তিতুমীর আর বাঁশের কেল্লা, ইতিহাসে এই দু’টো শব্দ একটি অন্যটির সমার্থক হয়ে গেছে অনেকটা। তিতুমীর নামক একজন ব্যক্তি একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেছিলেন- এ কথা ইতিহাস জানা এবং না জানা প্রায় সকল বাঙালীরই জানা। তবে, কে ছিলেন এই তিতুমীর? কেন বানিয়েছিলেন বাঁশের কেল্লা? পরিণতি কি হয়েছিল তার?- এ প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়ত ইতিহাস না জানা অনেকেরই জানা নেই। যাদের জানা নেই চলুন জেনে আসি।
সৈয়দ মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর, ওয়াহাবীবাদ বা ওয়াহাবী আন্দোলন নামে ইসলাম ধর্মের এক ধর্মীয় আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী নামেই ইতিহাসে জায়গা করে আছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন, কাজেই, বুঝতে পারছেন, তার জন্ম হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, ১৭৮২ সালে। জন্মেছিলেন তৎকালীন চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটের চাঁদপুর গ্রামের (যা বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত) এক মুসলিম পরিবারে।
তিতুমীরের পিতা ছিলেন সৈয়দ মীর হাসান আলী এবং মাতা আবিদা রোকাইয়া খাতুন। তার পরিবারের লোকেরা নিজেদের হযরত আলীর(রাঃ) বংশধর বলে দাবি করতেন। কথিত আছে, তাঁর এক পূর্বপুরুষ সৈয়দ শাহাদাত আলী ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব থেকে বাংলায় আসেন। বাংলায় এসে শাহাদাত আলীর বংশধরগণ ‘মীর’ ও ‘সৈয়দ’ উভয় পদবীই ব্যবহার করতেন।
তিতুমীর প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ গ্রহন করেন তার নিজ গ্রামেই। মুসলিম পরিবারের সন্তান বলে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায়ও কিছুদিন পাঠ নেন। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তিতুমীর কোরানের হাফেজ হন এবং হাদিস বিষয়ে পান্ডিত্যের কারণে সুনাম অর্জন করেন। কোরান-হাদীসের পাশাপাশি তিতুমীর বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষারও পাঠ গ্রহণ করেন।
৪০ বছর বয়সে, ১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় যান পবিত্র হজ্জব্রত পালনের জন্য। সেখানে তার পরিচয় হয় সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভীর সাথে। সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভী ছিলেন ভারতের একজন মুসলিম সংস্কার আন্দোলনের নেতা। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলাসহ সমগ্র ভারতবর্ষব্যাপী তিনি এক সুসংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তার এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ও ভারতে একটি অখন্ড ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তৎকালীন ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের অন্ধ্র প্রদেশ থেকে শুরু করে মর্দান পর্যন্ত, বিশাল অঞ্চলে সৈয়দ আহমেদ ব্রেলভী ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ইসলামী শাসনব্যবস্থা চালু করেছিলেন।
সেই আহমেদ ব্রেলভীর সংস্পর্শে এসে তিতুমীর তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তখনই তিনি ওয়াহাবী মতাদর্শে অনু্প্রাণিত হন। হজ্জ শেষে ১৮২৭ সালে দেশে ফিরে এসে তিতুমীর তার গ্রামের গরীব কৃষকদের একত্রিত করেন এবং তাদের নিয়ে শুরু করেন জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আন্দোলন। প্রাথমিক পর্যায়ে তাঁর আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার।
মুসলিম সমাজে শিরক ও বিদআতের অনুশীলন নির্মূল করা এবং মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামের অনুশাসন অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করাই ছিল তিতুমীরের আন্দোলনের প্রাথমিক লক্ষ্য। কিন্তু পরবর্তীতে তিতুমীরের শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে অত্যাচারী জমিদারগণ তাঁর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ সৃষ্টি এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইংরেজদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করলে তিতুমীরের আন্দোলন রুপ নেয় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে।
মাদ্রাসায় অধ্যয়নকালেই তিতুমীর পালোয়ান হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন খ্যাতিমান কুস্তিগীর। একসময় তিনি জমিদারের লাঠিয়াল হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। তাই আন্দোলন শুরূ করলে, অত্যাচারী জমিদারদের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন। জমিদারদের অত্যাচার মোকাবিলা এবং কৃষকদের নিরাপত্তা দানের লক্ষ্যে তিতুমীর এক মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেন। এবং তাদের লাঠি ও অপরাপর দেশীয় অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ দান করেন।
আন্দোলনের শুরুতেই তিতুমীর বাহিনী তৎকালীন হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ধুতির বদলে ‘তাহবান্দ’ নামের এক ধরনের কাপড় পরতে শুরু করে। তিতুমীর হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের উপর আরোপিত ‘দাঁড়ির খাজনা’ এবং ’মসজিদের কর’ এর তীব্র বিরোধিতা করেন। আন্দোলন চলতে থাকলে ধীরে ধীরে তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। তার অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে যখন ৫০০০ এ পৌঁছায়, তখন তিতুমীর তার বাহীনিকে নিয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হন।
অচিরেই তিতুমীর বাহিনী বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া ও ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। সেই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তাঁরা একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। বাঁশ এবং কাদা দিয়ে তারা নির্মাণ করেন দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এ কেল্লা।
তিতুমীরের শক্তি বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে জমিদারগণ তাঁর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ সৃষ্টি এবং তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইংরেজদের সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালায়। অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তিতুমীর বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে তিতুমীর স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
যুদ্ধের কিছু আগে, অসম সাহসী তিতুমীর তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বলেন “ভাইসব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াই এ হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে । আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।”
যুদ্ধে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে ১০০ অশ্বারোহী, ৩০০ স্থানীয় পদাতিক, দুটি কামানসহ গোলন্দাজ সৈন্যের এক নিয়মিত বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। কিছু সাধারণ তলোয়ার আর হালকা অস্ত্র-সস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতেই পারে নি।
তিতুমীর বাহিনী পিছু হটে আশ্রয় নেয় বাঁশের কেল্লায়। ইংরেজরা কামানে গোলাবর্ষণ করে কেল্লা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। বিপুল সংখ্যক মুজাহিদ প্রাণ হারায়। বহুসংখ্যক অনুসারীসহ তিতুমীর তিতুমীর যুদ্ধে শহীদ হন ১৯ নভেম্বর ১৮৩১ সালে। তিতুমীরের মুজাহিদ বাহীনির অধিনায়ক গোলাম মাসুমসহ ৩৫০ জন মুজাহিদ ইংরেজদের হাতে বন্দি হন। গোলাম মাসুমকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হয়। ১৪০ জন বন্দিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়।
অনেক ঐতিহাসিক, তিতুমীরের লড়াইকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় আখ্যা দেন। কারণ, মূলত হিন্দু জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিতুমীর যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। আবার একথাও সত্য যে, তিতুমীর প্রজাদের একজোট করেছিলেন ধর্ম এবং জিহাদের কথা বলে। তাই তারা তিতুমীরকে বীর যোদ্ধা বা সমাজ সংস্কারক কোন উপাধীতেই ভূষিত করতে রাজী নয়।
আবার অনেক ইতিহাসবিদদের মতে, তিতুমীরের লক্ষ্য ও পথ ছিল ইসলামে পূর্ণ বিশ্বাস, তবু, হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের অত্যাচারীত কৃষকদের সাথে নিয়ে ইংরেজ মদতপুষ্ট জমিদার ও নীলকরদের বিরোধিতা করাই ছিল তার লক্ষ্য। তিতুমীরের আক্রমের লক্ষ্যবস্তু হিন্দুদের পাশাপাশি ধনী মুসলমানও ছিল। তার বক্তৃতা শোনার জন্যে দলে দলে হিন্দু মুসলিম কৃষকের জমায়েত হতো। তাদের মতে, তিতুমীরের এই সংগ্রাম ছিল প্রকৃত কৃষক বিদ্রোহ, যার উদ্দেশ্যে ছিল অত্যাচারী জমিদার ও নীলকর সাহেবরা।
তিতুমীর অত্যাচারী জমিদার, নীলকর, বা ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারেন নি ঠিকই, কিন্তু, তিনি গরীব আর অত্যাচারী কৃষকদের ঠিকই শিখাতে পেরেছিলেন অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। তাইতো, তিতুমীর এবং তার মত আরও অনেক সাহসী বিপ্লবী, ও সমাজ সংস্কারকদের হাত ধরেই একদিন বাংলার কৃষকরা মুক্ত হতে পেরেছিল অত্যচারী জমিদার, নীলকর, ও ব্রিটিশদের কঠোর আর অন্যায় শাসনের বেড়াজাল থেকে। তাই ইতিহাস কৃতজ্ঞ তার মত বীরদের সাহসীকতার কাছে- একথা বললে খুব বেশি ভুল হবে না বলেই বোধ হয়।
লেখাঃ ইতি মল্লিক