“দীপু নাম্বার টু”কে মনে আছে?

0
দীপু নাম্বার টু ১৯৯৬

“দীপু নাম্বার টু”কে মনে আছে আপনার?। “অরুন সাহা”কে চেনেন? “অরুন সাহা” তার এই নাম কিংবা বর্তমান ছবিতে হয়তোবা তাকে চিনবে এমন মানুষের সং্খ্যাটা হয়তো অনেক অল্প। তবে তার ছোটবেলার জনপ্রিয় চরিত্রটা বললে ঘটবে উল্টোটাই, তাকে চিনে না এমন মানুষের সংখ্যাই হয়তো অল্পসংখ্যক। মুহম্মদ জাফর ইকবালের কিশোর উপন্যাস “দীপু নাম্বার টু” অবলম্বনে ১৯৯৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র “দীপু নাম্বার টু” খ্যাতিপ্রাপ্ত নামচরিত্র ‘দীপু’ অভিনীত ‘অরুণ সাহা’কে চিনেন না এমন মানুষের সংখ্যা খুবই অল্প, তবে দেশের কোটি জনগণের মনে জায়গা করে নেওয়া সেই ২৩ বছর আগের ছোট্ট দীপুকে পরবর্তীতে একটি বিজ্ঞাপন ছাড়া আর তেমন একটা দেখা যায়নি টিভির চিরচেনা পর্দায় কিন্তু কেনো? সে দীপুর গল্প নিয়েই এই লেখা।

 সময়টা ১৯৯৬ সাল, প্রতিদিনের মতোই নিজের বিদ্যালয়ের আঙ্গীনায় নোটিশ বোর্ডে একটি বিজ্ঞপ্তিতে চোখ পড়ে ১৩ বছর বয়সী অরুণের। যেখানে স্পষ্ট ভাষায় লেখা ছিল মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হতে চলেছে বাংলা চলচ্চিত্র “দীপু নাম্বার টু”। বাসায় ফিরে খবরের পাতা থেকে বড় বোনও জানালেন অডিশনের ব্যাপারে। সেন্ট জোসেফ হাই স্কুলের পরিচিত মুখ অরুণের অবশ্য অভিনেতা হিসেবে খ্যাতি পাবেন এমনটা হয়তো কখনো চিন্তা করেননি। দীপু নাম্বার টু উপন্যাসটি পড়ে চরিত্রের দীপু হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও তা চলচ্চিত্র জগতে সত্যি হবে এমনটা হয়তো ভাবেনি। ভাই বোন মিলে আগ্রহ উদ্দীপনার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মা কে জানাবেন। পরবর্তীতে রাজিও করিয়েই ছাড়লেন। মায়ের হাত ধরে অংশ নিলেন অডিশনে, নিজের ইচ্ছা আগ্রহ ইচ্ছা সবকিছুর ফলাফলটাও পেয়েছিলেন যখন শুনেছিলেন প্রধান চরিত্র “দীপু” চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগটা অরুণই পেয়েছিলেন। এর আগে কখনো অরুণের অভিনয়ে কাজ করা না হলেও পরিচালক মোরশেদুল ইসলামের সহায়তায় তা আয়ত্তে আসতে বেশি সময় লাগেনি।

এরপরে গল্পটা হয়ত অজানা নয়, দেড়বছরের শুটিং শেষে দেশজুড়ে মুক্তির পরবর্তীতে ঝড় উঠে প্রশংসার পাত্রে বনে গেলেন অসংখ্য মানুষের। “এখনো মনে পড়ে যে দিন ছবিটি মুক্তি পেল পাড়া মহল্লায় নিজেকে অন্যভাবে খুঁজে পাই। সবজায়গায় আমার ছবি! সারা দেশ হতে প্রতিনিয়ত মানুষের চিঠি আসতো বাসায়। বাড়ি চিত্রটাই যেন বদলে গিয়েছিলো মুহুর্তেই। সকালটা শুরু হতো মানুষের শুভেচ্ছা চিঠি পড়ে ” বলেন অরুণ। এমনটি হয়তো কল্পনাতেও কল্পনা করেননি। এর মাঝে দীপু নাম্বার টুয়ের সুবাদে আমন্ত্রিত হলেন জাপানের একটি চলচ্চিত্র উৎসবে যেখানে ফুঁজোয়া নামক সেই শহরের মেয়রের হাত থেকে পেলেন বিশেষ সম্মাননা।

দীপু নাম্বার টু ১৯৯৬ মুভি সিন dipu number 2 movie sean

খুবই অল্প সময়ে দেশজুড়ে আলোচিত দীপু নাম্বার টু’ মুক্তির দুই-তিন বছর পর শিশুশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান অরুণ সাহা। পুরষ্কার গ্রহণের সময়কার মুহূর্তের একটি প্রিয় মুহুর্ত মনে করতে চাইলেন অরুণ। অরুণ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার হাতে ট্রফি তুলে দেওয়ার পরপরই আমার গলায় মেডেল পরানোর সময় হঠাৎ মেডেলের ফিতা ছিঁড়ে যায়। ছেঁড়া ফিতায় গিট্টু লাগিয়ে আমার গলায় পরিয়ে দেন তিনি। মুহুর্তেই বেশ চমকে যায়”। নিজের জীবনের অন্যতম এই শ্রেষ্ট দিনটিতে প্রাপ্ত সেই ফিতাসহ মেডেল এখনোও যত্নে রেখেছেন বলেও জানান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই শিশুশিল্পী।

দীপু নাম্বার টু’ তে কাজ করার পর আর অভিনয়ের জগতে দেখা যায়নি অরুণকে। কেনো? এমন প্রশ্নের উত্তরটা অনেকটা হাসিমুখেই দিলেন “দীপু নাম্বার টু’ চলচ্চিত্রে কাজ করার পর বাসা থেকে পড়াশোনায় মনোযোগের প্রতি চাপটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, যদিও এর মাঝে আরো অনেক চলচ্চিত্রে কাজ করার আমন্ত্রণ জানানো হলেও পড়ালেখার কথা চিন্তা করে আর যাওয়া হয়নি।” অভিনয়ের জগতে অবশ্য কাজ করার ইচ্ছাটা ছিল না এমনটা বলা যাবে না!”আসলে বাসা থেকে সব বাদ দিয়ে পড়ালেখায় মনোনিবেশ করার কথায় মা-বাবাকে এই ব্যাপারে আর বলার সাহসটাই পায়নি” হাসির সাথেই উত্তর দিলেন অরুণ। পরে অবশ্য ইচ্ছাটা থাকলেও পড়ালেখার জন্য দেশের বাইরে চলে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

দেশের ইতিহাসের অন্যতম পরিচিত এই চলচ্চিত্রের ২৩ বছর পার হতে চলল। তবে মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়া সেই অভিনেতারা কেমন আছেন? প্রশ্নটি হয়তো এখনো খুঁজে বেড়ান কোটি দর্শক। আবুল খায়ের, বুলবুল আহমেদ, গোলাম মোস্তফা, ববিতা এদের মতো বাংলা চলচ্চিত্র কাঁপানো অভিনেতারাও এই চলচ্চিত্রের সাথে কাজ করেছেন। আবার এদের মধ্যেই অনেকেই এখন বেচেঁ নেই। “ব্যাপার গুলো মাঝে মাঝে আমাকে খুব কাদাঁয়। কঠিন সত্য হলো মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই আর আমাদের বয়সীদের মধ্যে একজন ছাড়া সবার সঙ্গেই পরিচয় আছে। নাটকে ‘নান্টু’ চরিত্রে অভিনীত হীরাকে অনেক খুঁজেও পাইনি, তাকে এখনো আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি এছাড়াও একসাথে কাজ করা পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম সহ অন্যান্য সবার সাথেই দেশে কমবেশি দেখা হয়” বলেন অরুণ।

দীপু নাম্বার টু ১৯৯৬ দীপু dipu number 2 real dipu face

এরই মাঝে ২০১৫ সালে দীর্ঘ ২০ বছর পর হঠাৎ শরাফ জীবনের পরিচালনায় একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখা গিয়েছিলো অরুণকে। এটির ব্যাপারে অরুন বলেন “দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে একটি অনুষ্ঠানে হঠাৎ শুভাশিস রায়ের (যে কিনা তারিক চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন) সাথে দেখা হয়ে যায়, তার মাধ্যমেই প্রায় ২০ বছর পর ওকাপিয়া নামক একটি মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপনে কাজ করি” এত দীর্ঘ সময় পেরিয়ে ক্যামেরার সামনে আসার ব্যাপারটাযে উপভোগ করেছিলেন তা বোঝাই যাচ্ছিলো অরুণের কথায়। অন্যদিকে, ২০ বছর পর সেই ছোট্ট দিপু কে আবার টিভির পর্দায় দেখার আগ্রহের কমতি ছিল না দর্শকদের মাঝেও। এরপরপরই চিন্তা করেছিলেন টিভির পর্দায় নিয়মিত হবার ব্যাপারে, যদিও নানান ব্যস্ততায় তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

টিভির পর্দায় নিয়মিত হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে নিজেকে আবার সকলের মাঝে তুলে ধরতে চান বলে জানান অরুণ। এরজন্য আগ্রহ এবং ইচ্ছা দুইটিই নিজের মধ্যে কাজ করছে বলেও জানান ৩৭ বছর বয়সী অরুণ সাহা। “আবার ক্যামেরার সামনে নিয়মিত হয়ে কাজ করতে চাই, সেই ইচ্ছাটা নিজেকে প্রত্যেকদিন তাড়া করে বেড়ালেও এখনো পর্যন্ত তা বাস্তবে রূপ দিতে কোনরকম পরিকল্পনা করা হয়ে উঠেনি তবে খুব শীঘ্রই আবার ক্যামেরার স্ক্রিনের বড় পর্দার সামনে ফিরে আসতে চাই।” যোগ করেন অরুণ। নিজের মধ্যে এখনো সেই ছোট্ট দীপুকে লালন করছেন বলেও বলেন অরুণ। তবে এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেশের বিজ্ঞাপন মান ব্যবস্থা এগিয়ে গেলেও এক্ষেত্রে চলচ্চিত্র পিছিয়ে আছে বলে ব্যাক্তিগতভাবে মনে করছেন অরুণ।

দীপু নাম্বার টু ১৯৯৬ দীপু dipu number 2 real dipu

যদিও সেই ছোট্ট দীপু আর ছোট্ট নেই, ঢাকা সেন্ট জোসেফ হাই স্কুল হতে এসএসসি নটরডেম কলেজ এইচএসসি অতঃপর বুয়েট হয়ে স্কলারশিপ নিয়ে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে পড়ালেখা শেষ করে চাকরিসূত্রে ভারত, জার্মানি, সংযুক্ত আরবসহ আরো বেশ কয়েক দেশে অবস্থান করে, বর্তমানে কানাডার ম্যানকোভার শহরে চাকরিসূত্রে অবস্থান করছেন করছেন অরুণ।

সব কিছুর পাশাপাশি তার একটি বিষয় হয়তো অনেকেরই অজানা। গানের প্রতি তার রয়েছে আলাদা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা। ছোটবেলায় বাবার মাধ্যমে রবীন্দ্রসঙ্গীত অপরদিকে বোনের মাধ্যমে হিন্দি সঙ্গীতের সঙ্গেই বেড়ে ওঠা, দুটোর উল্টোদিকে অরুণের আগ্রহটা জন্মেছিলো ইংলিশ গানে। যদিও তা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত, এরই মাঝে আগ্রহ বাড়ে ক্ল্যাসিকাল গিটারের প্রতি। ক্ল্যাসিকাল গিটারের পাশাপাশি বাজাতেন ট্রামপেটও। এরই মাঝে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে ২০১১ সালে যুক্ত হন ক্লাসিক্যাল মিউজিক একাডেমি অব ঢাকার সাথে। প্রতিষ্ঠানটির হয়ে গান পরিবেশনা করেছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এবং বিটিভির ‘ঐকতান’ এবং ‘চির শিল্পের বাড়ি’ নামক অনুষ্ঠানে। সে আগ্রহের জেরেই ২০১৫ সালে আয়ারল্যান্ডে এক বছর পড়াশোনা করেন গান নিয়েই।

সাক্ষাতকার কৌশিক (লেখকের অনুমতি রয়েছে) ভ্যাংকুভার,কানাডা