কর্নেল মুয়াম্মর গাদ্দাফি: ইতিহাসের নায়ক নাকি খলনায়ক?

0
গাদ্দাফি

১৯৪২ সালে লিবিয়ার উপকূলীয় শহর সির্তের অদূরে এক গ্রামের দরিদ্র বেদুইন যাযাবর পরিবারের তাবুতে জন্ম নেয় এক পুত্র শিশু। পিতা আবু মিনিয়ার পুত্রের নাম রাখলেন মুয়াম্মর আবু মিনিয়ার আল-গাদ্দাফি। পিতা মাতার একমাত্র জীবিত সন্তান গাদ্দাফি (আগে ৩ বোন সকলেই শিশুকালেই মারা যায়) বেদুইন সংস্কৃতিতে বড় হতে থাকে। যা পরবর্তী সময়েও তার মাঝে বিদ্যমান ছিল। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও সে অধিকাংশ সময় তাবুতে কাটাতেন, শহরের চেয়ে মরুভূমিকে বেশি পছন্দ করতেন।

গাদ্দাফি
কর্নেল মুয়াম্মর গাদ্দাফি

সকল আরব শিশুর মত শৈশবে ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন।সেসময় লিবিয়াতে লেখাপড়া ফ্রি ছিল না তবুও কিন্তু দরিদ্র পিতা সন্তানকে উন্নত জীবনের আশায় আরো লেখাপড়া শিখাতে চাইলেন। পুত্রকে পাঠালেন সির্ত শহরের এক স্কুলে। বাসা থেকে স্কুলের দুরত্ব অনেক হওয়ায় এবং হোস্টেলে থাকার মত অর্থ না থাকার কারনে সপ্তাহের স্কুলের দিনগুলোতে মসজিদে থাকতে হতো গাদ্দাফিকে। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ২০ মাইল পথ হেটে চলে আসতো বাড়ি। পিতা এক গোত্র প্রধানের অধীনে কাজ পাওয়ার গাদ্দাফির পরিবার সির্তে থেকে ফেজান এলাকার সাবাহ নগরীতে চলে আসে। গাদ্দাফিও সেখানে এসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয়। লেখাপড়া, নেতৃত্বের গুণাবলীতে গাদ্দাফি স্কুলে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই স্কুলের অনেকেই গাদ্দাফির সময়ে লিবিয়ার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেন। বিশেষ করে গাদ্দাফি তার কাছের বন্ধু আব্দুস সালাম জালৌদকে লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে বসিয়েছিলেন।

সেসময় লিবিয়া ছিল ইউরোপের উপনিবেশ। গাদ্দাফি তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন ইউরোপিয়ানদের বিতাড়িত করে একটি স্বাধীন লিবিয়ার। সাবাহর স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষক ছিল মিশরের। এইসব শিক্ষকের মাধ্যমে  গাদ্দাফি মিশরের খবরের কাগজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক আর্টিকেল, রেডিও অনুষ্ঠান পড়ার সুযোগ পান। মিশরের বিপ্লবী নেতা কর্নেল জামাল আব্দুল নাসের এর লেখা বই ‘বিপ্লবের দর্শন’ পড়ে গাদ্দাফি নাসের ভক্ত হয়ে যায়। তার মাঝে গড়ে উঠতে থাকে  রাজনৈতিক চেতনা। নাসেরের উপনেবিশবাদ ও ইসরায়েল বিরোধী মতবাদের বিরুদ্ধে আরব জাতীয়তাবাদের ধারনা দ্বারা ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত হন গাদ্দাফি। তাঁকে গুরুর মত সম্মান দিতেন । এমনকি নিজে কর্নেল এর পরের ধাপে নিজের পদবী নেন নি কারন নাসের ছিলেন কর্নেল পদবীর। নিজের গুরুর চেয়ে উপরের পদবীতে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তিনি! লিবিয়াতে সাধারণত কারো মূর্তি তৈরি করা হয় না। কিন্তু বেনগাজি শহরে রয়েছে কর্নেল নাসের-এর একটি পাথরের মূর্তি।

গাদ্দাফি
কর্নেল নাসেরের সাথে গাদ্দাফি

স্কুলে থাকাকালীন সময়েই গাদ্দাফি তৎকালীন উপনিবেশবাদী অত্যাচারী রাজতন্ত্রকে উৎখাতের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ফলে স্কুল থেকে বহিষ্কার হোন।

সাবহা থেকে বহিস্কার হয়ে তিনি মিসার্তা চলে আসেন এবং মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর বেনগাজীর তৎকালীন ইউনিভার্সিটি অব লিবিয়াতে ভর্তি হন কিন্তু পড়ালেখা শেষ না করেই ১৯৬৩ সালে বেনগাজীর সামরিক পরিষদে যোগদান করেন এবং উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্যে ব্রিটেন গমন করেন ও ১৯৬৬ সালে কমিশন প্রাপ্ত অফিসার পদে উন্নীত হয়ে লিবিয়ায় ফিরে আসেন এবং তাঁর অনুগত কতিপয় সামরিক কর্মকর্তা সহ লিবিয়ার পশ্চিমমুখী রাজতন্ত্রকে (সেনুসী রাজতন্ত্র) উৎখাত করার জন্যে একটি গুপ্ত সংঘ গঠন করেন।

১৯৬৯ সালের পহেলা সেপ্টেম্বরে তৎকালীন লিবিয়ার বিলাসপ্রিয়,সাম্রাজ্যবাদের পুতুল রাজা মুহাম্মাদ ইদ্রিস আল সেনুসী তাঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্য তুরস্ক সফরে যান। এই সুযোগে ২৭ বছরের যুবক কর্নেল মুয়াম্মার আল গাদ্দফি তাঁর অনুগত অল্প কতক সামরিক অফিসারের সহায়তায় রাজধানী ত্রিপলীতে এক প্রতিরোধ ও রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আফ্রিকার বৃহত্তম তেলভান্ডার ও বিশ্বের শীর্ষ তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার শাসন ক্ষমতা দখল করেন।পশ্চিমাদের পুতুল রাজার উচ্ছেদকারী গাদ্দাফিকে মানুষ বিপুলভাবে সেদিন স্বাগত জানায়,যা লিবিয়ার ইতিহাসে সেপ্টেম্বর বিপ্লব নামে পরিচিত। গাদ্দাফির এ সকল কাজে তাঁকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিলেন গাদ্দাফির মানস গুরু ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু তৎকালীন মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের।যার ফলে আজও জামালের মৃত্যুদিবস লিবিয়াতে সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালিত হয়। সাবেক রাজা আমীর ইদ্রিস আল সেনুসীকে তুরস্ক থেকে মিশরে নির্বাসন দেয়া হয় এবং তিনি আমৃত্যু সেখানেই অবস্থান করেন।
এদিকে গাদ্দাফি তাঁর বাহিনীর অভ্যন্তরীণ ও দেশের প্রভাবশালীদের মধ্যকার ক্ষমতা কেন্দ্রিক দ্বন্দ ও বিবাদ নিরসন করে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করে ১৯৭০ সালের জানুয়ারিতে একজন সফল শাসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

শুরু থেকেই পশ্চিমাদের সাথে সাপে-নেউলে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে চলা এই আফ্রিকান একনায়ক,রাজাদের রাজা,মরু ঈগল ১৯৭৭ সালে তাঁর দেশের নাম বদলে গ্রেট সোশ্যালিস্ট পপুলার লিবিয়ান জামাহিরিয়াহ (জনতার রাষ্ট্র) রাখেন।এ সময় দেশের সাধারণ মানুষদের পার্লামেন্টে তাঁদের মতামত জানাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ সময় তিনি সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ প্যান-আরব গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহন করেন এবং দেশের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে ছোটো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় রাখার অনুমতি দেন।

তাঁর চেতনার মূলে ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা,তিনি ছিলেন শতভাগ আরব জাতীয়াতাবাদী, দেশপ্রেমিক ও একগুঁয়ে, বিভিন্ন সময় তাঁর ভাষণে তিনি পশ্চিমাদের হুমকি ধামকি দিতেন আর পশ্চিমারাও তাঁকে সমীহের চোখে দেখত!

১৯৭৫ সালে তাঁর রাজনৈতিক দর্শনে রচিত কিতাব আখজার তথা দ্য গ্রীন বুক প্রকাশ করেন। ইসলামের শরিয়াহ ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নীতিমালাকে ভিত্তি করে লেখা এই বইটিই ছিল লিবিয়ার সংবিধান! স্কুলে এই বই পড়া ছিল বাধ্যতামূলক। সবুজ রঙের প্রতি তাঁর ছিল দুর্বলতা। তার সময়ে লিবিয়ার জাতীয় পতাকাও ছিল সম্পূর্ন সবুজ রঙের। একশত নারী দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে পছন্দ করতেন রহস্যময় এই রাজা! বেশিরভাগ সময় কাটাতেন তাঁবুতে। ঈদের নামজে করতে ইমমতি। অধিকাংশ সময়ই তিনি স্থানীয় ঐতিহ্যময় পোশাক আরবি আলখেল্লা, মাথায় ফেজহীন লাল টর্কিশ টুপি ও গায়ে সাদা কম্বল জড়িয়ে রাখেন।  তবে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে সামরিক পোশাক, ব্যাজ পড়তেন।

গাদ্দাফি
এরকম তাঁবুতে থাকতেন গাদ্দাফি
গাদ্দাফির নারী দেহরক্ষী
গাদ্দাফির নারী দেহরক্ষী

গাদ্দাফির আরেকটি ব্যতিক্রম স্বভাব ছিল। তিনি নিয়মিত টেলিভিশনে লেকচার দিতেন রাজনৈতিক দর্শনের উপরে। এজন্য তাঁকে শিক্ষক রাজাও বলতো অনেকে।

লিবিয়ার পুনর্গঠনে তাঁর অবদান অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই। তাঁর আমলেই শিক্ষিত নাগরিকের হার ২৫%  হার থেকে বেড়ে ৮৩% হয়েছিল! দেশের মানুষ বিনা মুল্যে শিক্ষা, বিদ্যুৎ সুবিধা ও বিনা সুদে ঋণ পেত (দেশের সকল ব্যাংক রাষ্ট্রায়ত্ত)।দেশের সকল নাগরিকের বাসস্থানের ব্যবস্থা না হওয়ায় তাঁর বাবা-মাকেও তাঁবুতে জীবন কাটিয়ে যেতে হয়েছিল বলে তিনি সকল নাগরিকের জন্য সরকারিভাবে বাসভবন করে দিতেন। লিবিয়ার প্রত্যেক নবদম্পত্যিকে ৫০ হাজার ডলার দেয়া হতো যাতে তারা বাড়ি কিনে নতুন জীবন শুরু করতে পারে।বিনা মূল্যে চিকিৎসা এবং কৃষি খামারিদের সরকারের তরফ থেকে ভূমি ও বীজ সহ যাবতীয় উপকরণ দেয়া হতো(ফ্রিতে)। চিকিৎসা বা শিক্ষা সেবা নিতে দেশের কোনও নাগরিককে বিদেশে যেতে হলে তার সমস্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করত এবং লিবিয়ার তেল বিক্রির একটা অংশ প্রত্যেক নাগরিকের একটা ব্যাংক নাম্বারে সরাসরি জমা হতো।সন্তান জন্ম দিলে প্রত্যেক মাকে পাঁচ হাজার ডলার দেয়া হতো। তাঁর সময়ে লিবিয়ার কোনও বৈদেশিক ঋণ ছিল না!

মূলত বহু গোত্রে বিভক্ত ও সদা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ-সংঘাতে লিপ্ত একটি দারিদ্র পীড়িত জাতিকে তিনি তেল সম্পদ আবিস্কারের পর যত দ্রুত একটি উন্নত রাষ্ট্রে রুপান্তর করেছিলেন তা সত্যই বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে আর কোনও নেতা দেখাতে পারেননি! কিন্তু তাঁর স্বৈরাশাসন,একনায়কতন্ত্র,এবং দেশের ক্ষমতা শুধু একটি পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হওয়া ও বিরোধী মতকে নিষ্ঠুর উপায়ে দমন,হত্যা এবং পরস্পর বিভক্ত গোত্রভিত্তিক জনগোষ্ঠীর অসমতা,অসন্তোষ ও বিভেদই তাঁর ইতিহাসের দীর্ঘ একনায়কতন্ত্রের বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শত্রুদের সুযোগ এনে দিয়েছিল তাঁকে তারই জন্মভূমি সির্ত এ জনতার হাতে নির্মম পরিণতি বরণ করে নিতে।

মূলত ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় পশ্চিমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পরিকল্পনার অংশ ছিল গণতন্ত্রের বুলি আওড়ে আরব রাষ্ট্রগুলোয় অস্থিরতা ছড়িয়ে দিয়ে দেশগুলিকে বহুধা বিভক্ত করে তাদের তেলখেত্রগুলির দখল নেয়া,তারই নির্মম বলি হন লৌহমানব মুয়াম্মার গাদ্দাফি,যিনি ছিলেন সাদ্দাম হুসেইনের পরে পুরো আরবে একমাত্র পশ্চিমা বিদ্বেষী।তাই তো আমরা দেখছি,আরব বসন্তের সূচনাকারী দেশ তিউনিসের রাজা বেন আলি বা মিশরের স্বৈরাশাসক হোসনি মুবারাক আজও জীবিত রইলেও দুই পশ্চিমা বিরোধী সাদ্দাম বা গাদ্দাফির কেও বেঁচে নেই। গাদ্দাফি আফ্রিকার বহু দেশকে সাহায্য করেছেন কিন্তু তাঁর বিপদে কেউ তাঁর পাশে ছিল না, এমনকি তাঁকে আশ্রয় পর্যন্ত দিতে চায়নি।

বিরোধী বা ভিন্ন মতাবলম্বীদের একদমই সহ্য করতে পারতেন না গাদ্দাফি। তার গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক ছিলো অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, পরিকল্পিত এবং সর্বত্র সম্প্রসারিত। কারো আচরণে সন্দেহ হলে কিংবা কাউকে তথাকথিত বিপ্লবের বিরোধী মনে হলেই তার ওপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ, প্রায়শই যার পরিণতি ছিল মৃত্যু। তাই দেশের উন্নয়নে এবং ৬০ লাখ জন-অধ্যুষিত দেশটির পুনর্গঠনে গাদ্দাফি দৃশ্যত যতই অবদান রাখুন না কেন, দুনিয়ার সব স্বৈরশাসকের মতো তিনিও সমতার বোধসম্পন্ন লিবিয়ান মানুষদের ঘৃণা ও রোষের টার্গেটে পরিণত হন। তবুও গাদ্দাফি এগিয়ে যাচ্ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তিকে ভ্রকুটি দেখিয়ে। কিন্তু বিশ্বের তাবত স্বৈরশাসকের মতো তারও পরিণতি হলো মর্মান্তিক ও ভয়াবহ।

পাশ্চাত্য- সমর্থিত ন্যাটো বাহিনী এবং লিবিয়ার বিদ্রোহী ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিল- এনটিসি গেরিলাদের আট মাসব্যাপী যৌথ আক্রমণে তছনছ হয়ে যায় ‘লৌহমানব’ গাদ্দাফির ৪২ বছরের একচ্ছত্র শাসন। ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর নিজ জন্মশহর সির্তে-তে দু’মাস ধরে পাইপের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তিনি বিদ্রোহী সেনাদের হাতে ধরা পড়েন এবং রোষোন্মত্ত বিদ্রোহীদের গুলিতে মারা যান।

গাদ্দাফি
নিহত গাদ্দাফি

গাদ্দাফির পতনের পর একে-একে বেরিয়ে আসতে থাকে তার শাসনামলের নানা লোমহর্ষক ঘটনা; সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার-জুলুমের কাহিনি। প্রকাশ হতে থাকে দেহরুক্ষী সহ বেশ কিছু নারীর ধর্ষিত হওয়ার কথা। বিদ্রোহকালীন মাত্র আট মাসে ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ গাদ্দাফি-সমর্থকদের হাতে হন নিহত, আহত ও গৃহহারা। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ২০০২ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে লিবীয় গোয়েন্দা বিভাগ এম১৬ সিআইএ-র মতো আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করতে থাকে। এই সংস্থাগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় অবস্থানকারী ভিন্নমতাবলম্বী লিবীয়দের বিষয়ে কোনো সার্ভিসচার্জ ছাড়াই তথ্য সরবরাহ করে লিবীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে। গাদ্দাফি বিশ্বব্যাপী তার অগণিত সমালোচনাকারীকে হত্যার জন্য তার কূটনীতিক নেটওয়ার্ক বিস্তার করেন, বহু লোক রিক্রুট করেন।

বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদেরও তিনি ব্যাপক সাহায্য- সহযোগিতা ও সমর্থন দান করেন। লিবিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তোলার ব্যাপারে তাদের কয়েকজনকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা দেন। এমনকি বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মাফ করে দেয়ার জন্য তিনি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠিও দেন। মুজিব হত্যার অব্যবহিত পরে ফারুক ও রশিদ উভয়ই কর্নেল গাদ্দাফির মহাসম্মানীয় (ভিআইপি) অতিথি হিসেবে লিবিয়ায় বসবাস করতে থাকেন।

লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতন হয়েছে ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই,যদিও তিনি দেশটির জন্যে সবই করেছিলেন। তবে গণতন্ত্রের চর্চার সুযোগ না দেয়ায় তিনি তাঁর জাতিকে রাজনীতি সচেতন করতে পারেননি। ইরাক-আফগানের জ্বলন্ত উদাহরণ চোখের সামনে থাকতেও পশ্চিমাদের ফাঁদেই পা দিল নৃতাত্তিকভাবে খণ্ড খন্ড সত্ত্বা নিয়ে গড়ে ওঠা একটা বেদুঈন জাতিরাষ্ট্র লিবিয়া।এর ওপরই সেকুলার আরব ন্যাশনালিজম আর সঙ্গে আধখানা কমুনিজম চাপিয়ে দিয়েছিলেন গাদ্দাফি,সব মিলিয়ে গ্রিনবুক; চার দশকের লৌহ শাসনে গ্রিনবুক নির্ঘাত কাজের ছিল, গনতন্ত্র কিনে সরকারি আবাসন,রেশন,জ্বালানির বেহেস্তটাকে দোজখ বানিয়ে গাদ্দাফিহীন শত মতে বিচ্ছিন্ন লিবিয়া তা টের পাচ্ছে নিশ্চয়। লিবিয়ায় ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। আহত হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার লোক। অভাব-অনটন দেশজুড়ে। দুর্নীতি ও অনাচারে ভরে গেছে দেশ।
সে যাই হক,সময়ই বলে দিবে ভুল-সঠিকের পাঠ!

মৃত্যুর আগে গাদ্দফি একটি অসিয়তনামা রেখে যান। আরবীতে লেখা অসিয়তনামার বঙ্গানুবাদ এরকম:

এটা আমার অসিয়তনামা। আমি মুয়াম্মার বিন মোহাম্মদ বিন আবদুস সালাম বিন হুমায়ুদ বিন আবু মানিয়ার বিন হুমায়ুদ বিন নায়েল আল ফুহসি গাদ্দাফি, শপথ করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো প্রভু নেই এবং মুহম্মদ (সা) তার নবী। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমি মুসলিম হিসেবেই মরব। নিহত হলে, আমি চাই আমাকে যেন মুসলিম রীতি অনুযায়ী সমাহিত করা হয়। মৃত্যুর সময় যে কাপড়ে থাকব সে কাপড়েই এবং শরীর না ধুয়েই সিরতের গোরস্থানে যেন সমাহিত করা হয়, আমার পরিবার ও আত্মীয়দের পাশে। আমি চাই, আমার মৃত্যুর পর আমার পরিবার বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সঙ্গে যেন ভালো ব্যবহার করা হয়। লিবিয়ার জনগণের উচিত তাদের আত্মপরিচয়, অর্জন, ইতিহাস এবং তাদের সম্মানিত পূর্ব পুরুষ ও বীরদের ভাবমূর্তি রক্ষা করা। লিবিয়ার জনগণের উচিত হবে না, স্বাধীন ও শ্রেষ্ঠ মানুষদের ত্যাগের ইতিহাস বিসর্জন দেওয়া। আমার সমর্থকদের প্রতি আহ্বান, তারা যেন সব সময়ের জন্য আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিশ্বের সব স্বাধীন মানুষকে জানিয়ে দাও, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও সুস্থির জীবনের জন্য আমরা যথেষ্ট দরকষাকষি করেছি এবং সামর্থ্য খাটিয়েছি। এর বিনিময়ে আমাদের অনেক কিছু দিতে চাওয়া হয়েছিল কিন্তু এই সংঘাতের সময় দায়িত্ব ও সম্মানের রক্ষাকারী হিসেবে দাঁড়ানোকেই আমরা বেছে নিয়েছি। যদি আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিজয়ী নাও হই তবু আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই শিক্ষা দিয়ে যেতে পারব, জাতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব বেছে নেওয়া হল সম্মানের আর এটা বিক্রি করে দেওয়ার মানে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা। যে দায়িত্ব বেছে নিলে ইতিহাস চিরকাল মনে রাখবে।

লেখকঃ ব্রাহাম নাইম