রক্তদান এমন এক ব্যাপার, যা জাতি, ধর্ম, বর্ণের ভেদাভেদ ভুলিয়ে সম্প্রীতির বার্তা বয়ে চলে। হাসি ফোটায় মৃত্যু পথযাত্রীর ঠোঁটের কোণে। প্রতিবছর বিশ্বে গড়ে প্রায় ১১৮ মিলিয়ন ইউনিট রক্তের প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশে রক্তের চাহিদা বছরে ৬ লক্ষ ব্যাগ। রক্তের প্রয়োজন প্রতিদিন বাড়ছে। আগে মানুষ রক্তের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতো। এখন রক্তদাতা তৈরি হচ্ছে। এর জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য অন্য একজনের। ১৮৬৮ সালের ১৪ জুন, অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় জন্ম নেন চিকিৎসাবিজ্ঞানি ‘কার্ল ল্যান্ডস্ট্যাইনার’, যিনি সর্বপ্রথম রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার করেন।
১৭ বছর বয়সে কার্ল ল্যান্ডস্ট্যাইনার ভর্তি হন ভিয়েনা মেডিকেল কলেজে। ২৩ বছর বয়সে নামের পাশে যুক্ত হয় ডক্টরেট ডিগ্রি। ‘রক্তের উপাদানের উপর খাদ্যের কেমন প্রভাব পড়তে পারে’- সংক্রান্ত গবেষণাপত্র প্রকাশ করে হৈচৈ ফেলে দেন চারদিকে। রসায়নের জটিল সব তত্ত্ব তাকে আকৃষ্ট করতো। বিশেষত, জৈবিক রসায়ন। নিজেকে আরও পোক্ত করতে পাড়ি জমান জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে। বিভিন্ন গবেষণাগারে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে থাকেন কলাকৌশল। ১৮৯৬ সালে দেশে ফিরে আসেন। ভিয়েনা হাসপাতালের গবেষক ম্যাক্স ফন গ্রোভারের সাথে সহকারি গবেষকের ভূমিকায় কাজে যোগ দেন।
একশো বছর আগেও মানবদেহে রক্ত সঞ্চালন ছিল ধোঁয়াশা। এখন যত সহজে অল্প সময়ে রক্ত দান সম্ভব, তখন তেমন ছিল না। কার্ল ল্যান্ডস্ট্যাইনার লক্ষ্য করছিলেন সবকিছু। ১৯০০ সালের শুরুতে গবেষণা শুরু করেন। ততদিনে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রক্ত সংক্রান্ত সমস্যা। বিভিন্ন মানুষের রক্ত সংগ্রহ করতে আরম্ভ করেন কার্ল। গবেষণাগারে নিয়ে এক রক্তের সাথে আরেক রক্ত মিশিয়ে দেখতে লাগেন কী হয়! তিনি দেখতে পেলেন, কিছু রক্তের মিশ্রণে রক্ত জমাট বাঁধতো। আবার, কিছু ক্ষেত্রে জমাট বাঁধতো না। জমাট বাঁধার ধরণেও ভিন্নতা দেখা দেয়। রহস্য উন্মোচনের নেশা চাপে কার্লের মাথায়। এক বছর গবেষণার পর রক্তের অ্যান্টিবডি-এ এবং অ্যান্টিবডি-বি আবিষ্কার করেন। দুটোর উপস্থিতির উপর ভিত্তি করে রক্তকে এ, বি, ও (ABO)- তিন শ্রেণীতে ভাগ করেন। আরও বছরখানেক পর কার্ল ও সহকর্মীরা মিলে চতুর্থ ধরণ এবি (AB) গ্রুপ নির্ণয় করেন।
ব্লাড গ্রুপিংয়ের মাধ্যমে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু করার পরে সফলতা দেখা গেলেও, কিছু রোগীর শরীরে জটিলতা প্রকাশ পেতে লাগলো। তিনি ফের গবেষণায় মনোযোগি হন। সহযোগি অালেকজ্যান্ডার ওয়াইনারকে নিয়ে রেসাস প্রজাতির বানরের দেহের উপর পরীক্ষা চালান। সেখানে কিছু ফ্যাক্টর লক্ষ্য করেন তিনি। এরপর মানব শরীরে একই পরীক্ষা চালান। মানব শরীরে ফ্যাক্টরের উপস্থিতি নির্ণয় করেন সফলভাবে। ১৯৩৭ সালে রেসাস বানরের নামের সাথে মিলিয়ে কার্ল ল্যান্ডস্ট্যাইনার আবিষ্কার করেন ‘রেসাস ফ্যাক্টর।’ এতে করে এ, বি, ও (ABO) গ্রুপের সাথে গাণিতিক চিহ্ন যোগ ও বিয়োগ যুক্ত করে রেসাস ফ্যাক্টরের উপস্থিতি আলাদা করা হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত রক্তের গ্রুপিং প্রক্রিয়া এভাবেই হয়ে আসছে। যা সহজ করেছে রক্তদান এবং নিশ্চিত করেছে নিরাপত্তা।
১৯৩০ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন কার্ল। ১৯৪৬ সালের ২৬ জুন মৃত্যুবরণ করেন এই চিকিৎসক ও গবেষক। নোবেল পুরস্কারের পাশাপাশি তিনি অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হন। তন্মধ্যে রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপকের স্বীকৃতি, পল এরলিক পদক, আরনসন পদক, ক্যামেরুন পুরস্কার, ডাচ রেড ক্রস পদক, মরণোত্তর আলবার্ট ল্যাসকার ক্লিনিক্যাল মেডিকেল গবেষণা স্বীকৃতি অন্যতম।
কার্ল ল্যান্ডস্ট্যাইনার বেঁচে থাকবেন রক্তের প্রতি বিন্দুতে। রক্তের গ্রুপ আবিষ্কার করে পৃথিবীর মানুষদের কতখানি ঋণী করে গেছেন কার্ল ল্যান্ডস্ট্যাইনার, সেটি কখনও জানা হবে না তাঁর।