নরেন্দ্র মোদির যোগসাজশে ভারতের ব্যাংক আমানতের টাকা লুট

0
নীরব মোদি ও মেহুল চোকসি

ভারতের ব্যাংক আমানতের টাকা লুট করে পালিয়ে যাওয়া নীরব মোদি ও মেহুল চোকসির পুকুর চুরিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যোগসাজশ ক্রমশ দিনের আলোর মতো ফুটে উঠছে। তথ্য-প্রমাণ হাজির করে বিরোধী শিবির বলছে, এই জালিয়াতি ও ষড়যন্ত্র প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ মদদ ছাড়া হতেই পারে না। বিজেপি যতই প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক না কেন, একেবারে প্রত্যক্ষ প্রমাণ হাতে এসে পড়ায় আপাতত ব্যাকফুটে মোদি। টুইটারে খই ফোটাতে ভালোবাসেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু গত কয়েকদিন নীরব কেলেঙ্কারির ব্যাপারে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। কিন্তু কেন? আসলে তথ্য-প্রমাণ এতটাই মজবুত যে, মুখ খুললেই বিশবাঁও জলে পড়ে যাবেন মোদি-শাহ জুটি। জানা যাবে, কীভাবে বিজেপির শীর্ষ মহলের যোগসাজশে চক্রান্ত করে ব্যাংক লাটে পাঠিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ছক কষা হয়েছিল।
নীরব মোদি ও মেহুল চোকসি
এ পর্যন্ত যে তথ্য-প্রমাণ হাজির করা হয়েছে তাতে একেবারে স্পষ্ট মেহুল চোকসিকে নরেন্দ্র মোদি খুব ভালো করেই চিনতেন। তাকে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণও করেছিলেন। ২০১৫ সালের একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নিবাসে সোনা জমা প্রকল্প ঘোষণা করছেন নরেন্দ্র মোদি। মঞ্চে রয়েছেন রঘুরাম রাজন, নির্মলা সীতারামন, জয়ন্ত সিনহা, হাসমুখ আধিয়া, অরুণ জেটলি প্রমুখ। স্নেহভরা গলায় মোদি বলছেন, আমাদের মেহুলভাই এখানে বসে। আসলে সেদিন একেবারে সামনের সারিতেই বসেছিলেন প্রতারক সংস্থা গীতাঞ্জলির কর্ণধার তথা নীরব মোদির মামা মেহুল চৌকসি। এই ভিডিও সামনে আসার পর কংগ্রেস সভাপতি তার টুইট বার্তায় স্পষ্ট অভিযোগ করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর যোগসাজশেই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন নীরব-মেহুল। যেভাবে ললিত মোদি ও বিজয় মালিয়া এই আমলে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা ঝেড়ে পালিয়েছিলেন, ঠিক সেই কায়দাতেই এরা পালিয়েছেন। কেলেঙ্কারির কথা জানা থাকলেও সরকার তাদের আটকানোর চেষ্টা তো করেইনি; উল্টো তাদের পালানোর পথ করে দিয়েছে।

গোটা বিষয়টি ধামাচাপা দিতে বিজেপি আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদকে সামনে এগিয়ে দিয়েছিল। তিনি গত কয়েকদিন ধরে এমন একটা ভান করছেন, যেন মেহুল চৌকসি নামটি আগে কোনো দিন শোনেননি। নীরব মোদি সম্পর্কেও তার নাকি কোনো ধারণা নেই। তার মন্তব্য, ‘মেহুল চোকসি?… এটাই নাম না?’ এই ধরনের ভনিতার জবাব অবশ্য হাতেনাতে পেয়ে যান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মেহুলের উপস্থিতির ভিডিও তুলে ধরে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন, রবিশঙ্কর কি এই ব্যক্তিটিকে এবার চিনতে পারছেন? গোটা বিষয়টি নিয়ে টুইট বার্তায় রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ‘দুর্নীতিবাজদের পালানোর মন্ত্র-নমো (নরেন্দ্র মোদি)র দৌলতে লমো (ললিত মোদি) ও নিমোর (নীরব মোদির) ভেগে যাওয়া। মোদি ভারতকে লুট করছেন। কংগ্রেস বলছে, ২০১৫-এর মে মাস থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতর, ইডি, করপোরেট বিষয়ক মন্ত্রণালয়, এসএফআইও, সেবি, গুজরাট ও মহারাষ্ট্র সরকারের কাছে অনেকে এই দুর্নীতি নিয়ে নালিশ জানিয়েছেন। সব জেনেও প্রধানমন্ত্রী চুপ করে বসেছিলেন। বরং জানুয়ারির গোড়াতে তিনি নীরবে নীরবকে সাঙ্গপাঙ্গসহ পালাতে দিয়েছেন। দাভোস সম্মেলনে তাকে পাশে নিয়ে ছবিও তুলেছেন।

নরেন্দ্র মোদি বুক বাজিয়ে বলতেন, দুর্নীতির লেশমাত্র নেই তার সরকারের গায়ে। কিন্তু এই প্রচার যে আর ধোপে টিকবে না তা বিজেপি নেতৃত্ব বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। তাই পাল্টা কংগ্রেস আমলে এই নীরব মোদিরা কী সুবিধা পেয়েছিলেন সে প্রসঙ্গ নিয়ে সরব হওয়ার চেষ্টা করেছেন তারা। বিজেপির অভিযোগ, ২০১৩ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর নীরবের প্রদর্শনীতে রাহুল গান্ধী উপস্থিত ছিলেন। ঠিক তার পরদিনই এলাহাবাদ ব্যাংক থেকে ঋণমঞ্জুর হয়ে যায়। বিজেপির অভিযোগ, কংগ্রেস আমলেই এই দুর্নীতির সূত্রপাত। তখনই নীরবরা ফুলে-ফেঁপে ওঠেন। কিন্তু কংগ্রেসের বক্তব্য, ২০১৫ সাল থেকে দিগ্বিজয় সিং, বৈভব খুরানিয়া প্রমুখ কংগ্রেস নেতা নীরব মোদির প্রতারণার ব্যাপারে বারবার প্রধানমন্ত্রীর দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কংগ্রেসের দাবি ‘ছোট মোদি নিয়ে এবারে বড় মোদি মুখ খুলুন’। সন্দেহের তীর যে তার দিকেই।

এদিকে দাভোসে নীরব মোদিকে পাশে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ছবি তোলার ব্যাপারে সমালোচনার ঝড় ওঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরাসরি রাস্তায় নেমেছে। সুষমা স্বরাজের দফতর থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দাভোসে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নীরব মোদির কোনো বৈঠক হয়নি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রভিশ কুমার বলেছেন, শিল্পপতিদের প্রতিনিধি দলে নীরব মোদি ছিল না। কিন্তু সেখানে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থার সিইওরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছবি তুলতে চেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাদের অনুরোধে সাড়া দেন। প্রধানমন্ত্রী কেবল শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন, আর কিছু নয়।

নীরব মোদি ও মেহুল চোকসির পিএনবি কেলেঙ্কারিতে যত সময় যাচ্ছে ততই আরও বহু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের নাম জড়াচ্ছে। জানা যায়, ইউনিয়ন ব্যাংক নীরব মোদির লেটার অব আন্ডারটেকিংয়ের ভিত্তিতে এক হাজার ৯১৫ কোটি, স্টেট ব্যাংক ১৩৬ কোটি ও এলাহাবাদ ব্যাংক দুই হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এই লেটার অব আন্ডারটেকিং দিয়েছিল পাঞ্জাব নাশনাল ব্যাংক। স্টেট ব্যাংকের চেয়ারম্যান রজনীশ কুমার স্বীকার করেন, পিএনবির আন্ডারটেকিংয়ের ভিত্তিতে তারা নীরব মোদিকে ২১ কোটি মার্কিন ডলার দিয়েছেন।

ঋণ দিয়েছে, গত ১৬ জানুয়ারি নীরব মোদির গ্রুপের প্রতিনিধি মুম্বাইয়ের ব্র্যাডি হাউস শাখায় আমদানির জন্য ক্রেতা ঋণ চায়। ব্যাংক গোড়ায় তা দিতে রাজি হয়নি। তখন ওই প্রতিনিধি বলেন, আগে তারা এভাবে ঋণ পেয়েছেন। পরীক্ষা করতে গিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দেখেন লেটার অব আন্ডারটেকিংয়ের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। যদিও ২০১৬ সালের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর এই বেআইনি লেনদেনের ব্যাপারে অভিযোগ জানানো হয়েছিল। এলাহাবাদ ব্যাংকের সাবেক পরিচালক দীনেশ দুবে সংবাদ মাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, ২০১৩ সালে গীতাঞ্জলির বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করেছিলেন। তার পরেও ব্যাংক তাকে ঋণ দেয়। উল্টো এই নিয়ে প্রশ্ন তোলায় তাকে ইস্তফা দিতে বলা হয়। দুবের অভিযোগ, বিজেপির চোখের সামনে এসব দুর্নীতি ঘটেছে। আগের আমলের চেয়ে এক ধাক্কায় ৫০ গুণ বেড়ে গেছে দুর্নীতির বহর।

এদিকে পিএনবি বলেছে, লেটার অব আন্ডারটেকিংয়ের মারফত তাদের নাম করে যে টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে তারা তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ফিরিয়ে দেবে। ব্যাংকের নিজস্ব তহবিল থেকেই এ টাকা ফেরত দেওয়া হবে। বাড়তি মূলধন জোগানোর প্রয়োজন নেই। ব্যাংক জানিয়েছে, পরিচালনায় ত্রুটির কারণেই পিএনবিতে প্রতারণা হয়েছে।

ব্যাংকের দু-একজন কর্মীর জন্যই এটা হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য বৈঠকে বসেছে ইন্ডিয়ান ব্যাংকস অ্যাসোসিয়েশন আইবিএ। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ওই সংগঠনের চেয়ারপারসন উষা অনন্ত সুব্রহ্মণ্যম আগে পিএনবির এমডি ছিলেন। বর্তমানে তিনি এলাহাবাদ ব্যাংকের এমডি সিইও। পিএনবির হিসাব পরীক্ষার ব্যাপারে অডিটরদের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস। মেহুল চোকসির সংস্থা গীতাঞ্জলি জেমস শেয়ারবাজারে নথিভুক্ত। নীরব মোদি ও মেহুল চোকসির যেসব অন্য সংস্থা শেয়ারবাজারের সঙ্গে যুক্ত তাদের কোম্পানি অ্যাকাউন্টও খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছে শেয়ার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি।