দিগ্বিজয়ী বীর সম্রাট যুলকারনাইন এবং ইয়াজুজ মাজুজ

0

মহানবী (স) এর নব্যুয়ত এর সত্যতা প্রমাণ করতে ইহুদী পন্ডিতদের পরামর্শে কুরাইশরা মুহম্মদ (স) এর কাছে যে তিনটা বিষয় জানতে চেয়েছিল তার একটি ছিল যুলকারনাইন সম্পর্কে।

এরপর যুলকারনাইন বিষয়ে ওহী নাজিল হয় (সুরা কাহাফ এর আয়াত ৮৩ থেকে ৯৮) কিন্তু কুরানের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শুধুমাত্র যতটুকু জানা জরুরী ততটুকুই উল্লেখ করে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে কুরানে যুলকারনাইন এর আলোচনায় মূল বিষয় ছিল তাঁর ন্যায়পরায়নতা, আল্লাহভীতি এবং ইয়াজুজ ও মাজুজ প্রসঙ্গ! স্বাভাবিকভাবেই সময়কাল, স্থান, প্রকৃত নাম ইত্যাদি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা সেখানে নেই

তবুও কুরানের আয়াত, তাফসীরকারকদের ব্যাখ্যা, বাইবেল ও ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থের বর্ননা ও ইতিহাসবিদদের গবেষনায় যা জানা গেছে তা উল্লেখ করছি……

যুলকারনাইন ছিলেন ঈসা (আ) বা যিশু খ্রিষ্টের জন্মের পূর্বের ৫ শত থেকে ৩ শত বছর সময়ের মধ্যবর্তী সময়ের পরাক্রমশালী একজন সম্রাট। তিনি পৃথিবীর পূর্ব পশ্চিম এর অনেক রাজ্য পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হন।

যুলকারনাইন হচ্ছে উপাধি, তার প্রকৃত নাম সম্পর্কে কুরানে কিছু উল্লেখ নেই। পৃথিবীর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভ্রমণ করেছেন বলে তাঁকে যুলক্বারনাইন বলা হয়। তবে এত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারি হিসেবে ৩ জন শাসক কে পাওয়া যায়

১। পারস্যের সম্রাট খসরু, খুরস বা সাইরাস

২। গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার বা সিকান্দর

৩। ইয়েমেনের হিমায়ার সম্রাট আবু কারাব আসাদ

তবে কুরানের উল্লেখিত পূর্ব পশ্চিমে বিস্তৃত সাম্রজ্যের হিসেবে  পারস্যের সম্রাট খসরু, খুরস বা সাইরাস এবং গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার কেই উপযুক্ত মনে হয়।

আবার কুরানের আয়াত থেকে স্পষ্ট যুলকারনাইন ছিলেন ন্যায়পরায়ন ও আল্লাহভীরু শাসক। কিন্তু আলেকজান্ডার ছিলেন মুশরিক।

তাই  অধিকাংশের মতে সম্রাট খসরু বা সাইরাস ই হলেন যুলকারনাইন।

খ্রিস্ট্রপূর্ব ৫৪৯ সালে (বা এর কাছাকাছি) সম্রাট খসরুর উত্থান শুরু হয়। স্বল্পসময়ের মধ্যে তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চ্যাত্যের বিশাল অংশ (আল জিবাল ও এশিয়া মাইনর) নিজের সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। খ্রিস্ট্রপূর্ব ৫৩৯ সালে তিনি ব্যবিলন সাম্রাজ্যও দখল করে নেন। তার সাম্রাজ্য সিন্ধু ও তুরস্ক থেকে পুর্বে মিসর, লিবিয়া পর্যন্ত এবং পশ্চিমে গ্রীস ও মেসিডোনিয়া পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।

কুরানে উল্লেখিত আয়াত……

আমি (আল্লাহ) বললাম-  ‘হে যুলকারনাইন! তুমি এদেরকে শাস্তি দিতে পার বা এদেরকে সদয়ভাবে গ্রহণ করতে পার।’

সে বলল, ‘যে ব্যক্তি যুলম করবে, আমি অচিরেই তাকে শাস্তি দেব। অতঃপর তাকে তার রবের নিকট ফিরিয়ে নেয়া হবে। তখন তিনি তাকে কঠিন আযাব দেবেন। আর যে ব্যক্তি ঈমান আনবে এবং সৎকাজ করবে, তার জন্য রয়েছে উত্তম পুরস্কার। আর আমি তার সাথে নরম আচরন বলব’।

এই ৩ আয়াত এর বাচনভঙ্গি (মনে হচ্ছে আল্লাহ ওহির মাধ্যমে সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছেন) থেকে কেউ কেউ মনে করেন যুলকারনাইন নবী ছিলেন। কিন্তু অধিকাংশের মতে যুলকারনাইন নবী ছিলেন না, ন্যারপরায়ন বাদশাহ ছিলেন। সেসময়ে অন্য কোন নবী বর্তমান ছিলেন (হযরত খিজির (আ) ) যার মাধ্যমে এই কথা যুলকারনাইনের উদ্দেশ্যে নাজিল হয়েছে।

যুলকারনাইন এর প্রাচীরঃ

যুলকারনাইন বিভিন্ন রাজ্য জয় করে যখন উত্তর পূর্ব দিকে আসলেন (কাস্পিয়ান সাগর ও কৃষ্ণ সাগর এর মাঝামাঝি, ককেশিয় এলাকা) সেখানে এক জাতির দেখা পেলেন যারা তাঁর কাছে নিবেদন জানালো ইয়াজুজ মাজুজদের অত্যাচারে তারা সর্বসান্ত,  দুই পাহারের উপত্যকা দিয়ে তারা এসে হামলা করে, লুটপাট করে চলে যায়।

অতঃপর যুলকারনাইন সেখানে দুই দিকের পাহাড়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় লোহা ও তামার প্রাচীর নির্মান করে দেন। ফলে ইয়াজুজ মাজুজ রা আর প্রাচীর ডিঙিয়ে আক্রমন করতে পারত না।

ইয়াজুজ মাজুজ
প্রাচীন চিত্রকর্মে জুলকারনাইন ও তার প্রাচীর নির্মাণের চিত্র

যুলকারনাইনের এই প্রাচীরে অবস্থান নিয়ে ভিন্নমত আছে। অনেকে চীনের মহাপ্রাচীর কে যুলকারনাইনের প্রাচীর মনে করেন কিন্তু কুরান, হাদীস বিশারদরা সে কথা নাকচ করে দিয়ে বিভিন্ন প্রমাণ দেখিয়ে নিশ্চিত করেছে এই প্রাচীর ককেশীয় অঞ্চলে। ককেশীল অঞ্চলে সুউচ্চ পাহাড় এবং সেখানের উপত্যকার কথা সবাই জানি। এসব পাহাড়ের কোন স্থানেই এই প্রাচীর নির্মিত হয়েছিল। অধিকাংশের মতে রাশিয়া ও জর্জিয়া সীমান্তের কোন এক স্থানে। যা এখন পাহাড়ের মাটির নিচে চাপা পড়েছে হয়তো।

ইয়াজুজ মাজুজ
ককেশাস অঞ্চল
ইয়াজুজ মাজুজ
এখানেই হয়ত ছিল যুলকারনাইনের প্রাচীর

ইয়াজুজ মাজুজঃ

কিয়ামতের আলামতগুলোর মধ্যে “ইয়াজুজ-মাজুজ”-এর উত্থান অন্যতম।

কারা এই ইয়াজুজ মাজুজ? প্রাচীন কালে এরা ছিল দুর্ধর্ষ লুটেরা। অতর্কিত আক্রমন করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ধন সম্পদ লুট ও হত্যা চালাতো এই ইয়াজুজ মাজুজ নামধারী সম্প্রদয়ায়।  ইয়াজুজ মাজুজ (Gog & Magog)  নিয়ে তিন  ইব্রাহীমি ধর্মে (ইসলাম, ইহুদি ও খ্রিস্টান) নানা মত আছে। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতিকে  ইয়াজুজ মাজুজ হিসেবে মনে করা হয়েছে। এই তিন ধর্মেরই অনুসারীরা বিশ্বাস করে, কেয়ামত এর আগে সমগ্র বিশ্বাসী মানুষদের সাথে ইয়াজুজ মাজুজদের একটা মারাত্নক যুদ্ধ হবে। যে যুদ্ধে ব্যপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হবে।

অধিকাংশ তাফসীর বিদদের মতে চীন, মংগোলিয়া, তুরস্ক ও রাশিয়ার কিছু অংশে এই ইয়াজুজ মাজুজদের বংশধররা রয়েছেন। তাদের নাক চ্যাপ্টা, ছোট ছোট চোখ হবে। কিছু ইসরাঈলী ঐতিহাসিক তাতারী, মঙ্গল, হুন ও সেথিন উপজাতির লোকদের ইয়াজুজ মাজুজদের বংশধর মনে করেন।

ইয়াজুজ মাজুজ
প্রাচীন চিত্রকর্মে ইয়াজুজ মাজুজ দের একজনের প্রতিকৃতি
ইয়াজুজ মাজুজ
প্রাচীন চিত্রকর্মে ইয়াজুজ মাজুজদের নৃশংসতা

সম্রাট যুলকারনাইন বিভিন্ন রাজ্য জয় করে যখন ককেশাস অঞ্চলে আসলেন তখন সেখান জনতা যুলকারনাইন এর নিকট অনুরোধ করেছিল একটা প্রাচীর বানিয়ে দিতে যাতে ইয়াজুজ মাজুজরা উপত্যকার অপর প্রান্ত থেকে এসে তাদের উপর আক্রমন না করতে পারে। এই অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রাচীর নির্মাণ করে ইয়াজুজ মাজুজদের একপাশে আটকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুগের পরিক্রমায় তারা ধীরে ধীরে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ইসলামের হাদীস বিশারদদের মতে ইসা (আ) আবার যখন পৃথিবীতে আসবেন ততদিনে বিশ্বে ইয়াজুজ মাজুজদের প্রভাব বেড়ে যাবে। তারা আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টায় নানা জুলুম অত্যাচার শুরু করবে। এক পর্যায়ে ইব্রাহিমী ধর্মের অনুসারীদের সাথে ইয়াজুজ মাজুজদের তুমুল যুদ্ধ হবে। সে যুদ্ধে ব্যপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হবে। শেষ পর্যন্ত ইয়াজুজ মাজুজদের পরাজয় হবে।

যেহেতু শতভাগ নিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না , তাই ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে এর বেশি জানা সম্ভব হয়নি।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে