পর্তুগীজ ডোমিনিকান পাদ্রী- ‘ডেমিয়ান ফনসেকা’ স্পেনে ১০০ বছরের মধ্যে ৫ লক্ষেরও বেশী মুসলিমকে নিশ্চিহ্ন করে শূন্যে নিয়ে আসাকে বলেছেন “মনোরম হত্যাকাণ্ড”।
প্রথম পর্বের লিংক: তারিক বিন জিয়াদ : ইউরোপ বিজয়ী প্রথম মুসলিম সেনাপতি
১৫০২ খ্রিস্টাব্দে স্পেনীয় সরকার মরিস্কোদের ব্যাপারে কড়া নিয়মকানুন আরোপ করেছিল যেন তারা কিছুতেই গোপনে ইসলাম ধর্ম পালন করতে না পারে, যদিও অনেকেই তা করছিল। মুসলিমরা স্পেনীয়দের কাছে “মরিস্কো” হিসেবে পরিচিত। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে রাণী ইসাবেলা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেয়– স্পেনের মাটিরে আর কোন মুসলিমের অস্তিত্ব সহ্য করা হবেনা। এর ফলে, সকল মুসলিমকে হয় সরকারীভাবে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করতে হবে, নাহয় স্পেন ত্যাগ অথবা মৃত্যু থেকে যেকোন একটি বেছে নিতে হবে। অনেকেই উত্তর আফ্রিকায় পালিয়ে যায় অথবা লড়াই করে শাহাদাত বরণ করে। তবে বেশিরভাগই সরকারীভাবে খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করে, তবে ভেতরে ভেতরে তাদের প্রকৃত বিশ্বাস গোপন করে রাখে।
১০ম শতকে আল-আন্দালুসের রাজধানী কর্ডোবায় ছিল শান বাঁধানো রাস্তাঘাট, হাসপাতাল এবং শহরজুড়ে রাস্তাঘাটে ছিল বাতির ব্যবস্থা। এসময় খ্রিস্টান ইউরোপের সর্ববৃহৎ লাইব্রেরীতে বই ছিল যেখানে মাত্র ৬০০ টি, সেখানে কর্ডোবার ক্যালিগ্রাফারগণ বছরে ৬০০০ টি বই তৈরী করতেন। ইউরোপ ও আফ্রিকার সংস্কৃতির মিশ্রণে শান্তিপূর্ণ এক সমাজ গড়ে উঠেছিল আল-আন্দালুসে, যেখানে শান্তিময় সহাবস্থান ছিল মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান জনগোষ্ঠীর। ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বিষাদময় ঘটনাগুলোর একটি হলো আল-আন্দালুস বা মুসলিম স্পেনের পতন। শত শত বছর ধরে আইবেরিয়া উপদ্বীপ ছিল মুসলিম অধ্যুষিত ও মুসলিম শাসনাধীন এক মুসলিম ভূমি। আল-আন্দালুসের স্বর্ণযুগে এর মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ৫০ লক্ষেরও বেশী এবং তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। মুসলিম শাসকরা (ইসলামী) বিশ্বাস ও জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে সেখানে তৈরী করেছিলেন এক উন্নত ও অগ্রগামী সভ্যতা।
ইউরোপীয় খ্রীষ্টান রাজাদের চক্ষুশূলের কারণ হয় মুসলমানদের এই অগ্রগতি। ফলে ইউরোপীয় মাটি থেকে মুসলিম শাসনের উচ্ছেদ চিন্তায় তারা ব্যাকুল হয়ে উঠে। অতঃপর আরগুনের ফার্ডিন্যান্ড এবং কাস্তালিয়ার পর্তুগীজ রাণী ইসাবেলা এই দু’জনই চরম মুসলিম বিদ্বেষী খ্রীষ্টান নেতা পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তাঁরা সর্বাত্মক শক্তি প্রয়োগ করে মুসলমানদের উপর আঘাত হানবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। তারা মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এমন এক মুহূর্তে ১৪৮৩ সালে আবুল হাসানের পুত্র আবু আব্দিল্লাহ বোয়াবদিল খ্রীষ্টান শহর লুসানা আক্রমণ করে পরাজিত ও বন্দী হন। এবার ফার্ডিন্যান্ড বন্দী বোয়াবদিলকে গ্রানাডা ধ্বংসের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। একদল সৈন্য দিয়ে বোয়াবদিলকে প্রেরণ করে তাঁরই পিতৃব্য আল-জাগালের বিরুদ্ধে। বিশ্বাসঘাতক বোয়াবদিল ফার্ডিন্যান্ডের ধূর্তামি বুঝতে পারেননি এবং নিজেদের পতন নিজেদের দ্বারাই সংঘটিত হবে এ কথা তখন তার মনে জাগেনি। খ্রীষ্টানরাও উপযুক্ত মওকা পেয়ে তাদের লক্ষ্যবস্ত্তর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পরিকল্পনা কার্যকর করতে থাকে। বোয়াবদিল গ্রানাডা আক্রমণ করলে আজ-জাগাল উপায়ন্তর না দেখে মুসলিম শক্তিকে টিকিয়ে রাখার মানসেই বোয়াবদিলকে প্রস্তাব দেন যে, গ্রানাডা তারা যুক্তভাবে শাসন করবেন এবং সাধারণ শত্রুদের মোকাবেলার জন্য লড়াই করতে থাকবেন। কিন্তু আজ-জাগালের দেয়া এ প্রস্তাব অযোগ্য ও হতভাগ্য বোয়াবদিল প্রত্যাখ্যান করেন। শুরু হয় উভয়ের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ।
ফার্ডিন্যান্ড ও রাণী ইসাবেলা মুসলমানদের এই আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের সুযোগ গ্রহণ করে গ্রাম-গঞ্জের নিরীহ মুসলিম নারী-পুরুষকে হত্যা করে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে দিতে ছুটে আসে শহরের দিকে। অতঃপর রাজধানী গ্রানাডা অবরোধ করে। এতক্ষণে টনক নড়ে মুসলিম সেনাবাহিনীর। তারা গা ঝাড়া দিয়ে উঠে। তাতে ভড়কে যায় সম্মিলিত কাপুরুষ খ্রীষ্টান বাহিনী। সম্মুখ যুদ্ধে নির্ঘাত পরাজয় বুঝতে পেরে তারা ভিন্ন পথ অবলম্বন করে। তারা আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় শহরের বাইরের সকল শস্য খামার এবং বিশেষ করে শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান উৎস ‘ভেগা’ উপত্যকা। ফলে অচিরেই দুর্ভিক্ষ নেমে আসে শহরে। খাদ্যাভাবে সেখানে হাহাকার দেখা দেয়। এই সুযোগে প্রতারক খ্রীষ্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ড ঘোষণা করে, ‘মুসলমানেরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয়, তাহ’লে তাদেরকে বিনা রক্তপাতে মুক্তি দেয়া হবে। আর যারা খ্রীষ্টান জাহাজগুলোতে আশ্রয় নিবে, তাদেরকে অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয়া হবে। অন্যথা আমার হাতে তোমাদেরকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে’।
দুর্ভিক্ষতাড়িত অসহায় নারী-পুরুষ ও মাছুম বাচ্চাদের কচি মুখের দিকে তাকিয়ে মুসলিম নেতৃবৃন্দ সেদিন খ্রীষ্টান নেতাদের আশ্বাসে বিশ্বাস করে শহরের প্রধান ফটক খুলে দেন ও সবাইকে নিয়ে আল্লাহ্র ঘর মসজিদে আশ্রয় নেন। কেউবা জাহাজগুলোতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু শহরে ঢুকে খ্রীষ্টান বাহিনী নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে মসজিদে আটকিয়ে বাহির থেকে প্রতিটি মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। অতঃপর একযোগে সকল মসজিদে আগুন লাগিয়ে বর্বর উল্লাসে ফেটে পড়ে নরপশুরা। আর জাহাজগুলোকে মাঝ দরিয়ায় ডুবিয়ে দেয়া হয়। কেউ উইপোকার মত আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেল, কারো হ’ল সলিল সমাধি। প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখায় দগ্ধীভূত ৭ লক্ষাধিক অসহায় মুসলিম নারী-পুরুষ ও শিশুদের আর্তচিৎকারে গ্রানাডার আকাশ-বাতাস ভারী ও শোকাতুর হয়ে উঠেছিল।
১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে গ্রানাদার পতনের পর বেশীরভাগ মুসলিমই এই পরিস্থিতিকে সাময়িক এবং সামান্য বাধা-বিপত্তি হিসেবে ধরে নিয়েছিল। তারা ভেবেছিল আফ্রিকা থেকে শীঘ্রই মুসলিম বাহিনী এসে গ্রানাদা পুনর্বিজয় করবে এবং একটি মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে মুসলিম শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে। যদিও নতুন স্পেনীয় শাসক — ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলার পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন কিছু।
প্রথমেই ধর্মীয় ব্যাপারে তারা তাদের লক্ষ্য পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করে। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে স্পেনের শাসকরা এক ফরমান জারী করে যার মাধ্যমে কার্যকরভাবে স্পেনের সকল ইহুদিদেরকে স্পেন থেকে বিতারণ করতে সক্ষম হয়। শত শত হাজার হাজার ইহুদিকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয় যাদের বেশিরভাগই ওসমানী সাম্রাজ্যে চলে যায়। ওসমানী সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ তাঁর গোটা নৌবাহিনীকে স্পেনে পাঠান ইহুদিদেরকে উদ্ধার করে ইস্তানবুলে নিয়ে আসার জন্য যাতে স্পেনে তাদের জন্য যে গণহত্যা অপেক্ষা করছিল তা তারা এড়াতে পারে। মুসলিমদের ব্যাপারে স্প্যানিশদের নীতিও খুব একটা ভিন্ন ছিলনা। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে গোটা স্পেনজুড়ে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫ লক্ষের মতো। তাদের উপর থেকে মুসলিম রাষ্ট্রের নিরপত্তার ছায়া সরে যাওয়ার পর ক্যাথোলিক চার্চ সকল মুসলিমকে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার ব্যাপারটা গুরুত্বসহকারে নেয়।
প্রাথমিকভাবে ঘুষপ্রদানের মাধ্যমে মুসলিমদেরকে খ্রিস্টান করার চেষ্টা করা হয়। সকল ধর্মান্তরিত ব্যক্তিকে উপহার, টাকা-পয়সা এবং জমি দেয়া হতো। তবে বেশিরভাগই উপহার পাওয়ার পর পুনরায় ইসলাম ধর্মে ফিরে যেত। ফলে ঘুষপ্রদানের মাধ্যমে খ্রিস্টান করার এই প্রকল্প ব্যর্থ হয়।
১৬০৯ খ্রিস্টাব্দে, আল-আন্দালুসের মুসলিমরা আত্মগোপন করার ১০০ বছরেরও বেশী সময় পর স্পেনের রাজা ফিলিপ সকল মরিস্কোকে স্পেন থেকে উচ্ছেদ করার ফরমান জারি করে। তাদেরকে মাত্র ৩ দিন সময় বেঁধে দেয়া হয়, এর মধ্যেই সকল প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র গুছিয়ে উত্তর আফ্রিকা অথবা ওসমানী সাম্রাজ্যগামী জাহাজে আরোহণ করতে বলা হয়।
এসময় যাত্রাপথে খ্রিস্টানরা প্রতিনিয়ত মরিস্কোদের হয়রানি করতে থাকে, তাদের সম্পদ লুট করে নেয় এবং মুসলিম শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে যায় যাতে পরবর্তীতে তাদেরকে খ্রিস্টান হিসেবে বড় করা যায়। সৈন্য ও জনসাধারণ অনেক মরিস্কোকে খেলাচ্ছলে হত্যা পর্যন্ত করে। শুধু তাই নয়, যেসব মরিস্কো জাহাজ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিল, সেখানেও তারা আক্রমণের শিকার হয়। জোরপূর্বক নির্বাসনে পাঠানো হলেও অপমানজনকভাবে জাহাজে তাদের কাছ থেকে ভাড়া প্রত্যাশা করা হয়। এছাড়াও অনেক নাবিক মরিস্কোদের ধর্ষণ ও হত্যা করে এবং তাদের ধন সম্পদ কেড়ে নেয়। এধরনের ধর্মীয় অসহনশীলতাকে কার্যতই গণহত্যা ও সন্ত্রাস হিসেবে অভিহিত করা যায়। স্পেনীয় মুসলিমদের বিদায়কালে তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলার ব্যাপারটি স্পেনীয় সরকার পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা দিয়েছিল।
ধর্মীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের এই কঠিন দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশে ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে আন্দালুসিয়ার এক অজ্ঞাতনামা কবি ওসমানী সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ এর কাছে সাহায্যের আবেদন করে একটি কবিতা রচনা করেন। অংশবিশেষ-
“এই ধরো, আমাদের কেউ যেতে চাইলো আফ্রিকার পথে, নিরাপদে —
নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েও (নিশ্চয়তা মেলেনি তারও)!
এবং আরো কত শত শর্ত!! সামর্থ্যের সবটুকু দিয়েও যদি স্পর্শ করা যেতো শর্তের সিলিং।
তারপর তাদের সম্রাট (ফার্নান্দো) আমাদের বললো, “এর বেশি আর কি চাই তোমাদের?”
চোখের সামনে মেলে ধরলো চুক্তিপত্র —
“তোমাদের প্রতি এই রইলো আমার ক্ষমা আর নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি!
সুতরাং নিজেদের ভিটেয় ফিরে যাও উল্লাসে, আগের মতই। আর কৃতজ্ঞ হও”।।
অতপর! আমরা যখন চুক্তির প্রতিশ্রুতিতে (নিরাপদ),
সহসায় চুক্তি ভাঙলো ওরা বিশ্বাসঘাতকের মতো।
সে চুক্তি ভেঙেছে, প্রতারণা করেছে, আর আমাদের বানিয়েছে খ্রিস্টান —
গায়ের জোরে, চরম কঠোরতায় আর নির্দয়ভাবে!”
স্পেনের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বহিষ্কারের জন্য রাজা জুয়ান কার্লোস ইতিমধ্যে ইহুদীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। একবার ১৯৯২ সালে ইসরাইলের সংসদে এবং দ্বিতীয়টি টলেডোর সিনাগগে। কিন্তু মুসলিমদের দাবী সত্ত্বেও তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন নি। যদিও তিন মিলিয়ন মুসলিমকে বহিষ্কার করা হয়, যারা পার্শ্ববর্তী মরক্কোতে আশ্রয় নেয়। ইবনে হাকিম নামে একজন মরোক্কান বলেন, “আমার পরিবারে ১৪টি স্পানিশ নাম রয়েছে এবং আমরা স্প্যানিশ বলি। হারানো সে হোমল্যান্ডের জন্য আমরা এখনও ভালবাসা ধরে রেখেছি। আমি আশা করি না এত বছর পরে সে বাড়ী ও জমি ফেরত পাব। তবে আমাদের নৈতিক শক্তির বিজয় দেখতে চাই।” ইতিহাসবিদ গিবসন এ প্রসংগে লিখেছেন, “মুসলিমদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে সাড়া দেয়া প্রয়োজন। নাকি গ্রানাডার মুসলিমরা সেখানকার ইহুদীদের চেয়ে হীনতর?”
লেখকঃ সাইফুল ইসলাম