সময়টা ১৬২ বছর আগের কথা, ১৮৫৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে জন্ম নিয়েছিল এক বিস্ময় বালক। সাত ভাইবোনের সঙ্গে বেড়ে ওঠা এই বালকের মনটা পড়ালেখায় না বসলেও ছিলেন প্রাণবন্ত। পাড়ার যে কোনো অনুষ্ঠানে কাউকে না পেলেও পাওয়া যেত তার উপস্থিতি। স্বেচ্ছাসেবী কাজের বেলায়ও ঘটনাটি একই, লেগে পড়তেন মনেপ্রাণে। পড়ালেখার গণ্ডি পেরিয়ে ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন একজন লেফটেন্যান্ট হিসেবে। দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাংলো-অ্যাশেনতি এবং বোয়ের যুদ্ধসহ বেশ কিছু ইতিহাস প্রসিদ্ধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৯০০ সালে উন্নীত হন মেজর জেনারেল পদে। ওপরের মানুষটি আর কেউ নন, বিশ্ব স্কাউটের জনক রবার্ট স্টিফেনসন স্মিথ লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল অব গিলওয়েল।
দেশে ফিরেই সামরিক জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থেকে, বিশেষ করে ম্যাফেকিংয়ের যুদ্ধ থেকে তিনি ধারণা পান উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বালকদের দিয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধান সম্ভব। স্কাউটের শুরুটা এখান থেকেই। ১৯০৭ সালে তিনি প্রথম স্কাউট ক্যাম্প স্থাপন করেন ব্রাউন সি দ্বীপে। ১৯০৮ সালে স্কাউটদের জন্য রচনা করেন ‘স্কাউটিং ফর বয়েজ নামক একটি বই। আনুষ্ঠানিকভাবে বয় স্কাউটের শুরুটাও তখন থেকেই। প্রথম ক্যাম্পিংয়ের পর তার খবর ছড়িয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। আগ্রহ আসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, বড় হতে থাকে এই আন্দোলন। সারাবিশ্বের বিভিন্ন কোনায় তৈরি হয়ে যায় স্কাউট শাখা। ১৯১০ সাল, সিদ্ধান্ত নিলেন স্কাউটকেই বেছে নেবেন নিজের প্রধান কাজ হিসেবে। ১৯২০ সালে পৃথিবীতে সব দেশের স্কাউটরা প্রথম আন্তর্জাতিক সমাবেশে প্রথম বিশ্ব জাম্বুরিতে লন্ডনে মিলিত হয়। ৬ আগস্ট এই জাম্বুরির শেষ সন্ধ্যায় হর্ষোৎফুল্ল বিরাট বালক জনতা ব্যাডেন পাওয়েলকে ঘোষণা করা হয় বিশ্বের প্রধান স্কাউটরূপে। অবিশ্বাস্যভাবে সারাবিশ্বে স্কাউটারের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় কয়েক লক্ষের বেশি। এই বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত কাব, রোভার, রেঞ্জার- এসব সংগঠন শুধু ভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েদের জন্যই ভিন্ন নাম। ইতিমধ্যেই প্রত্যেকটি দেশে রয়েছে এই সংগঠনের কার্যক্রম। এই সংগঠন শুধুই বিশ্বকে বদলায়নি, কোটি শিক্ষার্থীকে আগ্রহী করেছে স্বেচ্ছাসেবী কাজে, সমাজ বদলানোর কাজে। বর্তমানে বিশ্বের ১৫০-এর বেশি দেশ এই সংগঠনের আওতাভুক্ত। ১৯৪১ সালের ৮ জানুয়ারি ব্যাডেন পাওয়েল মৃত্যুবরণ করলেও তিনি এখনও আছেন কোটি জনগণের মাঝে।
বিশ্বব্যাপী জাদুর ছোঁয়া
জনপ্রিয় এই আন্তার্জাতিক সংগঠনের বয়স ১০০ বছরের বেশি। বর্তমানে সারাবিশ্বে পাঁচ কোটিরও বেশি মানুষ নিয়োজিত রয়েছে স্কাউটিংয়ে। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীদের স্বেচ্ছাসেবী কাজ, এমন ধারণাকেও এক নিমেষেই বদলে দিচ্ছে স্কাউট। স্কাউটের জাদুর ছোঁয়ায় বিশ্বে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো স্থানে ঘটেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কোটি কোটি শিশু, তরুণ নিজেদের পড়ালেখার পাশাপাশি বিনা পারিশ্রমিকে অন্যকে সহায়তার মন-মানসিকতা নিয়ে যোগ দিচ্ছে এই সংগঠনে।
বিশ্ব স্কাউটের অন্যতম প্রধান উদ্যোগ মেসেঞ্জার অব পিস, এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের স্কাউটরা কাজ করে ওই দেশের পরিবর্তন এবং শান্তি নিয়ে। বিশ্ব স্কাউটের সব সদস্য প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে এ উদ্যোগের কর্মসূচি পালন করে বিভিন্ন দেশের মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা করে থাকে। দুর্যোগ মোকাবেলা, সচেতনতা প্রচার, জনজীবনে পরিবর্তন, গ্রামীণ জীবন উন্নয়ন, নিরাপদ জীবনমান নিশ্চিত, স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত, পরিবেশ দূষণ মোকাবেলাসহ আরও অসংখ্য উদ্যোগে সারাবিশ্বে কাজ করে যাচ্ছে এই সংগঠন। এইসব কিছুর পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছে সারাবিশ্বের কোটি অসহায়দের পেছনে। সারাবিশ্বে সংগঠিত যে কোনো দুর্যোগে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সঙ্গে রয়েছে স্কাউটারদের উপস্থিতি।
অনেক দেশের এখনও প্রধান সমস্যার অন্যতম নিরাপদ পানি। অধিকাংশ মানুষ পান করছে অস্বাস্থ্যকর পানি। এই সমস্যা মোকাবেলায় অনেকটা এগিয়ে স্কাউটাররা। অন্যদিকে অজানা রোগে প্রতিদিন কয়েক লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, যার ফলাফলে স্কাউটাররা বৃদ্ধি করছে অধিক সচেতনতা। উদ্যোগ নিচ্ছে এসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সুস্থের বিষয়ে। অনাহারে জীবনযাপন করা শিশুর সংখ্যাও বিশ্বে কম নয়। স্কাউটের উদ্যোগের মাধ্যমে এদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য। প্রতিদিন বিশ্বের কোনো না কোনো অঞ্চলে দুর্যোগের মুখোমুখি অসহায় মানুষের কাছেও সাহায্য পৌঁছে দিচ্ছে স্কাউটাররা। শুধু তাই নয়, শিক্ষিত গোষ্ঠী গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিনামূল্যে পড়াচ্ছেন কয়েক লক্ষাধিক শিশুকে। শুধু বস্তুগত পরিবর্তন নয়, বদলে দিচ্ছে কোটি শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা। বিষণ্ণতার ভিড়ে আত্মনিয়োগ করছে সামাজিক কাজে, যার মাধ্যমে নিজের সৃজনশীল মনোভাবকে জাগ্রত করে দেশসেবায় প্রতিনিয়ত আত্মনিয়োগ হচ্ছে লাখো শিক্ষার্থী।
পরিবর্তনের ছোঁয়ায় আছে বাংলাতেও!
অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও উপস্থিত রয়েছে এই সংগঠন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালের ৮ এবং ৯ এপ্রিল সারাদেশের স্কাউটস নেতৃবৃন্দ ঢাকায় এক সভায় মিলিত হয়ে গঠন করেন বাংলাদেশ স্কাউট সমিতি। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৪ সালের ১ জুন বিশ্ব স্কাউট সংস্থা বাংলাদেশ স্কাউটস সমিতিকে ১০৫তম সদস্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ৫৬,৩২৫ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ স্কাউটসের অধীনে বর্তমানে প্রায় ১৭ লাখেরও বেশি স্কাউটার নিয়োজিত রয়েছে। বাংলাদেশ স্কাউটের গৃহীত উদ্যোগসমূহের মাধ্যমে ইতিামধ্যেই ভূমিকা রাখছে অসংখ্য পরিবর্তনে।
গোল্ডেন রিব্বোন
বাংলাদেশ স্কাউটসের মেসেঞ্জার অব পিস টিমের সদস্যদের নিয়ে এ উদ্যোগে প্রায় ৫০ জন রোভার স্কাউট কাজ করে যাচ্ছে। প্রতি সপ্তাহে ৩ দিন ২-৩ ঘণ্টা ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গে সময় ব্যয় করে। ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশুদের সঙ্গ প্রদান, তাদের সঙ্গে খেলা করা, তাদের প্রতি সপ্তাহে খাবার সরবরাহ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করার লক্ষ্যে এ প্রজেক্ট শুরু করা হয়। এ প্রজেক্টের মাধ্যমে যেমন ক্যান্সারে আক্রান্ত অসহায় শিশুদের কষ্ট দূর হচ্ছে তেমনি দূর হচ্ছে তাদের নিঃসঙ্গতা।
সড়ক নিরাপত্তা ক্যাম্পেইন
প্রতি বছর স্কাউট ও রোভার স্কাউটরা দেশে বিভিন্ন সড়কে সাধারণ পথচারীদের সচেতন করে ফুট ওভারব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিং ব্যবহারের ব্যাপারে। প্রতি বছর নিরাপদ সড়ক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তারা সাধারণ মানুষের অবগতির জন্য কাজ করার পাশাপাশি ঈদ ও পূজা ইত্যাদি সময়কালে যানজট নিরসনে স্কাউটরা দিন-রাত পুলিশের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করে আসছে। যানজট নিরসন ও নিরাপদ সড়কে এই উদ্যোগটি রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সচেতনতামূলক ক্যাম্প
এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে স্কাউট রোভারদের বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলা প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে। এই উদ্যোগের আরেকটি অংশ হিসেবে প্রতি বছর বিদ্যুৎ ও জ্বলানি ক্যাম্প নামক একটি ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, যার মাধ্যমে জনগণের বিদ্যুৎ অপচয় রোধ, সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবহারের ব্যাপারে, বিকল্প জ্বলানির ব্যাপারে অবহিত করা হয়। এই উদ্যোগের আরও একটি অংশ, যার মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বার্তা কিংবা বিভিন্ন রোগের প্রথম অবস্থায় করণীয় ব্যাপারে।
কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ক্যাম্প
বাংলাদেশ স্কাউটসের উদ্যোগে দেশের প্রতিটি জেলায় কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে, যা ইতিমধ্যেই বদলে দিয়েছে অনেক দুর্গম অঞ্চল। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রতি বছর ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে এনে দেওয়া হয় উন্নয়নের আলো।
নির্বাচিত অঞ্চলের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সব কিছুই চলে আসে উন্নয়নের আওতায়। দেশে এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে, যেখানে কিনা এখনও পৌঁছেনি বিদ্যুৎ কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত পানি। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যেই এসেছে দেশের অনেক এলাকায় ব্যাপক পরিবর্তন। পরিবর্তন ঘটেছে লক্ষাধিক মানুষের দৈনিক জীবনযাত্রার চিত্র।
সেবামূলক কার্যক্রম
আমাদের দেশে সংঘটিত নানান প্রাকৃতিক কিংবা মানবগঠিত দুর্যোগে যেমন- সাইক্লোন, সিডর, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ইত্যাদি সময়ে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন অসহায় মানুষের সাহায্যে কাজ করা এই ক্যাম্পেইন ইতিমধ্যেই বদলে দিয়েছে অনেক অসহায় পরিবারের চেহারা। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় ত্রানসহ প্রয়োজনীয় সেবাসমূহ। তাছাড়াও পাহাড় ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে দেশের প্রতিরক্ষাবাহিনীর পাশাপাশি পাহাড়ি মানুষের সেবায় নিয়োজিত ছিল তরুণ স্কাউট দল। এই ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন দুর্যোগে দেশের প্রতিটি স্থানে সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে যাচ্ছে স্কাউটের সদস্যরা এবং সেবার পাশাপাশি হাসি ফোটাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্তদের মুখে।