
১২৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইসলামকে ধ্বংস করে চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলার জন্য একটি পরিকল্পনা হয়। পরিকল্পনা ছিলো অত্যন্ত নিখুঁত। বাগদাদ থেকে ধ্বংস শুরু হবে। বিখ্যাত মংকে খান, তার ভাই হুলাকু খানের উপর এক সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অর্পণ করে যাদের লক্ষ্য ছিল পারস্য, সিরিয়া ও মিশর দখল করা এবং সাথে আব্বাসী খিলাফতও ধ্বংস করা। আব্বাসী খেলাফত ধ্বংস করতে পারলে মুসলিম সমাজ জ্ঞান-বিজ্ঞান শূন্য হবে, মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যাবে। সে সময়ে মুসলিম বিশ্বের রাজধানী, বলা যায় সারা বিশ্বের জ্ঞানের রাজধানী ছিলো বাগদাদ। বিশ্বের সবচেয়ে তুখোড় ও প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, চিন্তাবীদ, গণিতবীদ এবং ভাষাতত্ত্ববিদদের জন্য তীর্থস্থানের মতো ছিলো বাগদাদের The House of Wisdom (বাইতুল হিকমাহ) লাইব্রেরী। আব্বাসী খলিফাগণ ছিলেন বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য চর্চার পৃষ্ঠপোষক। পরিকল্পনায় বাগদাদ প্রথমে রাখাটা তাই মংকে-হুলাকুর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় দেয়।
মংকে-হুলাকুরা ছিলেন পৃথিবীর নৃশংসতম রক্ত পিপাসু মঙ্গোল বাহিনীর সেনা অফিসার। আর এই মঙ্গোল বাহিনীকে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বর আর ধ্বংসাত্মক রূপে তৈরি করেছিলেন চেঙ্গিস খান।
১১৬২ সালে মঙ্গোলিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী বোজগিরি গোত্রের প্রধান কাবুল খানের পুত্র ইয়েসুগির ঘরে জন্ম গ্রহন করেন চেঙ্গিস খান। জন্মের পর পিতামাতা তার নাম রাখেন তেমুজিন। তেমুজিন শব্দের অর্থ আয়রন ওয়ার্কার বা কর্মকার। তেমুজিন অর্থাৎ চেঙ্গিস খানের জন্ম এমন সময় হয়, যখন গোটা মঙ্গোলিয়ায় ছিল শুধু উপজাতীয় যাযাবর পশুপালক কিছু গোত্রের বাস। চেঙ্গিস খানের ১৩ বছর বয়সে পিতা ইয়েসুগি মোঙ্গলদের অতিথিপরায়ণ এক উপজাতি গোত্রের সরদারের মেয়ে বর্তির সাথে তার বিয়ে দেন। কিন্তু বিয়ে থেকে ফেরার পথে মোঙ্গলদের চরম শক্তিধর প্রতিপক্ষ তাতার গোষ্ঠীর লোকেরা ইয়েসুগিকে বিষ খাইয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।তেমুজিন শপথ নেন এর প্রতিশোধ নেবেন। সে লক্ষ্যেই বাগদত্তা বর্তিকে ছেড়ে চলে আসেন নিজ গোত্রে। নিজেকে ঘোষণা করেন গোত্রের নেতা। কিন্তু তার গোত্রের জ্যেষ্ঠ নেতারা এই বালককে নেতা মানতে অস্বীকার করেন। নির্জন তৃণভূমিতে বিচ্ছিন্ন করে তাদের পরিবারকে ফেলে গোত্রের লোকেরা চলে যায়। অভাব অনাটনে তাদের অবস্থা এমন হয়েছিলো যে সামান্য খাবার ভাগাভাগিতে দ্বন্দ্বে নিজ ভাইকে হত্যা করে চেঙ্গিস খান।
https://en.wikipedia.org/wiki/Genghis_Khan
নিষ্ঠুরতার হাতেখড়ি এখান থেকেই শুরু। তারপর ১১৮২ সালে সবাই জানতে পারে চেঙ্গিস খান এক দুর্ধর্ষ মানুষ এক অপ্রতিরোধ্য বীর। ঘটনাটি ঘটেছিলো তার পিতার বন্ধু তায়িচুয়েটের বন্দিখানা থেকে পালানো নিয়ে। এক হামলার ঘটনায় তেমুজিন বন্দী হন তার বাবার সাবেক মিত্র তায়িচুয়েটের হাতে। এক প্রহরীকে বস করে তিনি পালিয়ে যান, যা ছিলো অত্যন্ত কঠিন কাজ। তায়িচুয়েটের কাছ থেকে পালানোর পর তেমুজিনের বীরত্বের কথা চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ১১৮৬ সালে বর্তিকে ফিরিয়ে আনেন চেঙ্গিস খান কিন্তু কিছুদিন পর বর্তিকে মারফিট নামে অন্য এক গোত্রের লোকেরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। চেঙ্গিস খান পরে তাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হন। সে যা-ই হোক চেঙ্গিসে খানের ব্যক্তিজীবন কম বৈচিত্র্যময় ছিল না। ধ্বংস, হত্যা, চাতুর্য, ক্ষমতা, লিপ্সা এবং রণকুশলতার এক অভূতপূর্ব মিশেলে গড়া চেঙ্গিস খানের জীবন কাহিনী যেন একটি জীবন্ত সিনেমার মত। চেঙ্গিস খানের রণকুশলতার শুরুহয় ১৭ বছর বয়সে। এসময়ে তিনি সকল মঙ্গোলদের উদ্দেশ্য করে ঘোষনা করেন ঐক্যবদ্ধ হতে। তার আহ্বানে শুধু মঙ্গোলরা নয়, তুর্কি বাহিনিও সমবেত হয়।
মঙ্গোলরা ছিল মধ্য এবং উত্তর এশিয়ার এক যাযাবর গোষ্ঠী। তারা এই অঞ্চলের ধূ ধূ বৃক্ষহীন প্রান্তরে বসবাস করতো। প্রতিনিয়ত স্থান পরিবর্তন আর যাযাবরবৃত্তিই ছিল তাদের জীবনধারণের একমাত্র শৈলী। সকল কাজেই তারা সবসময় ঘোড়ার উপর নির্ভরশীল ছিল, ঘোড়াই ছিল তাদের যোগাযোগের মূল মাধ্যম। তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল বস্তুকেন্দ্রিক বহু ঈশ্বরবাদ। সুবৃহৎ ও সুপ্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা তারা কখনোই গড়তে পারেনি, বরং উত্তর চীনের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে নামেমাত্র সন্ধিচুক্তি ও জোট স্থাপনের মাধ্যমেই জীবন ধারণ করে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, মঙ্গোলরা মধ্য এশিয়ার অন্যান্য গোত্র যেমন তুর্কি এবং তাতারদের সাথে নিয়মিত দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। মঙ্গোল ইতিহাস চিরদিনের জন্য বদলে যায় চেঙ্গিস খানের এই আহ্বানে। তুর্কি আর মঙ্গোল মিলে । সুবৃহৎ ও ঐক্যবদ্ধ দল গড়ে তোলে এবং শুরু করে এমন এক জয়যাত্রা যা জয় করে নিয়েছিল ততদূর পর্যন্ত ভূখণ্ড যতদূর পথ মঙ্গোল ঘোড়সওয়াররা পাড়ি দিতে পারে। http://lostislamichistory.com/mongols/
চেঙ্গিস খান সেনাবাহিনীর উচ্চপদের জন্য বংশ পরিচয়ের চেয়ে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতেন যেটা ছিল মোঙ্গল রীতি বিরুদ্ধ এবং তার রক্তের ভাই জমুখার কাছে খুবই অপছন্দনীয়। এছাড়া দুজনেরই চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল একাধিকপত্য কায়েম করার। তাই দুজনের মধ্যে সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়াল। এককালে তেমুজিনের রক্তের ভাই জমুখা পরিণত হলেন চেঙ্গিসের ঘোর দুশমনে। ১২০৬ সালে জমুখার দলের লোকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করে জমুখাকে তুলেদেয় চেঙ্গিস খানের কাছে। চেঙ্গিস বিশ্বাসঘাতকদের ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ করে আর জমুখাকে পিঠ ভেঙে হত্যা করে। এরপর শুরুহয় নতুন নতুন সাম্রাজ্য দখলের অভিযান।
চেঙ্গিস খান ১২১০-এর দশকে উত্তর চীনের বেশীরভাগ অংশ দখল করে নেয়। এর মাধ্যমে সে জিয়া এবং জিন সাম্রাজ্য ধ্বংস করে, সাথে বেইজিংও দখল করে নেয়। মধ্য এশিয়ার বেশীরভাগ তুর্কি গোত্রগুলোও সে দখল করতে সমর্থ হয় এবং এভাবেই পারস্য পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এর মাধ্যমে সে পূর্ব ইউরোপেও সৈন্যবাহিনী পাঠায়। রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল এবং এমনকি মধ্য ইউরোপের জার্মান প্রদেশগুলোতেও আক্রমণ চালায়।

বীভৎস ধ্বংসলীলা ও নিষ্ঠুরতার মধ্য দিয়ে তার প্রতিটি আক্রমণ ও বিজয় পরিচালিত হয়েছিলো। এ কারণে ইউরোপীয় ঐতিহাসিকগণ তাকে ‘ঈশ্বরের অভিশাপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কোনো দেশ দখল করার পর তিনি পরাজিত সম্রাটের কাউকেই বাঁচিয়ে রাখতেন না। এমনকী শিশুদেরও না। জ্যান্ত শিশুদের বুক চেরা দেখতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। সেইসঙ্গে ভালোবাসতেন শিশুদের টকটকে কলিজা তার প্রিয় চিতাদের খাওয়াতে। অতীতে শাসকদের মধ্যে কে কতো ধরনের নিষ্ঠুরতা দেখাতে পারে তার একটা প্রতিযোগিতা চলতো। তাদের মধ্যে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ছিলেন মোঙ্গল শাসক চেঙ্গিস খান। তার শাসনামলে ঠিক কত মানুষকে তিনি হত্যা করেছেন তা ঐতিহাসিকদেরও ধারণাতীত। কারণ, তার শাসনামলে শুধু চীনেই ছয় কোটি মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছে।মধ্যযুগের ইতিহাসবিদ রশিদ আল-দীনের মতে, মার্ভেতে সাত লক্ষ ও নিশাপুরে দশ লক্ষাধিক লোক হত্যা করে মোঙ্গলরা। আর ইরানের জনসংখ্যা পঁচিশ লক্ষ থেকে আড়াই লক্ষতে নেমে আসে। চেঙ্গিস ও অনুসঙ্গীদের অনুপ্রবেশের ফলে রাশিয়ার জনসংখ্যা অর্ধেকে নেমে যায়। ঐতিহাসিকদের হিসেবে একই ট্রেন্ড দেখা যায় হাঙ্গেরীতে।ঐতিহাসিকদের দাবি, চেঙ্গিস খানের কারণে ৭০ কোটি টন কার্বন বায়ুমণ্ডল থেকে অপসারিত হয়েছিল কারন সাম্রাজ্য বিস্তারে চেঙ্গিস খান যে হত্যাযজ্ঞর কারনে কৃষিজমি ও বসতবাড়িতে গাছপালা জন্মে ক্রমে বনজঙ্গলে পরিণত হয়। জীবনের শেষের দিকে তিনি পাগল হয়ে উঠেছিলেন অমরত্ব লাভের আশায়। চিকিৎসকদের তিনি নিদের্শ দিলেন অমরত্বের অষুধ তৈরি করতে। তারা বিভিন্ন ধরনের দাওয়াই এনে দিলেন। তিনি পরীক্ষাসুলভ সেগুলো তাদের খাওয়ালেন আর তরবারি দিয়ে হত্যা করে দেখলেন তারা অমর কিনা। শেষ পর্যন্ত চান চুন নামের এক বিখ্যাত চৈনিক দার্শনিককে তার কাছে আনা হল তিনি নাকি সবজান্তা। চেঙ্গিজ তাকে সমস্ত সুখের লোভ দেখালেন, জিজ্ঞেস করলেন , কীভাবে সে অমর হবে। উত্তরে তিনি চেঙ্গিজ খানকে চৈনিক স্টাইলে দুহাতের বুড়ো আঙ্গুল দেখালেন আর বললেন অমর হবার একমাত্র উপায় হচ্ছে ভালোবাসা রাজ্য জয় কিংবা হত্যা নয়। কিন্তু তাকেও তিনি হত্যা করেন। https://en.wikipedia.org/wiki/Mongol_invasion_of_Europe
কিন্তু কি বিধির বিধান; ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খান ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মারা যান।
চেঙ্গিস মারা জাওয়ার পর ১৫০ বছর পর্জন্ত মঙ্গোলরা পৃথিবীজুড়ে ধ্বংস চালায়। মঙ্গোলরা কোন শহর অবরোধ করার পর শহরবাসী কোন লড়াই না করে আত্মসমর্পণ করলে তাদের ছেড়ে দেয়া হতো, তবে তারা চলে যেত মঙ্গোল শাসনাধীনে। কিন্তু শহরবাসী আত্মসমর্পণ না করে মঙ্গোলদের সাথে লড়াই শুরু করলে বেসামরিক লোকজনসহ সকলকেই মঙ্গোলরা হত্যা করতো। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারির ১০ তারিখে মঙ্গোলরা বাগদাদ শহরে প্রবেশ করে।পুরো এক সপ্তাহকাল ধরে লুঠতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞ চলে। এসময় মঙ্গোলরা কোন ধরনের বাছ-বিচার করেনি। অবাধে মসজিদ, হাসপাতাল, লাইব্রেরীসহ বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যায়। বাগদাদের লাইব্রেরীসমূহের বইগুলো টাইগ্রিস নদীতে এতো বেশী পরিমাণে ছুঁড়ে ফেলা হয় যে নদীর পানি বইয়ের কালির কারণে কালো রং ধারণ করে।
https://en.wikipedia.org/wiki/Siege_of_Baghdad_(1258) ইসলাম পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে মঙ্গোলদের প্রচেষ্টা সফল না হলেও তারা মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রে এক গভীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষত সৃষ্টি করে যায়। জনশূন্য করে রেখে যায় গোটা অঞ্চলকে। জনশূন্য করে রেখে যায় গোটা অঞ্চলকে। তারা সেচখাল, শস্যক্ষেত্র এবং অর্থনৈতিক অবকাঠামোগুলো এমনভাবে ধ্বংস করে দেয় যে সবকিছুই মেরামতের অযোগ্য হয়ে পড়ে। খিলাফতের মতো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান যা মুসলিম উম্মাহ্কে বহু শতাব্দীকাল ধরে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছিল তা সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
হুলাগু খানের বংশধরদের প্রতিষ্ঠিত মঙ্গোল ইলখানাত ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে পারস্য, ইরাক এবং আনাতোলিয়া শাসন করে। যুগ ও শতাব্দীর পরিক্রমায় দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মঙ্গোলরা ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ এবং পারস্য-তুর্কি সংস্কৃতি ধারণ করতে থাকে। কিন্তু তারপরও ১৩শ শতকে মঙ্গোলরা মুসলিম বিশ্বে যে ধ্বংসাত্মক ও নেতিবাচক প্রভাব রেখে গিয়েছিল তা উপেক্ষা করার কোন সুযোগ নেই।মঙ্গোল আগ্রাসন হচ্ছে ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে হতাশাচ্ছন্ন যুগ। মুসলিম বিশ্ব ১৩শ শতকের মতো ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড এবং ধ্বংসযজ্ঞ এরপর আর দেখেনি ।https://www.islamicity.org/3184/when-the-light-of-islam-almost-vanished/
লেখকঃ সাইফুল ইসলাম
অনেক সুন্দর উপস্থাপন। তথ্যবহুল এবং উপকারি।