পাকিস্তান থেকে বিজয় অর্জনের ৪৬ বছর হলেও বাংলাদেশের তথা বাংলার পরাজয়ের সূচনাটা ইংরেজদের হাতে। পর্তুগিজ-ফ্রেঞ্চ-ইংরেজ, এই তিন জাতির বেণিয়ারাই চেয়েছিল লুটেপুটে এই উপমহাদেশকে খেতে। সফল হয়েছিল কেবল ইংরেজরা। সুবিশাল এই ভারতবর্ষকে ইংরেজরা বেশ কৌশলে শাসন করেছে। প্রধান শাসনকর্তার আগমন সরাসরি ব্রিটেন থেকে হলেও ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র এলাকাভিত্তিক শাসক হিসেবে তারা বেছে নিত স্থানীয়দেরকে। ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র সেইসব শাসকরা ইংরেজদের কেন্দ্রীয় শাসন মেনে নিজ-নিজ এলাকা পরিচালনা করতেন। একেক এলাকার শাসকরা একেক রকম নাম ধারণ করতেন। যার মধ্যে বহুল প্রচলিত উপাধি ছিল জমিদার। তবে, ঢাকার শাসকদেরকে বলা হত নবাব। ঢাকার ঐতিহাসিক স্থাপনা আহসান মঞ্জিলের নামকরণ হয়েছে যার নামে, চলুন জেনে নিই সেই নবাব খাজা আহসানুল্লাহ সম্পর্কে।
নবাব খাজা আহসানুল্লাহর জন্ম ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২২শে ডিসেম্বর। তার পিতা নবাব খাজা আব্দুল গণি ও মাতা ইসমতুন্নেসা। শৈশবে তিনি মাতৃভাষা বাংলা ছাড়াও আরবি, উর্দূ ও ফার্সি ভাষা শিক্ষালাভ করেন। খাজা আহসানুল্লাহ বাল্যকালেই কোরআনে হাফেজ হন। ২২ বছর বয়সে তিনি তার পারিবারিক সম্পত্তির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
নবাব খাজা আহসানুল্লাহ ছিলেন প্রথমে খান বাহাদুর, পরে কেসিআইই ব্রিটিশ ভারতের ঢাকার নবাব। পর্যায়ক্রমে তিনি বিভিন্ন পদে উন্নীত হন। ১৮৭১ সালে খান বাহাদুর, ১৮৭৫ সালে নবাব, ১৮৯১ সালে সিআইই, ১৮৯২ সালে নবাব বাহাদুর ও ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে কেসিআইই উপাধি লাভ করেন। তিনি ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে প্রথমবার এবং ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয়বার ব্রিটিশ বড়লাটের আইনসভার সদস্য মনোনীত হয়েছিলেন। তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি মুসলিম রাজনৈতিক ধারার সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
খাজা আহসানুল্লাহ ছিলেন উর্দূভাষার একজন কবি ও সাহিত্যিক। এছাড়াও একাধারে গীতিকার, নাট্যকার ও কণ্ঠশিল্পী ছিলেন। তিনি বেশ কিছু ঠুমরী ঢংয়ের গীত রচনা করেন। তাঁর রচিত উর্দূ নাটকগুলো নবাববাড়িতে মঞ্চস্থ হত। তিনি উর্দু ও ফার্সি ভাষায় কবিতা রচনা করতেন। খাজা আহসানুল্লাহ কবিতা লিখতেন ছদ্মনামে। তার কবিনাম ছিল ‘শাহীন।’ যার অর্থ রাজকীয় পাখি।
কুল্লিয়াতে শাহীন নামে তাঁর উর্দু-ফার্সি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। তার নির্দেশনায় ঢাকা থেকে ১৮৮৪ সালে আহসানুল কাসাস নামে একটি উর্দূ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তিনি নিয়মিত রোজনামচা লিখতেন। তাঁর লেখা তারিখে খান্দানে কাশ্মীরিয়াহ (কাশ্মীরি বংশের ইতিহাস)-এর অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। শৌখিন ফটোগ্রাফার হিসেবে কলকাতার ফটোগ্রাফি সোসাইটিরও সদস্য হয়েছিলেন।
নবাব খাজা আহসানুল্লাহ একজন দানবীর নবাব ছিলেন। সম্পদশালী যেমন ছিলেন, তেমনি জনগণের কল্যাণে সেই সম্পদ ব্যয় করেছেন অকুণ্ঠচিত্তে। পরবর্তীতে হিসেব করে দেখা গেছে, বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে অন্তত: তখনকার মূল্যে ৫০ লক্ষাধিক টাকা তিনি দান করেছিলেন। উদাহরণত তার দানের কিছু ক্ষেত্র ও পরিমাণ উল্লেখ করা হচ্ছে। যেমন, ঢাকার হোসেনী দালান পুনর্নির্মাণে এক লক্ষ টাকা, ঢাকায় মহামারী আকারে ছড়ানো প্লেগ নিবারণে এক লক্ষ টাকা (১৮৯৮খ্রি:), কুমিল্লা শহর উন্নয়নে (১৮৯৮) ৮০ হাজার টাকা, বড়লাটের দুর্ভিক্ষ তহবিলে ৫০ হাজার টাকা, মিটফোর্ড হাসপাতালে বিভিন্ন সময়ে দান প্রায় এক লক্ষ টাকা, ঢাকায় লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতাল নির্মাণে (১৮৮৮ খ্রি:) ৫০ হাজার টাকা ইত্যাদি।
এছাড়া প্রতিবছর ৩০-৪০ জন দরিদ্র মুসলমানের হজে যাওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যয় তিনি বহন করতেন। পবিত্র মক্কায় নহরে জুবায়দা নামে খাল সংস্কারে তিনি ৬০ হাজার টাকা দান করেছিলেন । এছাড়াও খাজা আহসানুল্লাহ ঢাকার সার্ভে স্কুলটিকে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে উন্নীত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্বার্থে এক লক্ষ ১২ হাজার টাকা প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় তা সম্ভব হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র নবাব সলিমুল্লাহ ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। সেই সার্ভে স্কুলটিই বর্তমানে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েট।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর ঢাকা শহরে প্রথম বৈদ্যুতিক বাতির ব্যবস্থা করা হয়। এই ব্যাপারে তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। কেবল তাই নয়, এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নের স্বার্থে তিনি সাড়ে চার লক্ষ টাকা দান করেছিলেন। তিনি ১৮৯৯ সালে ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রতিষ্ঠায় পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছেন। কলকাতার সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন ও এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ঢাকায় তিনি মোহামেডান লিটারারি সোসাইটির শাখা প্রতিষ্ঠা করেন।
নবাব খাজা আহসানুল্লাহ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। বেগমবাজারে পারিবারিক গোরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। তাঁর নামে পুরান ঢাকার একটি রাস্তা, বিখ্যাত আহসান মঞ্জিল এবং বুয়েটে একটি ছাত্রাবাস রয়েছে।
ঢাকার জনগণের শিক্ষাদীক্ষা ও সার্বিক উন্নয়নের পিছনে যাদের অবদান উল্লেখযোগ্য, খাজা আহসানুল্লাহ তাদের অন্যতম। দুঃখজনকভাবে আমরা অনেকেই এইসব ব্যক্তিদের কথা জানিনা। নিজেদের অস্তিত্বকে সম্মান জানাতেই এইসব ইতিহাস আমাদের জানা জরুরী।
তথ্যসূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া
লেখকঃ মাহমুদ সিদ্দিকী