখ উপড়ে নেয়া হয়েছে। ঘাড়ে ধারালো অস্ত্রের কোপ। লাশটি পুড়িয়ে ফেলানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন- “খুব যন্ত্রণা দিয়ে মেরে তো ফেলেইছে ছেলেটাকে, তারপরে দেহটা জ্বালিয়েও দিয়েছিল। এটা কেন করল ওরা!”
ক্ষত-বিক্ষত লাশটি যখন মহল্লায় আনা হলো, পরিস্থিতি হয়ে উঠলো আরও উত্তপ্ত। ইমাম সাহেবের ছেলের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা সবাইকে উত্তেজিত করে তুললো। বদলা নিতে মরিয়া সবাই। ভয়াবহ দাঙ্গার সম্মুখীন আসানসোল, যে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো ভারতে। ইতিমধ্যে দাঙ্গায় ফায়দা লুটতে ইন্ধন যোগাতে শুরু করলো কিছু রাজনৈতিক নেতা।
ইমাম ইমদাদুল রাশিদি বুঝলেন এখন দাঙ্গা থামাতে না পারলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। প্রাণ যাবে অসংখ্য মানুষের। সন্তান হত্যার বদলা না নিয়ে পরিচয় দিলেন মহানুভবতার, সত্যিকার মুসলিমের। দাঁড়ালেন মানবতার পক্ষে। একটা মাইক হাতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে সবার প্রতি অনুরোধ করলেন শান্তি বজায় রাখতে।
সন্তানের জানাজায় শরিক হয়ে , ঈদ্গাহ ময়দানে হাজির হাজার হাজার মানুষের উদ্দেশ্যে অনুরোধ করলেন শান্তি ফিরিয়ে আনতে।
‘আমার সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার অধিকার আমি ছাড়া আপনাদের কারোর নেই। আমার সন্তানের মৃত্যুর জন্য কোনও সাধারণ মানুষের উপর আক্রমণ করবেন না। বাড়িঘর, দোকানপাট ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করবেন না। আসানসোলে এখন শান্তির প্রয়োজন। আপনারা যদি আমায় ভালোবাসেন, তাহলে শান্তি বজায় রাখুন। আর যদি তা করেন তাহলে আমি আসানসোল ছেড়ে চলে যাব ৷”
মুলত তার উদ্যোগেই ভয়াবহ দাঙ্গা থেকে রক্ষা পেল অসংখ্য মানুষ।সন্তানের হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে কেন এমন করলেন জানতে চাইলে ইমাম ইমদাদুল রাশিদি বলেন – “আমি ৩০ বছর ধরে ইমামতি করছি। মানুষকে সঠিক বার্তা দেয়া, শান্তির বার্তা দেয়া আমার গুরুত্বপূর্ন দায়িত্ব। ব্যক্তিগত দুঃখের উর্ধ্বে আমাকে ভাবতে হবে।”
