“আমি মারা গেলে তুমি যদি এমন একটা তাজমহল বানাতে পারতে তাহলে আমি এখনই মারা যেতাম।”
তাজমহল নিয়ে মুগ্ধতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটেছে এক নারীর কথায়। প্রেমিকের সাথে তাজমহলে বেড়াতে গিয়ে তাজমহলের অপার সৌন্দর্য্য দেখে ঐ নারী নাকি তার প্রেমিককে একথা বলেছিলেন।স্ত্রী মমতাজ মহলের অকাল মৃত্যুতে মুঘল সম্রাট শাহজাহানের দিলে খুব আঘাত লাগে। সেই ভেঙ্গে পড়া দিল নিয়ে তিনি স্ত্রীর কবরের উপর একটা সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন। এটাই তাজমহল।
তাজমহলের নির্মান শুরু হয় ১৬৩২ সালে; মমতাজের মৃত্যুর এক বছর পর। ২০ হাজারের বেশি শ্রমিকের প্রচেষ্টায় ১৬৪৮ সালে, মমতাজের মৃত্যুর ১৭ বছর পর গম্বুজ গুলোর নির্মান কাজ শেষ হয়; যদিও পুরো কাজ শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। শুধু মানুষ নয়; এ মহান কীর্তির ভাগিদার ১০০০ হাতী, যারা নির্মাণের জন্য মার্বেল পাথর পরিবহনে নিয়োজিত ছিল। তাজমহল নির্মাণের ১১ বছর পর শায়েস্তা খাঁ সুবেদার হয়ে বাংলায় আসেন। শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় কত মণ চাল পাওয়া যেতো ৮ মণ। অর্থাৎ তখন ১ মণ চালের দাম ছিল সাড়ে ১২ পয়সা বা .১২৫ টাকা। আর বর্তমানে ১ মণ চালের সর্বনিম্ন মূল্য কত? সম্ভবত: ৯০০ থেকে ১,০০০ টাকার মধ্যে হবে। ধরে নিলাম, ৯০০ টাকা। এখন ৯০০ কে .১২৫ দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল হবে, ৭,২০০। এর মানে তখনকার চেয়ে এখন দাম বেড়েছে ৭,২০০ গুন বেশি। তাহলে তাজমহলের জন্য ব্যয়কৃত অর্থের পরিমান বর্তমানে দাঁড়াবে ৩২ মিলিয়ন x ৭,২০০ রুপি বা ২৩,০৪০ কোটি রুপিতে যা ২৮,৩১৪ কোটি টাকার সমান।এ পুরো টাকাটাই ছিল সাধারণ মানুষের রক্ত চুষে আদায় করা খাজনা। শাহ্জাহান এ টাকাই ব্যয় করেছেন নিজের মৃত স্ত্রীর কবরের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের মতো ব্যক্তিগত অভিলাষ পূরণে।
কিন্ত এসময়ে এসে একটা হিসাব করলে দেখা যাবে, তাজমহল থেকে ভারত সরকার যে আয় করেছে তারকাছে ব্যয় কিছুইনা। এটা ভারতের একটা স্থায়ী আয়ে পরিনত হয়েছে। তাজমহলের সাথে প্রত্যক্ষ পরক্ষভাবে জীবন জীবিকা জড়িয়ে আছে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষের।মুঘল আমলের আশ্চর্য শিল্পকলা দেখতে আগ্রায় প্রতি বছর গড়ে ৬০ লক্ষ আন্তর্জাতিক পর্যটকের ভিড় হয়। প্রতিবছর পর্যটন মরশুমে ভারতে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসেন তাজমহলে৷দেশের রাজকোষে সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা পড়ে তাজমহল থেকেই৷ সর খাত বাদদিয়ে শুধু টিকিট বিক্রি থেকে ভারত প্রতিবছর আয় করে ২৫ কোটি রূপী।
তাজমহল যে জমির ওপর দাঁড়িয়ে, সেই জমি ছিল অত্যন্ত নীচু । প্রচুর মাটি ফেলে সেই জমি কে যমুনা নদীর তীরের উচ্চতা থেকে প্রায় ৫০ মিটার [১৬০ ফুট] উচু করা হয়। ঠিক এখনকার earthquake proof বহুতলের column নির্মাণের মতো্ই সেখানে অনেকগুলি পাতকুয়া খোঁড়া হয় ও তারপর সেগুলি পাথর,বালি ও মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়। তাজমহলের এই ভিতটি ভূমিকম্প বা প্রবল প্রাকৃতিক বিপর্যয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না । ওই ভরাট-করা পাতকুয়াগুলির ওপর এক বিশাল মঞ্চ তৈরী করে তার ওপর সৌধের র্নিমাণকাজ সম্পন্ন করা হয়। এখনকার বাড়ি তৈরী করতে হলে বাঁশের তৈরী ভারা লাগে । তাজমহল নির্মাণের জন্যে যে ভারা তৈরী করা হয় তাও এক আশ্চর্য নজির । প্রকান্ড এক ইঁটের তৈরী ভারা বানানো হয়েছিল তাজমহলের ওপরের কাজের জন্যে । সেই ভারা এতটাই বড় ছিল যে রাজমিস্ত্রিরা জানায় ভারা ভাঙতে তাদের কযেক বছর সময় লেগে যাবে । তখন শাহজাহান র্নিদেশ দেন এই ভারার ইঁট যে কেউ নিয়ে যেতে পারে একেবারে বিনামূল্যে । রাতারাতি সেই প্রকান্ড ভারা অদৃশ্য হয়ে যায়।রাজ্যের হাজার হাজার গরিব কৃষক সেই ভারার ইঁট খুলে নিয়ে যায় তাদের নিজেদের গৃহ নির্মানের জন্যে।
তাজমহলের প্রধান নকশাকার ছিলেন ওস্তাদ আহমেদ লাহুরি আরও ছিলেন আবদুল করিম মামুর খান এবং মাকরামাত খান যারা সে সময়ের সবচেয়ে নিখুঁত, পারদর্শী ও উচ্চ পর্যায়ের প্রকৌশলী এবং নকশাকার ছিলেন। এছাড়া তাজমহলের বিখ্যাত ক্যালিওগ্রাফিগুলো করেছিলেন তৎকালের ক্যালিওগ্রাফার আবদুল হক, যার প্রশংসনীয় ক্যলিওগ্রাফি দেখে মুগ্ধ হয়ে সম্রাট নিজেই তাকে ‘আমানত খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। পুরো তাজমহল ১৮০ ফুট উঁচু যার প্রধান গম্বুজটি ২১৩ ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট চওড়া এবং এর চারপাশে চারটি মিনার আছে যার প্রতিটির উচ্চতা ১৬২.৫ ফুট। পুরো কমপ্লেক্সটির আকার ১৯০২X১০০২ ফুট। শুধু তাজমহলটি ১৮৬X১৮৬ ফুট মার্বেল পাথরের উপর নির্মিত। এর প্রধান প্রবেশদ্বার ১৫১X১১৭ ফুট চওড়া এবং ১০০ ফুট উঁচু। তাজমহল নির্মানের জন্য পাঞ্জাব থেকে আনা হয় স্বচ্ছ মার্বেল পাথর, চীন থেকে সবুজ পাথর, তিব্বত থেকে স্বচ্ছ ও নীল পাথর এবং শ্রীলংকা থেকে নীলমনি। তাছাড়া ভারত, পাকিস্তান, পারস্য ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২৮ রকমের মূল্যবান পাথর দিয়ে তৈরি করা হয় এই অনন্য স্থাপত্য।
তাজমহলের গম্বুজগুলো হল অন্যতম মনোমুগ্ধকর বস্তু।গম্বুজের সাদা মার্বেল গুলো সূযোর্দয়ের সময় গোলাপি আভা ছড়ায়। গোধুলিতে অপসৃয়মান সূর্যের বিভিন্ন রঙের আলো প্রতিফলন করে। আর রাতের বেলা পূর্ণিমার আলোয় গম্বুজগুলো যেন মুক্তোর মত চকচক করে। ভরা পূর্ণিমার ভালবাসার এ মহাস্থাপনা সোনালি আর নীল আলোয় লুকোচুরি খেলে। আর কুয়াশা মাখা দিনে ভালবাসার এ স্তম্ভ যেন মেঘের গায়ে ভেসে বেড়ায়। প্রচলিত আছে, গম্বুজগুলো থেকে যে রঙ-বেরঙের আলোর ছটা বিচ্ছুরিত হয় তা নারীর আবেগ ও অনুভুতিকেই প্রকাশ করে। যদি আপনার প্রিয়জনকে নিয়ে তাজমহল ভ্রমণ করতে চান তাহলে পূর্ণিমার রাতে তাজমহল দর্শন করতে ভুলবেন না। রাতের জোছনা মাখা তাজমহলের রূপ, সোনায় মোড়ানো গম্বুজ আর সবুজ চাদরের লনের তুলনা এ ধরিত্রীর কারো সাথে সম্ভব নয়।
এদিকে ভারতে বিশ্বখ্যাত ঐতিহাসিক তাজমহল চত্বরে জুমা নামাজ বন্ধ করার দাবি জানায় আরএসএসের ইতিহাস শাখা ‘অখিল ভারতীয় ইতিহাস সংকলন সমিতি। সংগঠনটির জাতীয় সম্পাদক বালমুকুন্দ পাণ্ডের দাবি, নামাজ পড়া যদি বন্ধ করা না হলে সেখানে হিন্দুদের শিব চালিশা পাঠ করতে দিতে হবে। তিনি বলেন, তাজমহল জাতীয় সম্পত্তি। সেখানে মুসলমানদের ধর্মীয় স্থান হিসেবে ব্যবহার করতে দেয়া হবে কেন? তাদের সংগঠন সমস্ত প্রাচীন স্থাপনার তালিকা তৈরি করছে যেসব স্থাপনা মুসলিম শাসকরা ভেঙে মসজিদ অথবা অন্য কোনো ভবন নির্মাণ করেছিল।
তাজমহলের ইতিহাস নতুন করে লেখার দাবি ভিনয় কাটিয়ারই যে প্রথম জানিয়েছেন তা নয়। এর আগে ডানপন্থী ইতিহাসবিদ পিএন ওক ১৯৮৯ সালে প্রকাশ করা ‘তাজমহল: দ্য ট্রু স্টোরি’ বইতে এই সৌধকে ‘তেজো মহল’ বলে দাবি করেন। বইতে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে এটি ছিল আদতে একটি হিন্দু মন্দির এবং একজন রাজপুত শাসক এটি তৈরি করেন। সম্রাট শাহজাহান এটি দখল করে সেটিকে পরে তাজমহল নাম দিয়েছেন। ওকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করা লেখক সচ্চিনানন্দ শেভডে বলেন, সরকারের উচিত ‘প্রকৃত সত্য’ উন্মোচনের জন্য একটি দল নিয়োগ করা। তাজমহল কোনো মুসলিম স্থাপত্য নয়। এটি আসলে একটি হিন্দু স্থাপত্য। মিস্টার কাটিয়ার ও মিস্টার শেভডে উভয়েই যুক্তি দিয়েছেন যে তাজমহলের স্থাপত্যে অনেক হিন্দু স্থাপত্যের ছাপ রয়েছে। তাদের মতে, তাজমহলের শীর্ষে একটি অর্ধাকৃতি চাঁদ আছে। ইসলামিক স্থাপত্যে এই চাঁদটি সাধারণত বাঁকা থাকে। কিন্তু তাজমহলের চাঁদ বাঁকা নয়। এই চাঁদ আসলে হিন্দু দেবতা শিবের সঙ্গে সম্পর্কিত। এছাড়া এই সৌধ চূড়ায় একটি কলসও আছে। সেখানে আমের পাতা ও উল্টে রাখা নারকেলও আছে। এগুলো হিন্দু প্রতীক। ইসলামী সংস্কৃতিতে ফুল, পশুর প্রতিকৃতি নিষিদ্ধ। কিন্তু তারপরও তাজমহলে এসব ব্যবহার করা হয়েছে।
কিন্তু ভিনয়ের এই দাবির পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য কোনো প্রমাণ নেই। বরঞ্চ ইতিহাসবিদদের বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, এমনকি ভারত সরকার পর্যন্ত মনে করেন, এই সৌধ ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের এক চমৎকার নিদর্শন। ভারতের সরকারিভাবে সংরক্ষিত ইতিহাস অনুযায়ী, মোগল সম্রাট শাহজাহান তাজমহল তৈরি করেছিলেন তার মৃত স্ত্রী মমতাজ মহলের স্মরণে। ভারতের মোগল শাসকেরা এসেছিল মধ্য এশিয়া থেকে। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকে তারা ভারত শাসন করে। মোগল শাসনামলে দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতবর্ষ জুড়ে ইসলামি শিল্পকলা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ব্যাপারে মোগলদের যে অনুরাগ, তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন বলে গণ্য করা হয় তাজমহলকে।ভারতের প্রততত্ত্ব জরিপ বিভাগ তাজমহলকে বর্ণনা করেছে ‘মোগল স্থাপত্যকলার চূড়ান্ত নিদর্শন’ হিসেবে। আর তাজমহল নিয়ে ভারত সরকারের যে ওয়েবসাইট আছে, তাতে বলা হচ্ছে, ‘ইসলামি স্থাপত্যকলার সঙ্গে ভারতের স্থানীয় স্থাপত্যকলার সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সে সময়ের স্থাপত্যরীতির সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উদাহরণ এটি’।এতে আরো বলা হয়, মোগলরা যখন তাজমহলের নির্মাণকাজ শেষ করে, তখনো তারা তাদের পারস্য এবং তুর্কি-মোঙ্গল শেকড় নিয়ে গর্ব অনুভব করে। কিন্তু তত দিনে তারা একই সাথে নিজেদের ভারতীয় বলেও ভাবতে শুরু করেছে।
তর্ক-বিতর্ক যতই থাকুন তবু তাজমহল মুঘল মুসলিম স্থাপত্য কীর্তিগুলোর মধ্যে গৌরবান্বিত অলঙ্কার, একটি অনন্য কীর্তি। সপ্তাশ্চর্যের এক আশ্চর্য। ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীগুলো শুধু বিতর্ক নিয়ে সরব। এরকম একটি গোষ্ঠী এমন দাবি তুলেছে যে, তাজমহলে হিন্দুদের পুজা করতে দিতে হবে।
সম্রাট শাহজাহানের শেষ পরিনতি কি হয়েছিল?
তার সমাধি কোথায়?
কে বন্দী করেছিল শাহজাহান কে?
বন্দি জীবনে কে ছিল শাহজাহানের সঙ্গী?
পুত্রদের উত্তরাধিকার সূত্রে দ্বন্দ্ব কি ছিলো ?
চলবে ………
(পরবর্তী পর্ব পেতে পেইজে লাইক দিয়ে পাশে থাকুন)
পর্ব-১ লিংকঃ শাহজাহান-মমতাজ প্রেম, বিতর্ক এবং তাজমহল নিয়ে সাম্প্রতিক ষড়যন্ত্র
পর্ব-৩ লিংকঃ মৃত্যুর আগে কেন তাজমহলের কাছে যেতে পারেননি সম্রাট শাহজাহান?
লেখকঃ সাইফুল ইসলাম