এমন অনেক কিছুই হবে যা কেউ ভাবেনি আগে, আবার এমন অনেক কাহিনী আছে যা এখন আপনি ভাবতেও পারবেন না। যেমন মা তার সন্তানকে বিয়ে করেছে আবার তাদের সন্তানও হয়েছে এমন ঘটনা এখন শুনলে আপনার পিলে চমকাতে পারে, কিন্তু গ্রীক মিথলজিতে এগুলো ছিলো হরহামেশা ঘটা সাধারণ ঘটনা। বুড়ো দাদাদের মুখে গল্প শুনে বড় হয়েছেন, কিন্তু নিজে বুড়ো হলে কি বলবেন নাতি-নাতনিদের তা কি ঠিক করেছেন? না করলে থাকুন আরো কিছুক্ষন, পেয়ে যাবেন রোমাঞ্চকর কাহিনী যা সত্যও নয় মিথ্যাও নয়; মিথ। গ্রীক মিথলজিতে স্বাগতম।
গ্রীক মিথলজির গল্প বিশাল, চরিত্রও অনেক। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি সংক্ষেপে ও সহজভাবে মূল কাহিনী লিখার। মনে রখার সুবিধার্থে আসুন প্রথমে একে তিনভাগে ভাগ করি। বাকি যেসব ডালপালা আছে তা ভিন্ন ভিন্ন আকারে আনা যাবে। প্রথম প্রজন্মের দেবতাদের গড, দ্বিতীয় প্রজন্মকে টাইটান ও তৃতীয় প্রজন্মকে অলিম্পিয়ান- এই তিন ভাগে ভাগ করলাম।
প্রাথমিক অবস্থায় শুধুই ছিলো ক্যায়োস। প্রথম যে মানবীর জন্ম আমরা জানতে পারি সে হচ্ছে গাইয়া। গাইয়া চাইতেন তার সন্তান মর্তে আসুক। সে এজন্যে এতটাই ব্যাকুল ছিলো যে সে তার সমপর্যায়ের ইউরেনাস কে সৃষ্টি করে।
সন্তান হওয়া সত্ত্বেও ইউরেনাস ও গাইয়ার মিলনের ফলেই জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান। এই প্রথম প্রজন্মকেই বলা হতো টাইটান । মূলত এইখান থেকেই পিতা-পুত্রের দন্দ্ব শুরু।
ইউরেনাস ও গাইয়ার ইচ্ছাতেই সন্তান জন্ম নিলেও ইউরেনাস তাদের পছন্দ করতো না। কারন এই সন্তানেরা ছিলো একেক জন এক এক প্রজাতির। কেউ দানব আকৃতির বিশাল, কেউ বা অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী । ইউরেনাস মনে করতো এই সকল সন্তানেরা তার ধ্বংসের কারন হয়ে দাঁড়াবে, তাই সে জন্মের পরপরই এদেরকে মায়ের গর্ভেই লুকিয়ে রাখতো (কেউ কেউ বলে অন্য কোথাও লুকিয়ে রাখতো)। এভাবে তাদের ছয় ছেলে ছয়জন মেয়ের জন্ম হয়। সকলের নাম না জানলেও সর্বকনিষ্ঠ ক্রোনস এর নামটা জেনে রাখুন ও মনে রাখুন।
একে একে সন্তানদের পৃথিবীর আলো দেখাতে না পারার কষ্ট এক সময় সইতে না পেরে মা গাইয়া তার সন্তানদের আদেশ দিলো তাদের বাবার এই নির্দয় নিষ্ঠুরতার প্রতিশোধ নিতে। অন্য সবাই ভয় পেলেও ক্রোনস সাহস করলো। সে তার বাকি পাঁচভাই কেও রাজি করিয়ে ফেললো।
এক রাতে যখন ইউরেনাস গাইয়ার সাথে মিলিত হতে আসে, ক্রোনাস ও তার ভাইয়েরা মিলে আক্রমন করে ইউরেনাসের উপর। তারা তাকে বন্দি করে এবং তার পুরুষাঙ্গ কেটে সমুদ্রে ফেলে দেয় । অর্থাৎ পুত্র কর্তৃক পিতা নপুংসক হয়ে যায়! এরপর মারা না গেলেও ইউরেনাস কে আর দেখা যায় না। সে তার ক্ষমতা হারায়। কিন্তু সে ক্রোনাস কে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলো- ক্রোনাস ইউরেনাস এর সাথে যা করেছে ক্রোনাস এর সন্তানেরাও তার সাথে এমন করবে!
ইউরেনাস এর শেষ কথা ক্রোনাস মনে রাখে।
এরপর অনেক দিন কেটে যায়। ক্রোনাস বিয়ে করে টাইটানদের মধ্যে সবচেয়ে শান্ত গডেস বা দেবী রিহা কে। রিহা ও ক্রোনাসের ঘরেও সন্তান জন্ম নিলো। কিন্তু ক্রোনাস তার পিতার অভিশাপের কথা ভুলে নি। সেও ধরে নিয়েছিল তার সন্তানেরা তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। ঠিক যেমনটি সে করেছিল। এ জন্যে সে তার সন্তানদের জীবন্ত গলধঃকরন করতো। মা রিহা এসব সহ্য করতে পারলো না। সে ক্রোনাস কে বোকা বানিয়ে একবার সন্তানের পরিবর্তে পাথর মুড়ে এনে দিলো ক্রোনাস কে। ক্রোনাস সেটাইকেই সন্তান ভেবে গলধঃকরন করে ফেলে। এভাবে রক্ষা পেল সন্তান জিউস। যার নাম ভবিষ্যতে আমাদের বারবার নিতে হবে। বিভিন্ন কারনে জিউস গ্রীক দেবতাদের ইতিহাসের অনেকটা যায়গা জুড়ে আছে। মা রিহা সন্তান জিউস কে মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়। ক্রোনাস যখন জানতে পারে এসকল ঘটনা, সে তার গলধঃকরন করা ১১ সন্তানকেও শাস্তি হিসেব মর্তে পাঠিয়ে দেয় শাস্তি হিসেবে।
এই ১২ সন্তান অলিম্পিক পর্বতে আশ্রয় নেয়। আর এই কারনেই আমরা যাদেরকে অলিম্পিয়ান বলি। এই ১২ জন হলো জিউস, হেরা, পেসিডন, দেমেতার, হেডিস, এথেনা,এপোলো্,আরথেমিস, এইরিস, আফ্রোদিতি, , হারমেস ও হিবি ।
রোমান মিথলজিতে এই ১২জনের নাম যথাক্রমে জুপিটার, জুনো, নেপচুন, সেরিস, মিনার্ভা, এপোলো, ডায়ানা, মার্স, ভেনাস, মারকারি ও ভলকান।
মূলত এই ১২ জন দেবতা ও দেবী থেকেই মূল ঘটনার মোড় ঘুরে যায়।
অলিম্পিয়ানরা অন্যান্য টাইটানদের সাহায্য নিয়ে ক্রোনাস এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ক্রোনাস করে পরাজিত করে মুক্ত হবার পর ক্ষমতার বন্টন করা হয় ১২ দেবতা ও দেবীর মাঝে। মূল ক্ষমতা বণ্টন হয় মূলত জিউস, পেসিডন ও হেডিস এর মধ্যে।
হেডিস কে দেয়া হয় সকল মৃতদের উপর ক্ষমতা। সে ছিল মৃতদের দেবতা, আগুনের দেবতা। অন্যদিকে পেসিডন পায় সমুদ্র, ভূমিকম্প ও সকল পানির উপর একচ্ছত্র আধিপত্তের ক্ষমতা । আর জিউস ছিলো ‘কিং অব গডস’। আলো ,আধার আর বৃষ্টির ক্ষমতার অধিকারী ছিলো জিউস । আইন ও বিচারের দেবতাও জিউস।
জিউস যেমন ছিল ‘কিং অব গডস’ তেমনি হেরা ছিল ‘কুইন অব গডেস’। অর্থাৎ দেবীদের রানী। নারী,শিশু ও পরিবার বিষয়ক দেবী ছিল সে।
আফ্রোদিতির কথা আমরা কম বেশী সবাই জানি। যে ছিল অসাধারন সুন্দরী দেবী। তার এই সৌন্দর্যের সূত্র ধরেই আমরা পরবর্তীতে শুনতে পারি “ট্রোজান হর্স ওয়ার” , “হেলেন অব ট্রয়” এর মতো কাহিনী। যেখান থেকে আমরা একিলিস এর মতো বীর এর সন্ধান ও পাই।
এপোলো ও আরথেমিস ছিলো যমজ ভাই-বোন। এপোলো ছিল সংগীত, সুর, আলো ও সত্যের দেবতা। আর্থেমিস ছিল কুমারীত্ব, জন্ম, চাঁদ, পশুপাখির দেবী।
এথেনা ছিল জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্যের দেবী। হারমেস ছিল যোগাযোগ, বাণিজ্য, কূটনীতি ও ক্রীড়ার দেবতা।
এরিস ছিলো যুদ্ধের দেবতা। যাকে পরবর্তিতে জিউসের সন্তান হারকিউলিস হারিয়েছিল।
অনেকটা আমাদের সরকারের মন্ত্রণালয় এর মত লাগছে না? একেকজন দেবতা ও দেবী একেক বিভাগের দায়িত্বে।
তবে দেবতাদের মধ্যে প্রায়ই ক্ষমতার অপব্যবহার ও অন্তঃদন্দ্ব দেখা দিত। এসকল ক্ষমতার ব্যবহার অপব্যাবহার সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন ভাবে জানতে পারি। যে সকল ঘটনা অনেক সময় আমাদের বর্তমান বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়। তার কিছু উদাহরন দিচ্ছি……..
উল্যেখযোগ্য একটি ঘটনা পাওয়া যায় দেমেতার ও হেডিস এর মধ্যে। দেমেতার ছিল ফসলাদি ও শস্যের দেবী । তার একটি সুন্দরী কন্যা ছিলো যাকে হেডিসের পছন্দ হয়ে যায়। বোনের কন্যা হয়েও হেডিস দেমেতার কন্যাকে বন্দি করে লুকিয়ে রাখে। দেমেতার যখন এই ঘটনা জানতে পারে সে তার কন্যাকে ফেরত চায়। কিন্তু হেডিস তাকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয় না। অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে হেডিস রাজি হয় কিন্তু শর্ত দেয় দেমেতার তার কন্যা কে বছরে ছয় মাসের জন্যে কাছে পাবে। কন্যার শোকে কাতর থাকার কারনে বছরের বাকি ছয় মাস কোনো ফসল হতো না। বলা হয়ে থাকে এই ছস মাসই গ্রীকদের শীতকাল । যখন কোনো শস্য ফলানো যেতো না।
গডস টু গডস দন্দ্ব সংঘাত থেকে আমরা পরবর্তিতে প্রমিথিউস, এপিমিথিউস, পারসিয়াস, পেন্ডোরাস বক্স, মেডুসার মত রোমাঞ্চকর কাহিনী শুনতে পাই। যেগুলো ইতিহাসে যেমন যুগে যুগে মানুষকে রোমাঞ্চিত, বিস্মিত আর অবাক করেছে তেমনি করেছে কৌতুহলী। যার অনেক কিছুই বিভিন্ন ভাবে ব্যখ্যা দিয়ে যৌক্তিক মনে করা যেতে পারে আবার অনেক কিছুই অযৌক্তিক। তবু ঘটনাগুলো আমাদের রোমাঞ্চ, আনন্দ দিয়ে যাবে সবসময় ।
***
আমি আগে ভাবতাম আমি ই শুধু আমার আব্বা-আম্মার অবাধ্য সন্তান। উল্টোটা অবশ্য আমার আব্বা-আম্মা ও ভাবে। তারা ভাবে দুনিয়ায় আমার মতো অবাধ্য ছেলে মনে হয় একটাও নাই। ছোটোবেলা থেকে এই জন্যে কতো রূপকথার গল্প বানিয়ে বানিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে শিখানোর চেষ্টা করেছে গুরুভক্তি। কিছুই যে শিখিনি তা ও না। কিন্তু আক্ষেপ তবুও ছিলো । ছেলেদের বলার জন্যে কি কিছুই নাই?
অবশেষে পাইলাম, তাহাকে আমি পাইলাম। আব্বা-আম্মা বুড়ো হবার পর তাদের ও আমি রূপকথার গল্প শুনাবো। বুঝিয়ে দেবো যে শুধু আমি না, গ্রীক দেব দেবীরাও বাপ-মা এর কথা শুনে নাই। শোনাবো গ্রীক পুরাণের মিথ বা গল্পকথা। যা নিয়ে বই, সাহিত্য, নাটক, উপন্যাস , মুভি কত কিছুই না রয়েছে। তাই কিভাবে সেই গল্প বলবো তার একটা নমুনা আজ এখানে রেখে যেতে চাই। আশা করি প্রতিটি ঘটনা ধারাবাহিক ভাবে জানাতে পারবো আপনাদের ।
সাথে থাকুন……………….কথা হবে আগামী পর্বে।
(চলবে……)
লেখকঃ শরীফুল ইসলাম
(পরবর্তী পর্ব ও আরো নানা রোমাঞ্চকর, ঐতিহাসিক কাহিনী জানতে নিউজ ইনসাইড ২৪ এর সাথেই থাকুন)