তারিক বিন জিয়াদ : ইউরোপ বিজয়ী প্রথম মুসলিম সেনাপতি

1

ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত দেশ স্পেন, যে দেশের বেশিরভাগ(৬৮%) মানুষ রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। মুসলিম প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ কজন জানে এ দেশটি একসময় মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল! এ দেশটিকে ঘিরে রয়েছে মুসলিমদের গৌরবের ইতিহাস! এ ইতিহাস দু’এক বছরের নয়, কয়েক শত বছরের ইতিহাস এটি। স্পেনে কয়েক’শ বছর ধরে কায়েম ছিল মুসলিম শাসন।

আর স্পেনে এ মুসলিম শাসনের সূচনা করেছিলেন তারিক বিন জিয়াদ নামের এক সেনাপতি। তারিক বিন জিয়াদ ছিলেন ইউরোপ বিজয়ী প্রথম মুসলিম বীর সেনাপতি। কিন্তু তিনি কোথা থেকে এসেছিলেন বা কোন বংশোদ্ভূত ছিলেন- সেসব সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে প্রায় কিছুই জানা যায় না।

কোন কোন ইতিহাসবিদের মতে, তারিক বিন জিয়াদ ছিলেন হামাদানের একজন পারস্য বংশোদ্ভূত লোক। আবার কেউ মনে করেন, তিনি কিন্দাহ গোত্রের একজন মুক্ত আরব অধিবাসী ছিলেন। অনেকের ধারণা, তিনি উত্তর আফ্রিকার বার্বার বংশোদ্ভূত লোক ছিলেন। তবে অধিকাংশ আরব ও স্পানিশ ইতিহাসবিদ এ বিষয়ে প্রায় একমত যে তারিক বিন জিয়াদ ইফ্রিকিয়ার( বর্তমান তিউনিশিয়া, পশ্চিম লিবিয়া ও পূর্ব আলজেরিয়া নিয়ে গঠিত ছিল রোমান সাম্রাজ্যের আফ্রিকা প্রদেশ। এ প্রদেশকে ইফ্রিকিয়া বলা হতো) আমির মুসা বিন নুসাইরের একজন দাস ছিলেন। পরে তিনি তাকে মুক্ত করে দেন ও নিজের সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত করেন। অবশ্য তারিকের বংশধররা পরে তার দাস হওয়ার বিষয়টা অস্বীকার করেছিল বলে জানা যায়।

তারিক বিন জিয়াদ
শিল্পীর তুলিতে তারিক বিন জিয়াদ

৭১০-৭১১ সালে মরক্কোর তানজিয়ার জয় করলে মূসা বিন নুসাইর তারিক বিন জিয়াদকে সেখানকার গভর্নর নিযুক্ত করেন। তানজিয়ারের পাশেই অবস্থিত ছিল স্পানিশ শহর সিউটা। মুসা বিন নুসাইর চেয়েছিলেন সিউটা দখল করতে। কিন্তু তানজিয়ার জয় করলেও সিউটা মুসলিমদের কাছে সে সময় পর্যন্ত অজেয়ই থেকে যায়। সিউটা শহরটি সেসময় ভিসিগথ গোত্রের জুলিয়ান নামক একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে ছিল।

৭১০ সালের দিকে স্পেনের ক্ষমতায় আসেন হিসপানিয়ার(আইবেরিয়ান উপদ্বীপ) ভিসিগথিক শাসনকর্তা রডেরিক। রডেরিক ক্ষমতায় আসলে সিউটার শাসনকর্তা জুলিয়ান, প্রথানুযায়ী, তার কিশোরী কন্যাকে শিক্ষার্জনের জন্য ভিসিগথিক রাজার দরবারে পাঠান। কিন্তু সেটিই হয় জুলিয়ানের জীবনের সবথেকে বড় ভুলের একটি। রডেরিক জুলিয়ানের কন্যাকে ধর্ষণ করেন। সেই অত্যাচারের বিচার না পেয়ে জ্বলে ওঠেন জুলিয়ান। প্রতিশোধের নেশায় তিনি হাত মেলান মুসলিমদের সাথে। তিনি তার এলাকায় আমন্ত্রণ জানান তারিক বিন জিয়াদকে। মুসলিমদেরকে স্পেন ও মরক্কোর মধ্যে অবস্থিত জিব্রাল্টার প্রণালী গোপনে পার করে দেয়ার ব্যাপারে তিনি তারিকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন।

এর ফলে, জুলিয়ানের সহায়তায়, নতুন ধর্মান্তরিত মুসলিম ও নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে গঠিত তারিকের বাহিনী ৭১১ সালের ২৯ এপ্রিল স্পেনের সীমানায় একটি পাহাড়ের নিকটে অবতরণ করেন। যা বর্তমানে জিব্রাল্টার নামে পরিচিত। জিব্রাল্টার নামটি আসলে আরবি ‘জাবাল আত তারিক’ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ ’তারিকের পাহাড়’। অর্থাৎ তারিকের নামানুসারেই জিব্রাল্টারের নামকরণ করা হয়।

তারিক বিন জিয়াদ
জিব্রালটারের ব্যাংক নোটে তারিক বিন জিয়াদের ছবি

জিব্রাল্টারে পৌঁছেই তারিক বিন জিয়াদ তার এবং তার সৈন্যদের বহনকারী সব নৌযান পুড়িয়ে দেন। এটি দেখে তার একজন সৈন্য যখন হতবুদ্ধি হয়ে তার কাছে জানতে চান, কেন তিনি এমন করলেন? তারা এখন ফিরবে কেমন করে? তারিক তখন শান্তভাবে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ফিরে যাবার জন্য তো আমরা আসিনি। হয় বিজয় হবে নতুবা মৃত্যু’। যুদ্ধে জয়লাভের ব্যাপারে এমনই বদ্ধপরিকর ছিলেন তারিক বিন জিয়াদ।

তারিকের সেনাবাহিনীতে মাত্র ৭০০০জন সৈন্য ছিল। তার সাথে মুসা বিন নুসাইর আরও ৫০০০সৈন্য পাঠিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। স্পেনের সম্রাট রডেরিক তারিকের এই স্বল্প সংখ্যক সৈন্যবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য এক লক্ষাধিক সৈন্য সমাবেশ করেছিলেন বলে জানা যায়। তবু তারিকের অসাধারণ নেতৃত্ব, তার সৈন্যবাহীনির অসীম সাহসীকতা ও বীরত্বের কাছে হার মানতে হয়েছিল রডেরিককে।

রডেরিকের বিশাল সৈন্যবাহীনিকে মোকাবিলা করতে হবে শুনে প্রথমে তো তারিকের সৈন্যরা ভয় পেয়ে যায়। তারা সংখ্যায় এত কম ছিল যে ভয় পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের ছিল অসীম সাহসী আর প্রেরণাদায়ী এক নেতা, তারিক বিন জিয়াদ। জানা যায়, যুদ্ধের পূর্বে তার সৈন্যবাহীনিকে সামনে রেখে তারিক বিন জিয়াদ এক যুগান্তরী ভাষণ দিয়েছিলেন। তারিক বিন জিয়াদ সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন,

” হে আমার সৈন্যগণ, কোথায় পালাবে তোমরা? তোমাদের পেছনে সাগর, আর সামনে শত্রু। তোমাদের কাছে আছে কেবল দৃঢ়তা এবং সাহস। মনে রেখো, এদেশে তোমরা সেই এতিমদের চেয়েও দূর্ভাগা যাদের অর্থলোভী মালিকরা তাদের বিক্রি করে দেয়। তোমাদের সামনে শত্রু, যাদের সংখ্যা অগণিত। কিন্তু তোমাদের শুধু তলোয়ার ব্যতীত কিছুই নেই। তোমরা বেঁচে থাকতে পারবে কেবলমাত্র যদি শত্রুর হাত থেকে নিজেদের জীবন ছিনিয়ে আনতে পারো। তোমাদের সামনে আছে শত্রুকে পরাজিত করে জয় ছিনিয়ে আনার সুবর্ণ সুযোগ। যদি তোমরা মৃত্যুকে তুচ্ছ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো তবে জয় নিশ্চিত। ভেবোনা আমি তোমাদের বিপদের মুখে ফেলে পালিয়ে যাব, আমিই সবার সামনে থাকব এবং আমার বাঁচার সম্ভাবনাই সবচেয়ে ক্ষীণ।”

কাজ হয়েছিল তারিকের এই বক্তৃতায়। উদ্দীপিত হয়েছিল সৈন্যরা। তিনি তার সৈন্যবাহিনীকে সাথে নিয়ে প্রমাণ করেছিলেন, সৃষ্টিকর্তা চা্ইলে কোন বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। রডেরিকের ১,০০,০০০ সৈন্যও তাই তারিকের মাত্র ১২০০০সৈন্যকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল।

রডেরিকের ১ লক্ষ সৈন্যও তারিকের মাত্র ১২ হাজার সৈন্যকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল (প্রতীকী ছবি)

যুদ্ধের সময় তারিক বিন জিয়াদ তার সৈ্ন্যদলকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে কর্ডোভা, গ্রানাডা ও অন্যান্য অঞ্চল জয় করতে পাঠান। এসময় তিনি মূল সেনাদলের সাথে অবস্থান করেন। তারা টলেডো ও গুয়াদালজার জয় করে। ৭১১ সালের ১৯জুলাই হিস্পানিয়ার (স্পেন) গুয়াডালেট নামক স্থানে মুসলিমদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে ভিসিগথিক রাজা রডেরিক পরাজিত ও নিহত হন। এর ফলে ভিসিগথ রাজ্যে তারিক বিন জিয়াদের নেতৃত্বে মুসলিমরা চূড়ান্তভাবে বিজয় লাভ করে।

স্পেনে মুসলিমদের এই বিশাল জয়ের খবর শুনে তড়িঘড়ি করে স্পেনে আসেন মুসা বিন নুসাইর। এরপর তারিক বিন জিয়াদ এবং মুসা বিন নুসাইর দুই বীর সেনাপতি মিলে আইবেরিয়ান উপদ্বীপের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করেন চরম সাহসিকতা আর বীরত্বের সাথে। এ বিজয়ের পর প্রায় সাড়ে সাতশ বছরেরও বেশি সময় ধরে স্পেন মুসলিম সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। আর এ বিজয়গুলো এত কম সময়ের মধ্যে, আর এত সফলভাবে এসেছিল যে তারিক বিন জিয়াদের নাম মধ্যযুগের মুসলিম শাসনের ইতিহাসে খুব মর্যাদার সাথে উচ্চারিত হয় আজও।

লেখকঃ ইতি মল্লিক

1 মন্তব্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে