বাংলাদেশে এগ্রোটেকের বৃহৎ পরিবর্তনের সূচনা ফসল.কমের হাত ধরে

0
বাংলাদেশে এগ্রোটেকের বৃহৎ পরিবর্তনের সূচনা ফসল.কমের হাত ধরে

মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ। ফসল.কমের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও চিফ অপারেটিং অফিসার। ২০১৮ সাল থেকে যাত্রা শুরু ফসল.কম এর। সম্প্রতি মামুনুর রশিদ উদ্যোগতা জীবনের নানান অভিজ্ঞতা ও বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন নিউজইনসাইড২৪.কমের এর সাথে। তার সাক্ষাতকার নিয়েছেন ইসমাইল উদ্দীন সাকিব।

শুরুটা কবে?

২০১৮ সাল থেকে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা সাকিব হোসাইনের নিবিড় গবেষনার অধ্যায় পার করে ২০২০ সালে আমরা ফসল.কম নিয়ে প্রকাশ্যে আসি।

এতকিছু থাকতে fashol.com এর ধারণা মাথায় এলো কিভাবে?

একটি সুন্দর প্রশ্ন। আপনারা অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেছেন, পৃথিবীর যত বড় বড় স্টার্ট-আপ কোম্পানি রয়েছে, কোন একটা সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যেই এর বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আমরদেরও একটা সমস্যা থেকেই ‘ফসল’ এর ধারণা মাথায় আসে। সমস্যাটা হলো কৃষকের ন্যায্য দাম না পাওয়া। কৃষিপ্রধান এদেশে আমরা প্রায়ই একটি সমস্যা দেখি। কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া। ধরেন, যে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় ৫০ টাকা, সেখানে কখন কখন কৃষক পায় ৫ টাকা। অনেক সময় ৫ টাকাও না পেয়ে অসহায় কৃষকেরা পণ্য ক্ষেতেই ফেলে রাখে বা রাস্তার পাশে ফেলে দেয়। তখন কৃষকের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, দামটা সে কেন পাচ্ছেনা এ নিয়ে। অন্যদিকে আমরা সাধারণ ক্রেতাদের ঠিকই সেই পণ্য কিনতে হচ্ছে ৫০-৭০ টাকা দামে। এটা বাংলাদেশের অনেক বড় একটি সমস্যা। এর কারণ নিয়ে আমরা গবেষণা করে দেখলাম, প্রথাগত ব্যবস্থা থেকে সরে এসে উদ্ভাবনী কিছু করার মানসিকতা আমাদের মাঝে প্রায় নেই বললেই চলে। তখনই আমাদের মাঝে ধারণাটা আসে। এরপর আমরা এর কার্যকারিতা, আমাদের দেশে এই উদ্যোগটি টিকে থাকতে পারবে কিনা, কতটুকু ফলপ্রসূ হবে ইত্যাদি যাচাই করে আমরা ‘ফসল’ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সংক্ষেপে বললে, ডিজিটাল উপায়ে কৃষক ও ক্রেতা উভয়ই যাতে সঠিকভাবে মূল্যায়িত হয়, সেই লক্ষ্যেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়।

শুরুতে চ্যালেন্জগুলো কি ছিলো?

চিন্তা করে দেখুন স্বাধীনতার এত বছর পরেও আমাদের এতবড় সমস্যার সমাধানে কেন কেউ কোন উদ্যোগ নেয়নি। অনেক সেক্টরেই অনেক কোম্পানি হয়েছে। যেমন রাইড শেয়ারিং, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি। কিন্তু কৃষিতে এখনো নতুন কিছু দেখা যায়নি কেন? এর কারণই হচ্ছে চ্যালেন্জ।
এই সেক্টরে এত বেশি পরিমাণে চ্যালেন্জ রয়েছে যে, কেউ কোন উদ্যোগ নিলেও ভয় পেয়ে পিছু হটে যান। আমাদেরও অসংখ্য চ্যালেন্জ মোকাবিলা করেই এপর্যায়ে আসতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় চ্যালেন্জ হলো চ্যালেন্জকে চ্যালেন্জ জানানো। অসংখ্য চ্যালেন্জকে মোকাবিলা করার মানসিকতা নিয়ে কাজ শুরু করাই আমাদের জন্য বড় চ্যালেন্জ ছিল। এজন্য নতুন চ্যালেন্জ মোকাবিলার মানসিকতা দরকার।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়,আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন সৃজনশীল। একজন শিক্ষার্থী সারাবছর একটি নির্দিষ্ট সিলেবাস পড়ে, এরপর বইয়ের আলোকে তাকে সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এই উত্তরগুলো সে কিন্তু পড়ে আসেনি, তার পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানের আলোকে পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ের ভিতর তাকে উত্তর তৈরী করতে
আমাদের এই সেক্টরটাও এমন। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন সমস্যা তৈরী হয়, যার জন্য আমরা তৈরী থাকিনা। কিন্তু পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করি।

fashol.com

একইভাবে, প্রত্যেকটা কোম্পানি যখন গবেষণা করে তখন সে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো খুজে বের করে, তালিকা করে এর সম্ভাব্য সমাধানও ঠিক করে। কিন্তু কৃষি সেক্টরে আমরা অগণিত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিনিয়তই। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০০ উপরে বাধার মোকাবিলা করেছি, তবে এটাও বলা মুসকিল যে আরো কতবেশি বাধা সামনে রয়েছে। অর্থাৎ সমস্যা দেখে ঘাবড়ে না গিয়ে সমাধানের চেষ্টা করে, এমন মানসিকতা দরকার।

কারণ আমরা এমন একটি পণ্যে নিয়ে কাজ করি, যার কিছুক্ষণ পরপর রং পরিবর্তন হয়, মান পরিবর্তন হয়। অনেক সময় ক্রেতাদের ‘কাস্টমাইজ’ চাহিদা মেটাবার মত অবস্থা থাকে না। এধরণের সমস্যারও সমাধান আমাদের করতে হয়েছে।
যেমন, কারখানায় পণ্য তৈরী হলে তার একটি নির্দিষ্ট রং ও আকৃতি চাইলেই দেওয়া যায়। কিন্তু মাঠে যে ফসল ফলে, তার ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। এর নির্দিষ্ট কোন আকার আসলে প্রত্যাশা করা যায়না।
অনেক সময় ক্রেতারা দাবি করেন যে তাদের একটা নির্দিষ্ট আকারের বা রংয়ের সবজি লাগবে, যেটা হয়তো বাংলাদেশে তখন কোথাও পাওয়াও যায়না।
এখন পর্যন্ত ‘কাস্টমাইজ’ সমস্যারই সবচেয়ে বেশি মুখোমুখি হয়েছি।

মানুষ fashol.com এ কেন আসবে? এর বিশেষ কিছু কারণ জানতে চাই।

মানুষের যে কাস্টমাইজ পণ্যের চাহিদা, সেই চাহিদাটা আমরা পূরণ করছি। ব্যবসায় নামার আগে আমরা যে দীর্ঘ পড়াশুনা ও গবেষণা করেছি বলেই আমরা এই চ্যালেন্জগুলো মোকাবিলা করতে পারছি। প্রাকৃতিক পণ্য হওয়া সত্ত্বেও আমরা যখন আপনার একান্ত প্রত্যাশিত পন্য আপনাকে দিচ্ছি, তখন আপনি অবশ্যই আমাদের কাছে আসবেন।

কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

আলহামদুলিল্লাহ, প্রত্যাশা মতোই সাড়া পাচ্ছি। আমাদের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা রয়েছে, সে অনুযায়ীই আমরা এগোচ্ছি। ক্রেতাদের প্রত্যাশামতো কাস্টমাইজ পণ্য দেয়ায় তারা অন্যদেরও ‘রেফার’ করছেন বা উদ্বুদ্ধ করছেন ‘ফসল’ থেকে পণ্য কিনতে। আশা করি সামনে আরে অনেক বেশি সাড়া পাবো।

সামনের পরিকল্পনা কি? fashol.com কে ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চান?

পরিকল্পনা একটিই। কৃষক এবং ভোক্তাশ্রেণি উভয়ের সঠিক মূল্যায়ন। এছাড়া আমরা একটি লক্ষ্যে আগাচ্ছি, প্রতি বছরের জন্যই আমাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও রয়েছে। আগামী ১৫ বছর পর কৃষিতে কি করতে চাই, এই সেক্টরে বাংলাদেশ বিশ্বকে কতটুকু নেতৃত্ব দেবে সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি।
আমরা চেষ্টা করছি বাংলাদেশে এমন একটি পদ্ধতি তৈরী করতে, যেটা ব্যবহার করে আমরা প্রত্যেকেই উপকৃত হবো। পুরো পৃথিবীব্যাপি আমরা ‘ফসল’ কে নিয়ে যেতে চাই। এজন্য আমরা সকলের দোয়াপ্রার্থী।

তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ কি থাকবে?

তরুণদের জন্য আমার পরামর্শ হলো, প্রত্যেকটি দেশের আলাদা সংস্কৃতি রয়েছে। দেশের মানুষ কতটুকু দক্ষ তার উপরই কিন্তু দেশের উন্নতি নির্ভর করে। আমরা প্রত্যেকটি মানুষ দিনে সর্বোচ্চ ২৪ ঘন্টা সময় পায়। এই সময়টুকুতে আমরা কি করি?
যারা চাকুরি করে তাদের এখানে সময় ব্যয় করতে হয় প্রায় ৮ ঘন্টা, আমাদের প্রায় ৬ ঘন্টা ব্যয় করতে হয় ঘুমের জন্য। এছাড়া একটি গবেষনায় দেখা গেছে খাওয়া দাওয়া ও ব্যক্তিগত কাজে আরো আনুমানিক ২-৩ ঘন্টা ব্যয় হয়।

অর্থাৎ ২৪ ঘন্টার মধ্যে আমাদের হাতে অতিরিক্ত সময় থাকে ৭-৮ ঘন্টা। এসময়টুকু আমরা বাংলাদেশী তরুণরা কি করি? আমরা বেশিরভাগই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই না হয় সোশাল মিডিয়ায় অনর্থক সময় কাটায়। অপর দিকে কিছু সংখ্যক তরুণেরা ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নে এই অতিরিক্ত সময় টা ব্যয় করে।
একজন যদি এইসময়টুকু প্রতিদিন অল্প কিছু শিখে, নেটওয়ার্কিং করে ব্যয় করে আর অন্যজন যদি অনর্থক সোশাল মিডিয়ায় (সোশাল মিডিয়াও কাজে লাগানো যায়, তবে কাজটি খুব কম লোকই করে) বা আড্ডা দিয়ে ব্যয় করে তাহলে একমাস বা একবছর পর কিন্তু এ দুই ব্যক্তির মধ্যে আকাশ-পাতাল একটি ব্যবধান সৃষ্টি হবে।

তরুণরা চাকুরি করে বা ব্যবসা করে কাজ শেষে হাতে যে অতিরিক্ত সময়টুকু পাওয়া যায়, সেটি ব্যক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। সময়টুকু কাজে লাগাতে হবে। আর এভাবেই কিন্তু দেশের আসল উন্নয়ন হবে।