‘ আপনি কইলেন্ রোগী মইরা গেছে …… অহনে রোগী দেহি হাত পা লাড়ায় ! আপনে ফালতু ডাক্তার মিয়া ! পিটানো দরকার আপনেরে ! ‘ অথবা ….. ‘ মার্ শালার ডাক্তার রে। ‘
রোগীর লোক অযথা চিকিৎসকের উপর চড়াও হলো ……. এবং অন্যায় ভাবে চিকিৎসককে মারলো , অকথ্য ভাষায় গালাগালি করলো – এটাই বর্তমান পরিস্হিতি , সাথে হলুদ সাংবাদিক ভাইদের রসালো নিউজ তো আছেই।
স্পষ্ট করে আবারো বলছি – ‘ হ্যাঁ ! অবশ্যই মৃত ব্যক্তি হাত পা নাড়াতে পারেন ‘ – এতে ভীত হবার বা মৃত রোগীকে জীবিত ভাবার কোনো কারণ নেই।
আমি 2009 সালে নিজেই এ রকম পরিস্হিতি ফেইস করেছি। আমি তখন ইন্টার্ণ চিকিৎসক, মিটফোর্ড হাসপাতালের।
OPC ( organo phosphorus compound – যা ক্ষেতের পোকামাকড় দমনে ব্যবহৃত হয় ) খেয়ে এক মেয়ে ভর্তি হয়েছিলো সন্ধ্যা সাতটায়। 276 টা এট্রোপিন ইনজেকশন দেয়ার পরও রাত তিনটায় রোগী মারা যায়। আমি হার্টবিট, কেরোটিড পালস্ , পিউপিল এবং নিশ্বাসের (respiration) অনুপস্হিতি এবং ECG করে নিশ্চিত হয়েই রোগীকে মৃত ঘোষণা করি।
রাত তিনটা দশ মিনিটে রোগীর আত্মীয় স্বজন অভিযোগ করেন – ‘ রোগী হাত পা নাড়াচ্ছে …..! ‘
আমি রোগীকে আবারো examine করে ওদের আশ্বস্ত করি – ‘ রোগী যেই বিষ খেয়েছে ……. তাতে ঘন্টা খানেক রোগীর হাত পা নড়াচড়া করবে, এর মানে এই নয় যে – রোগী জীবিত। ‘
ভাগ্য ভালো ছিলো যে – একজন শিক্ষিত লোক আমার ব্যাখ্যা বুঝেছিলেন এবং পরবর্তীতে দেখা গেলো – দুই ঘন্টা পর রোগী আর হাত পা নাড়ছেন না।
একটু ব্যাখ্যা দেই –
OPC বিষ শরীরের নিকোটিনিক receptor এর উপর কাজ করে বলে মৃত্যুর পরও muscle fasciculation হতে পারে, বিষাক্রান্ত রোগী মৃত হওয়া সত্ত্বেও হাত পা নাড়াতে পারেন।
আরো জেনে রাখুন – কোন কোন্ ক্ষেত্রে মৃত রোগী নড়ে উঠতে পারেন!
. Rigor mortis ( সবচেয়ে common cause )
. Post CPR ( কোন রোগীকে বাঁচানোর জন্য যদি চিকিৎসকরা DC shock দেন বা বুক চেপে থাকেন )
.Hyperkalemia ( শরীরে পটাশিয়াম এর মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া )
.Post adrenaline effect , ( রোগীকে বাঁচানোর জন্য এড্রেনালিন দেয়া হলে )
.Brain death Pt in ventilator ( মস্তিষ্ক মৃত ব্যক্তি যিনি কৃত্রিম শ্বাসপ্রস্বাস নেবার মেশিনে ছিলেন , সদ্যমৃত – লেজারিয়াস্ সিনড্রম )
. Septicemia with multi organ failure ( rarely)
এই সব রোগে মৃত ব্যক্তি হঠাৎ নড়ে উঠলে ভাববেন না – চিকিৎসক রোগী বেঁচে থাকার পরও মৃত বলেছেন।
এসব রোগীদের শরীরে হার্টবিট, কেরোটিড পালস্, চোখের কোনো reaction পাওয়া যায়না – তথাপি মৃত রোগী নড়ে উঠতে পারে।
মৃত ঘোষিত ব্যক্তির জেগে ওঠা ( Lazarus syndrome , কেইস পর্যালোচনা ………. )
. 1996 সালের 31 শে ডিসেম্বর Daphine নামক ভদ্রলোক ড্রাগ ওভারডোজের কারণে ইংল্যান্ডে মারা যান, মৃত ঘোষণার 34 ঘন্টা পরও তাকে মর্গে নাক ডাকতে দেখা যায়!
. UK তে 27 বছর বয়স্ক ব্যক্তি হিরোইন এবং কোকেন মাদকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে CPR এবং DC shock দেবার পর মৃত ঘোষণা করা হয়। সবাইকে তাক লাগিয়ে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে যান এবং হেঁটে বাড়ি ফিরেন।
. UK তে 66 বছর বয়স্ক ব্যক্তি Cardiac arrest এ মৃত্যুবরণ করেন, তাঁকে 17 মিনিট ধরে CPR এবং DC shock দেবার পর মৃত ঘোষণা করা হয়। তিনিও জেগে ওঠেন।
. 2002 সালে journal forensic science এর তথ্য মতে 65 বছর বয়স্ক জাপানী ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করে মর্গে পাঠানোর পর তিনি নাড়াচাড়া শুরু করেন ও অতিরিক্ত চারদিন বাঁচেন।
. USA তে 61 বছর বয়স্ক Judith Johnson নামক ব্যক্তি Beebe Medical center কর্তৃক মৃত ঘোষিত হবার পর মর্গে নড়াচড়া শুরু করেন ও তাকে শ্বাস নিতে দেখা যায়।
. Michel Wilkinson নামক ব্যক্তি 2009 সালের। লা ফেব্রুয়ারী Royal Preston Hospital এ মৃত ঘোষিত হন। তিনি তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে নড়েচড়ে ওঠেন এবং আরো দুই দিন বেঁচে ছিলেন।
আশ্চর্য্য হচ্ছেন ?
1982 সাল থেকে অদ্যোবধি এরকম 38 টা কেইস UK এবং USA তেই নথিভুক্ত হয়েছে যারা মৃত ঘোষণার পরও জীবনের চিহ্ন দেখিয়েছেন।
চিকিৎসকদের ভুল বুঝবে না …….. তথ্যগুলো জানুন এবং যেসব সাংবাদিক লেখেন –
‘ মৃত ঘোষণার পর নড়ে উঠলো মৃত ব্যক্তি ‘ – তাদের হলুদ সাংবাদিকতার তীব্র প্রতিবাদ করুন।
Lazarus syndrome ব্যতীত এমন একজন রোগীও দেখাতে পারবেন না – চিকিৎসক ECG তে straight line পেয়ে মৃত ঘোষণার পর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেছে l চ্যালেঞ্জ করলাম। অসম্ভব …..অসম্ভব ……অসম্ভব ……।
ভালো থাকুন সবাই ……. ভালোবাসা অফুরান।
লেখক: ডা: আসিফ উর রহমান
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আইসিইউ এন্ড ক্রিটিক্যাল কেয়ার