টানা দশমবারের মত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শেষ ষোলতে ব্রাজিল

0
টানা দশমবারের মত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শেষ ষোলতে ব্রাজিল

টানা দশমবারের মত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে শেষ ষোলতে চলে গেলো ব্রাজিল। সেইখানে তাদের প্রতিপক্ষ মেক্সিকো। মেক্সিকোর সাথে ওয়ার্ল্ড কাপে ব্রাজিলের পরাজয় নাই। কিন্তু এর বাইরে, ১০ বার তাদের কাছে হারছে ব্রাজিল। মেক্সিকোর দলটাও এবার অনবদ্য। ফলে পা মাটিতেই রাখতে হইতেছে ম্যানেজার টিটেকে।

গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের খেলা নিয়া কিছু বলা দরকার, বিশেষত লাস্ট ম্যাচটা নিয়া। গ্রুপ পর্বে ব্রাজিলের খেলায় আমি মোটামুটি সন্তুষ্ট। কোয়ালিফায়ার রাউন্ডে টিটের যে পরিচিত গেম প্ল্যান দেখছিলাম, সেইটাই টিটে কন্টিনিউ করছেন। ২০১০ এ দুঙ্গা ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরে, দলের খেলার ধরণে একটা চেঞ্জ আনেন। অতিমাত্রায় ডিফেন্সিভ এবং কাউন্টার এটাক-নির্ভর ওই ব্রাজিলের খেলা এবং দুঙ্গার ‘যেকোনভাবে জয় চাই’ ট্যাকটিস বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হইছিলো তখন। সেই থেকে, ব্রাজিলের আজ পর্যন্ত যতগুলি খেলা আমি দেখছি, বেশিরভাগ খেলা শেষে একটা কমন ডায়লগ লোকমুখে দেখা যায়–‘জিতছে, কিন্তু সেই যে খেলা, সেই যে রোনালদো অমুক তমুক ওরকম না। ভালো খেলে নাই, কিন্তু জিতছে।’ এই মন্তব্যটা দুঙ্গার ব্রাজিলের বেলায় অনেকটা সত্যই ছিলো, সত্য ছিল ২০১০ বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর দুঙ্গার বদলে দলের দায়িত্ব নেওয়া মানো মেনেজেসের ব্রাজিলের বেলায়ও। কিন্তু টিটের ব্রাজিলের বেলায় এই কথা খাটে না। এগুলো বলে যারা, তাদের কেউ কেউ অতীতচারী (আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম-টাইপের একঝাঁক লোক সব জায়গায়ই থাকেন। ওনাদের চোখে অতীতের চে বর্তমান কখনই সুন্দর হইতে পারে না), কিছু আছে বিশেষ একটা দলের অপোগণ্ড সমর্থককুল, আর কেউ কেউ আছেন, যারা এই নতুন ম্যানেজার টিটের ট্যাকটিসগুলি ধরতে পারছেন না। তার খেলার ধরণের সাথে ঠিকঠাক রিলেট করতে পারছেন না।

আচ্ছা, গোড়া থেকে শুরু করা যাক। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের পরে, লুই গেলিপে স্কলারির কাছ থেকে আবার দায়িত্ব পান দুঙ্গা। ব্রাজিল দলটা তখন দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া একটা বিভীষিকার মতন। ১৪’ তে কয়েকটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচে জয় পায় দুঙ্গার ব্রাজিল। তারপরে আসে ২০১৫ কোপা আমেরিকা। নক আউট স্টেজে প্যারাগুয়ের সাথে টাইব্রেকারে হেরে বাদ পড়ে ব্রাজিল। এর ফলে, ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মত ওয়ার্ল্ড কাপের আগে ‘মিনি ওয়ার্ল্ড কাপ’ খ্যাত কনফেডারেশন কাপে কোয়ালিফাই করতেই ব্যর্থ হয় ব্রাজিল, অথচ তারা ছিল ২০০৫, ২০০৯ এবং ২০১৩, টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন। ২০১৬ কোপায় অবস্থা আরো খারাপ হয়, গ্রুপ স্টেজে পেরুর সাথে ১-০ গোলে হারে ব্রাজিল, ১৯৮৫-র পরে এই প্রথম পেরুর সাথে কোন ম্যাচ হারে তারা, ১৯৮৭-র পরে প্রথমবারের মত কোপার নক আউটে যেতে ব্যর্থ হয়।

ওয়ার্ল্ড কাপ কোয়ালিফায়ার রাউন্ড ততদিনে শুরু হয়ে গেছে। সেখানেও ভয়াবহ অবস্থা। প্রথম ম্যাচেই চিলির সাথে ২-০ ব্যবধানে পরাজয়, আর্জেন্টিনার সাথে ১-১ ড্র। প্রথম ৬ ম্যাচে ২ জয়, ১ হার আর ৩ ড্র নিয়ে পয়েন্ট টেবিলে ব্রাজিল তখন ৫ম, বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়ার শঙ্কা পুরো ব্রাজিলজুড়ে। ঠিক এই সময়, ২০১৪-র যে দলটা তখনও ঘুরে দাঁড়াতেই পারে নাই, তাদের দায়িত্ব নেন টিটে। এরপরে কী হলো? ছোট্ট একটা পরিসংখ্যান দিই। পরের ১৩ ম্যাচে ১১ টিতে জয় পায় ব্রাজিল, ২ টিতে ড্র, কোন হার নাই। এর মধ্যে আছে আর্জেন্টিনার সাথে ৩-০ গোলের জয়। ৫ম স্থানে থাকা ব্রাজিল, ২০১১ সালের পরে প্রথমবারের মত লাতিন আমেরিকার কোয়ালিফায়ার টেবিলে টপ করে, বিশ্বের সর্বপ্রথম দল হিশাবে নিশ্চিত করে বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্বের টিকেট। আরেকটা পরিসংখ্যান দিই, টিটের অধীনে এই দলটি ২৪ ম্যাচ খেলেছে, যার ১৯ টিতে জয়, ৩ টিতে ড্র, এবং একটিমাত্র ম্যাচে হার, সেটাও ছিলো একটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ। টিটের এই দল এই ২৪ ম্যাচে গোল করেছে ৫২ টি, বিপরীতে গোল কনসিড করছে মাত্র ৬ টা, যেখানে আর্জেন্টিনা এই ওয়ার্ল্ড কাপের গ্রুপ স্টেজেই গোল খাইছে ৫ টা! ভাবা যায়!

অনেকে বলছেন, ব্রাজিল এবারের বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে সর্বনিম্ন গোল করেছে গত চার আসরের চেয়ে। পরিসংখ্যানটা সত্য না। ব্রাজিল এবার গ্রুপ স্টেজে মোট ৫ টা গোল করছে, ২০১০ বিশ্বকাপেও গ্রুপ স্টেজে তাদের গোল ছিল ৫ টা। বিপরীতে লক্ষ্য করার মত ব্যাপার হলো, গ্রুপ স্টেজে বিগত চার আসরের চেয়ে (২০০৬ বাদে) কম গোল ব্রাজিল কনসিড করেছে এই ওয়ার্ল্ড কাপে; ২০০২ এ ৩ টা, ২০০৬-এ ১ টা, ২০১০-এ ২ টা, ২০১৪-তেও ২ টা। এবারে মাত্র ১ টা। আর টিটের ট্যাকটিসটা এখানেই।

টিটের লক্ষ্য হলো দুর্গের মত সলিড ডিফেন্স, মাঝমাঠ থাকবে ক্রিয়েটিভ। গোটা দলের গোল করার দরকার নাই। গ্রুপ স্টেজের তিনটা ম্যাচেই, বিরাট কোন হুমকির মুখে পড়ে নাই ব্রাজিলের ডিফেন্স। সার্বিয়ার সাথে ম্যাচে সেকেন্ড হাফের শুরুর ১৫ মিনিটের যে আক্রমণ, সেটাই সম্ভবত গ্রুপ স্টেজে ব্রাজিলের রক্ষণের জন্য সবচে বড় পরীক্ষা ছিল। ব্রাজিল সেটায় উতরে গেছে ভালোভাবেই। টিটের ব্রাজিলের ডিফেন্স সদা সতর্ক, হেডে ও এরিয়াল উইনে পারঙ্গম। এই দিকটা ব্রাজিলের জন্য অনেক বড় শক্তির জায়গা। অনেকে খেলার গতি নিয়া প্রশ্ন তুলেছেন। তারা হয়তো তাহলে, ব্রাজিলের কোয়ালিফায়ার রাউন্ডের খেলাগুলা দেখেন নাই। টিটে দায়িত্ব নেওয়ার পরে ব্রাজিলের প্রত্যেকটা ম্যাচই এমন ছিলো। খুব আগ্রাসী, ছিঁড়ে-ফেঁড়ে-খুঁড়ে খেলা, গতির বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া খেলা টিটের ব্রাজিল একটা ম্যাচেও খেলে নাই। চাইলে হাইলাইটস দেখতে পারেন। ধীরস্থিরভাবে ব্রাজিল খেলা শুরু করে, মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণটা ঠিক রাখে, ডিফেন্স ঠিক রাখে। এরপরে দুই উইং ধরে মার্সেলো আর আলভেজ (এখন উইলিয়ান/ কস্তা), আর মাঝমাঠে কুটিনহো এবং ফলস নাইনে অবশ্যই নেইমার ধীরে ধীরে এটাক তৈরি করতে থাকে। শুরু থেকেই খুব প্রেসিং করে খেলা বা খুব গতি নিয়ে শুরু করার নজির ব্রাজিলের গত ২৪ ম্যাচে নাই।

ব্রাজিলের এটাক নিয়া আমি চিন্তাগ্রস্ত না। ফিনিশিংয়ে সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু এটাক হচ্ছে। কোস্টারিকার সাথে তো এক নাভাসের দৃঢ়তায়ই গোল হয়নাই, কালকেও মুহুর্মুহু এটাক করছে ব্রাজিল। বাঙালির ফুটবল দর্শনে গোল একমাত্র মাপকাঠি, ভালো খেলা খারাপ খেলা মাপার, ফলে, যত বেশি গোল তত ভালো দল/খেলা, এরকম তারা ধরে নেয়। ব্রাজিল কাল অনেকগুলো সুযোগ মিস করেছে, কিন্তু সুযোগগুলো ক্রিয়েট করা ছিল দেখার মতো। প্রত্যেকটা এটাকই খুব সুন্দর ছিলো।চার গোল হতে পারতো, অথচ হলো ২ গোল, এই মাপকাঠিতে যারা ভাল খারাপ বিচার করেন, তাদের বিচারে আমার আস্থা নাই।

যাই হোক, এবারে ব্রাজিলের শক্তির জায়গা অবশ্যই ডিফেন্স। অসাধারণ একটা ডিফেন্স ব্রাজিলের, এটা কন্টিনিউ করতে হবে। এলিসনের পরীক্ষা সেভাবে হয় নাই যদিও, তাও বেশ কয়েকটা সেভ করেছেন। মাঝমাঠে ক্যাসে-পাওলি গত দুই ম্যাচে অফ থাকলেও, কাল দুইজনের খেলাই ভালো ছিলো। সার্বিয়ার লম্বা আর শক্তিশালী প্লেয়ারদের বিপক্ষে ম্যাক্সিমাম এরিয়েল বল জিতেছেন ক্যাসেমিরো, পাওলিনহো করেছেন দুর্দান্ত গোল। আর মাঝমাঠে কৌটিনহো তো আছেনই! এটাকিং মিডে আবার যেন সেই সোনালি যুগের ব্রাজিলকে দেখতে পাচ্ছি কৌটিনহোর ভেতর!

দুর্বলতার কথা বলতে গেলে, প্রথমেই আসে ইঞ্জুরির আলাপ। আলভেজ থাকলে এবারের ওয়ার্ল্ড কাপে কী মারাত্মক একটা দল থাকতো ব্রাজিলের, ভাবতেছি। রাইট ব্যাকে আলভেজ নাই, আসলো দানিলো। আলভেজের রাইট উইং ধরে ছুটে গিয়ে দেওয়া বিষাক্ত ক্রসগুলা যোগ হইলে, ডানে-বামে সমানতালে এটাক করতে পারতো ব্রাজিল। উইলিয়ানের উপরেও চাপ কম থাকতো। দানিলো ডিফেন্সে খুব ভালো, খুব পরিশ্রম করে খেলেন; কিন্তু উইং ধরে ছুটে গিয়ে ওই যে ক্রিয়েটিভ এটাক তৈরি, এ কাজটা তিনি পারেন না। উলটো ডিফেন্সে তারে সাপোর্ট দিতে উইলি বারবার নীচে নেমে এসেছেন প্রথম ম্যাচে। উইলির জন্য কাজটা কঠিনই, মূলত উইং ধরে এটাক করাই তার কাজ, একইসাথে ডিফেন্সে নামা আবার এটাকিংয়ে আসা তার জন্য টাফ। তবু দানিলো ছিলেন, পড়লেন ইনজুরিতে। এখন যিনি খেলছেন তিনি লাস্ট চয়েজ ফ্যাগনার। ফ্যাগনার একটা এসেট, করিন্তিয়াসে টিটের অধীনেই খেলেছেন, গত ম্যাচে তার পারফরম্যান্স অসাধারণ ছিল, কিছু মারাত্মক রানও ছিলো তার। কিন্তু হাইট সমস্যা আর অভিজ্ঞতার ব্যাপারটা তো থেকেই যায়। তাছাড়া তার পরে এই জায়গাটায় আর কেউ নাই, এটাও অনেক বড় ভয়ের ব্যাপার। রাইট উইংয়ে উইলিয়ান আছেন অফ ফর্মে, বারবার বল হারাচ্ছেন, ক্রসগুলো হচ্ছে না ঠিকঠাক। তার জায়গায় ডগলাস কস্টা ছিলেন ভরসা, অসাধারণ গতি আর ড্রিবলিং ক্ষমতা আছে কস্টার, সে নামার পরেই ঘুরে গিয়েছিলো কোস্টারিকার সাথে ম্যাচটা, এই ছেলেটাও পড়লো ইনজুরিতে। কাল মার্সেলো ম্যাচের শুরুতেই উঠে গেলো, যদিও শুনেছি গুরুতর কিছু না। তো ইঞ্জুরি সমস্যাটা খুব ভোগাচ্ছে। এর বাইরে, জেসুসের পারফরম্যান্সে আমি হতাশ। কে বলবে যে, এই ছেলেই কোয়ালিফায়ারে ব্রাজিলের পক্ষে সর্বোচ্চ গোল করেছে! ওর প্রথম বিশ্বকাপ এটা, নার্ভাস থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু খোলস ছেড়ে বের হতে হবে ওকে। গতি, ফিনিশিং একুরেসি সবই ওর আছে। জাস্ট একটা গোল পেলেই ও স্বরুপে ফিরবে। তবে ফিরমিনোকে আরো বেশি সময় খেলানো উচিত ব্রাজিলের। জেসুস যদি ফ্লপ হয়, সেক্ষেত্রে ম্যাচের ৭০-৮০ মিনিট পর্যন্ত তারে খেলানোর মানে নাই।

মিডফিল্ডে ক্যাসে-পাওলি উন্নতি করছে। আগের চে বেটার ছিল গত ম্যাচের পারফিরম্যান্স। ওরা আরো বেটার করবে আশা করা যায়। নেইমার প্রসঙ্গে আপাতত কিছু বলব না। ১ গোল, ১ এসিস্ট করেছে সে এই ওয়ার্ল্ড কাপে। তাকে নিয়ে আলাদাভাবে লিখব। হোল্ডিং মিডে ফার্না-ক্যাসে, ওকে। পাওলি যদি রাইট সাইড দিয়ে আরেকটু এটাকিং হয়, আরেকটু প্রেসিং হয়, খুব ভালো হবে ব্যাপারটা। আর কৌটিনহো তো আছেই, এবারের ওয়ার্ল্ড কাপে ব্রাজিলের সবচে বড় ভরসার নাম কৌটিনহো।

গ্রুপ স্টেজে ব্রাজিলের খেলা ভালো লেগেছে। ধীরস্থির, মাথা ঠান্ডা রেখে খেলা শুরু করা, এবং ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে এটাক করা, ডিফেন্স আর মিড সবসময় সতর্ক থাকা, কাউন্টার এটাকের সুযোগ পেলেই হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দ্রুত রান নেওয়া–সবটাই ভালো। কেবল ফিনিশিংয়ে আরেকটু উন্নতি চাই, ডি বক্সের ভেতরে জটলা পাকানো, সময় নষ্ট করা এসব কমাতে হবে। জেসুস-নেইমার আরেকটু জমে বসলেই সেটা সম্ভব, হয়তো সামনের ম্যাচেই সেটা দেখতে যাচ্ছি আমরা! গ্রান্দে ব্রাজিল।