মায়া সভ্যতাঃ প্রাচীন ইতিহাসের এক বিস্ময়কর রহস্য!

0
মায়া সভ্যতা

চার হাজার বছর আগের কথা। সভ্য মানুষের জীবন যাপন কিংবা সভ্য সমাজের কথা ভাবাটা অন্তত সেই সময়কালে অবান্তর ছিল বটে! কিন্তু ইতিহাস বলছে অন্য কথা। যে যুগে ঘর তৈরি করতে শেখেনি মানুষ, যে যুগে জ্ঞানী মানুষের ব্যপারটা একদমই অকল্পনীয়, সেই যুগেও এমন জাতি ছিল যারা নিজেদের সংস্কৃতি সভ্যতায় রীতিমত সচ্ছল; জীবন যাপন করত সগৌরবে! বিশ পঁচিশ তলা পর্যন্ত ভবনও তৈরী করেছিল তারা। শুধু তা নয়, জ্যোতির্বিদ্যা আর ভাষা নিয়েও ছিল তাদের অভাবনীয় জ্ঞান! অবাক করার মত বিষয় বটে! এমনই হৈ চৈ ফেলে দেয়া ইতিহাস সৃষ্টিকারী জাতি ছিল মায়ানরা। যা বছরেরে পর বছর রয়েছে অন্যান্য জাতির কাছে একদমই অজানা।

অদ্ভুত এক পান্ডুলিপি আবিষ্কার হলো হঠাত, যার কোনো অক্ষর নেই, বর্ণ নেই। ভাষা যায় না বোঝা। কিন্তু কিছু একটা বলা আছে তাতে, কিছু একটা যে বলা আছে সেটা ঠিকই বোঝা যায়। ছোট ছোট ছবি পাশাপাশি আঁকা। নৃতত্ববীদদের মনযোগ কাড়লো। ফলত ধীরে ধিরে আবিষ্কৃত হলো অনেক কিছুই। আলোয় আসলো মায়ান সভ্যতার সাতকাহন।

মায়া সভ্যতা
অদ্ভুত এক পান্ডুলিপি আবিষ্কার হলো হঠাত, যার ভাষা যায় না বোঝা!

এই মায়া জাতির আবাস ছিল মেসো আমেরিকায়। যা বর্তমান মধ্য আমেরিকার অন্তর্ভুক্ত। ভীষণ শক্তিশালী আর সুদক্ষ জাতি হিসেবে পরিচিত ছিল তারা। অতীতের আরো বিভিন্ন জাতির ইতিহাস ঘেঁটে দেখা গেছে যে, অন্যান্য জাতির মানুষেরা অনেকেই সাধারণত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে অভ্যস্ত ছিল। অনেকেই যাযাবর জীবন যাপন করত। কিন্তু মায়ারা তেমন ছিল না। তাদের নির্দিষ্ট ঘর বাড়ি ছিল, ছিল নিজেদের ভূ-খণ্ড। তারা বাড়ি তৈরি করতে জানত। তারা ভূমির অবস্থান নিয়ে বসবাস করতে জানত।
যদিও ধারণা করা হয়ে থাকে, শুরুর দিকে তারা একেবারে যাযাবরদের মতই ছিল। ঘুরে বেড়াত দেশের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত খাবার আর বাসস্থানের খোঁজে। কিন্তু পরে তারা আস্তে আস্তে একত্রিত হতে শুরু করে। গড়ে তোলে স্থায়ী আবাসন। ভৌগলিক অবস্থানের বিবেচনায় গুয়াতেমালা, হন্ডুরাসসহ এল সাল্ভেদরেরে কিছু অংশ জুড়ে ছিল তাদের বসবাস। তারা একত্রে থাকতে যেমন পছন্দ করত। অন্যদের আক্রমণও তেমনই সহজে প্রতিহত করতে সক্ষম ছিল। পেশা হিসেবে তারা বেছে নিয়েছিল পশুপালনকে। তাদের খাবার সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না।

মায়া সভ্যতা
মধ্য আমেরিকার জঙ্গলে আবিষ্কৃত হল মায়া সভতার বিস্ময়কর স্থাপনা!
মেক্সিকোতে আবিষ্কৃত মায়ান সভ্যতার নিদর্শন!

আবিষ্কৃত মায়ান পান্ডুলিপি থেকে যতদূর জানা যায়, তাতে বোঝা যায় ভাষার লৈখিক রূপ হিসেবে তাদের কোনো বর্ণমালা ছিল না। তবে কি তাদের ভাষা ছিল না? না। এমনটি নয়। তাদের ভাষা অবশ্যই ছিল, যেটা দিয়ে তারা ভাবের আদান-প্রদান করত। তবে বর্ণের পরিবর্তে তারা ব্যবহার কত কিছু সাংকেতিক ছবি বা চিহ্ন। এইসব সাংকেতিক ছবি পাশাপাশি এঁকে তারা তাদের ভাব বোঝাত।
যেহেতু কলম আবিষ্কার হয়নি তখনও। তাই লিখত তারা তুলি দিয়ে। আর লেখার জন্য ব্যবহৃত বিশেষ এই তুলি বানাত তারা পশুর লোম কিংবা লেজ দিয়ে। বই বানাত তারা গাছের বাকল দিয়ে। এই বইগুলোকে কোডেক্স বলা হয়। গবেষণায় জানা যায়, তাদের ভাষায় ব্যবহৃত এসব ছবির সংখ্যা হিসেব করলে আট শ’ কিংবা তারও বেশি পাওয়া যায়। আর কোডেক্স তথা বই উদ্ধার করা গেছে মোট চারটি।

এবার আসি তাদের ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে। মায়ানদের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ই হলো তাদের ধর্ম বিশ্বাস। কারণ তাদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে রয়েছে বহু মত। বস্তুত তারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ধর্ম পালন করে এসেছে। তাই তাদের ধর্মের ব্যপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলাও যায় না। ধর্ম ছিল তাদের কাছে বেশ রহস্যজনক এবং গোপনীয় বিষয়। ধর্মের অনেক বিষয়ই তারা পালন করত বিশেষ গোপনীয়তার সাথ।

ধারণা করা হয়, মায়া জাতি ঈশ্বরে বিশ্বাস করত। তারা আরো বিশ্বাস করত যে, সকল প্রাণের একমাত্র ত্রাণকর্তাই ঈশ্বর। তিনিই পারেন প্রাণ দান করতে, আবার তাতে শক্তিও যোগান এই ঈশ্বর। এই শক্তি কেবল ঈশ্বর মারফতই পাওয়া যায়। তিনিই পারেন ইহজাগতিক পরজাগতিক অস্তিত্ব অনস্তিত্বের সমাবেশ ঘটাতে। তাদের বিশ্বাসের আরেকটা বিশেষ বিষয় ছিল চন্দ্র, সূর্য এমনকি বৃষ্টিতে মিশে থাকেন ঈশ্বর। মানুষ প্রার্থনা করলে সেটাও তিনি শুনতে পান।
আর তাদের এই ঈশ্বরের নিকট বিশেষ স্থান লাভ করার আশায় যেটি করত, তা হলো রক্ত বিসর্জন। এই ক্ষেত্রে তারা বেশ ভয়ংকর কিছু ব্যপারও করত। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ইশ্বরের জন্য রক্ত বিসর্জন করত। এভাবেই তাদের বিশ্বাস যে তারা নাকি ঈশ্বরের দর্শন লাভ করতে পারবে। এ সব কিছুই তারা করত বেশ গোপনে। এমনকি রাজারাও এসব কাজে লিপ্ত হত, ইশ্বরের দর্শনলাভেচ্ছায়। নিজেরা রক্ত বিসর্জন দিত।

অন্যান্য মতামতও পাওয়া যায় এদের ধর্মের ব্যপারে। কেউ কেউ বলেছেন,বেশিরভাগ মায়ানরাই নাকি প্রকৃতির পূজা করত। প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয়কে তাদের উপাসক বানিয়ে তার প্রার্থনা করত। মানব জাতির জন্মের ব্যপারে তাদের বিশ্বাস ছিল যে, পৃথিবীর সকল মানুষের আবির্ভাব নাকি ছোট ছোট শস্যদানা থেকে।

ওদিকে আবার মায়ানরা নরবলিতেও সিদ্ধহস্ত ছিল বলে শোনা যায়। আর এটাও নাকি তাদের ধর্ম বিশ্বাসের অন্তর্ভূক্ত ছিল। মায়া জাতির বিভিন্ন দেবতাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চিয়াক, আহপুছ, কিনিস আহাউ, বি, এল। এরা কেউ মৃত্যুর দেবতা, কেউ সূর্যের কেউ নরকের এরকমভাবে বিভিন্ন নামে, ভিন্ন ভিন্ন দেবতা ছিল তাদের। তবে এদের মধ্যে প্রধান দুই অমর দেবতা ছিল ইতজামনা ও কুকুলকান। চিচেন ইতজা নামে একটি শহরও ছিল তাদের। যেটি মূলত নরবলীর শহর হিসেবেই পরিচিত ছিল। বিভিন্ন সময়ে তারা এই দুই দেবতার জন্য বিসর্জন দিত আর এই শহরটি ছিল দুইটি প্রাকৃতিক কুয়ার মাঝামাঝি অবস্থানে। মায়া জাতির সভ্যতা সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছিল এই দুই কুয়া ঘিরে। গড়ে উঠেছিল মঠ, পিরামিডসহ অন্যান্য ধর্মীয় স্তম্ভও। এগুলোর মধ্যে টেম্পল অফ দি ওয়ারিয়র্স, কারাকোল উল্লেখযোগ্য।

এবার একটু তাদের দেবতাদের পরিচয় দিই। প্রধানতম দেবতা ইতজামনা। তাদের মতে ইনি ছিলেন মহান শক্তির আধার। তিনি আকাশচারী দেবতা। মায়ান ধর্মীয় নেতা বা যাজকগণ এই দেবতার নামে নরবলি করত। আর এটাই নাকি ছিল এই দেবতাকে খুশি করার উপায়। নরবলির জন্য তারা বেছে নিত বিশেষ সময়। সময়ানুযায়ী পিরামিডের উপর গিয়ে করা হত নরবলি। আর এক্ষেত্রে তারা তাদের নিজেদের ক্যালেন্ডারও অনুসরন করত। বলিদানের সময় অনুসরণ করা হত এজটেক রীতি। এই রীতিমত বলিকৃত মানুষটার বুক চিরে ফেলা হত, বের করে আনা হত হৃদপিণ্ড এরপর দেবতার সামনে বিসর্জন দেয়া হত। আর সেই মৃত মানুষের অন্যান্য অঙ্গ যেমন হাত, পা রেখে দিত তারা নিজেদের কাছে। আরো বিস্ময়কর এবং ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, এই বলির শিকার যারা হত, তারা কেউই তাদের নিজেদের জাতির কেউ ছিল। ভুলক্রমে বা কোনোভাবে যদি অন্য কোনো সমাজ বা জাতির কোনো লোক তাদের রাজ্যে এসে পড়ত তাদেরকেই হতে হত ভয়ঙ্কর এই নরবলির শিকার।

অন্যদিকে তাদের আরেক দেবতা কুকুলকানের সাথে মিল পাওয়া যায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এক দেবীর সঙ্গে। অনেকের মতে, কুকুলকানের সাথে দেবী মনসার মিল রয়েছে। কুকুলকানও ছিল মায়ানদের সাপের দেবতা। আর তার বাবাকে বলা হত সাপেদের রাজা। তাদের মতে, ডানাওয়ালা এক সরীসৃপ হল কুকুলকান। মায়ারা শ্রদ্ধা কর‍ত এই দেবতাকে; পূজা করত। এই কুকুলকানের উপাসনাই ছিল মায়ানদের রাষ্ট্রধর্ম।
নবম ও দশম শতকের মাঝামাঝি সময়। মায়া জাতি তৈরি করল একশ’ ফুট উচ্চতার এক পিরামিড। যেটা কেবল এই কুকুলকানের উপাসনা করার উদ্দেশ্যেই বানানো হয়েছিল। এই পিরামিডের সিঁড়ির ধাপ ছিল চারদিকে মোট একানব্বইটি করে। ওদিকে আবার উপরে ওঠার জন্য আরেক ধাপ সিঁড়ি। ধারণা করা হয়, সবগুলো মিলিয়ে এই পিরামিডের সিঁড়িতে ধাপ ছিল মোট তিনশ’ পঁয়ষট্টিটি।

মায়া সভ্যতা
কুকুলকানের উপাসনার জন্য তৈরি করা পিরামিড!

কুকুলকানের উপাসনার জন্য তৈরি করা এই পিরামিডের আরো কিছু বিশেষত্ব ছিল। যে পিরামিডকে ঘিরে মায়ান রাজ্যের মানুষগণ মিলিত হত বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন উপলক্ষে। এই পিরামিড তৈরিতে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল যে, বিষুবরেখা প্রদক্ষিণ করার সময় সূর্যের আলো যখন পিরামিডের উপর পড়ত তখন এমন এক ছায়ার সৃষ্টি হত। সেই ছায়া দেখলে মনে হত যেন পিরামিড বেয়ে নেমে আসছে বিশাল আকৃতির এক সরীসৃপ। কী অদ্ভুত! তাই না? ওই যুগেও এমন বৈজ্ঞানিক কুশলী ছিল তারা।

ভাবা যায়! আজকের এই যুগে এসেও যেখানে অসংখ্য অশিক্ষিত জাতিগোষ্ঠির বাস রয়েছে। অথচ সেই চার হাজার বছর আগেই তারা এত উন্নত বিজ্ঞানসম্মত জীবন যাপন করত। ইতিহাসের কাছে এ এক বিস্ময়কর বিষয় বটে।

লেখকঃ আল আমিন