ফ্লাইট নাইনটিনের অন্তর্ধানঃ বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের অমিমাংসিত রহস্য

0
বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল
যুক্তরাষ্ট্রের নৌ- ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক (যুদ্ধ ছাড়া) ক্ষতি হয় ইউএসএস সাইক্লপস (USS Cyclops) নামের বিমান বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে নিখোঁজ হয়ে গেলে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে । ১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর, প্রশিক্ষণ চলাকালে আমেরিকার পাঁচটি টিভিএম আভেঞ্জার টর্পেডো বোমারু বিমানের একটি দল রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায় আটলান্টিক মহাসাগরে। বিমানগুলোকে একসাথে বলা হয় ফ্লাইট নাইনটিন। ফ্লাইট নাইনটিনের এয়ারক্রাফটগুলোর ট্রেনিং চলাকালে এর লিডার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের চার্লস ক্যারোল টেইলর, যার আড়াইশো ঘন্টা এধরণের এয়ারক্রাফট চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল। অর্থ্যাৎ সে ছিল খুবই দক্ষ এবং অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক। উপরন্তু ৫ ডিসেম্বর এয়ারক্রাফটগুলো আকাশে ওড়ার আগে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা হয়েছিল সেগুলোতে কোন ত্রুটি নেই। বিমানগুলোর ট্যাংকও ছিল ফুয়েল ভর্তি। মোট কথা কোন সমস্যা ছিলনা সেগুলোতে।

কিন্তু তারপরও বিমানগুলো যখন প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্যে সেদিন উড়তে শুরু করেছিল আটলান্টিক মহাসাগরের উপর দিয়ে , আকাশে উড়ার ৪৫ মিনিটের মাথায় বিমানগুলির একটি থেকে একজন ক্রু রেডিওতে অদ্ভূত ধরণের এক এলার্ট পাঠায়, যে এলার্ট শুনতে পায় ফ্লোরিডার উপকূলে উড়তে থাকা অন্য এক বিমানের পাইলট রবার্ট এফ. কক্স। ফ্লাইট নাইনটিনের একজন ক্রু কম্পাস পরীক্ষা করে জানায় যে, ‘আমরা জানি না আমরা কোথায় আছি। আমরা শেষবারে বাঁক নেবার পর নিশ্চয়ই হারিয়ে গেছি।’ কিছু সময় পরে ফ্লাইট নাইনটিনের অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক লেফটেন্যান্ট চার্লস ক্যারোল টেইলর জানায়, তাদের কাছে থাকা কম্পাসের একটিও কাজ করছে না। কোন কিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না, এমনকি সাগরের পানিও অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এধরনের বার্তা পাঠানোর কিছু সময়ের মধ্যে ফ্লাইট নাইনটিন তার চৌদ্দ জন ক্রুর সকলকে নিয়ে সমুদ্রে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। বিমান বা বিমানের মধ্যে থাকা ক্রুদের আর কখনওই কোন খোঁজ মেলেনি। কাঁপা কাঁপা গলায় নেভাল স্টেশনকে দেয়া টয়লারের শেষ বার্তা ছিলো – ‘ ওরা দেখতে অবিকল…… ! ‘ বাকী কথাগুলো আর শেষ করতে পারেন নি টেইলর ।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল
১৯৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর, আমেরিকার পাঁচটি টিভিএম আভেঞ্জার টর্পেডো বোমারু বিমানের একটি দল রহস্যজনকভাবে হারিয়ে যায় আটলান্টিক মহাসাগরে।

নেভি তদন্তকারীরা, নেভিগেশনের ভুলের কারণে বিমানের জ্বালানীশূন্যতাকে বিমান নিখোঁজের কারণ বলে চিহ্নিত করে। ফ্লাইট নাইনটিন হারিয়ে গেলে সেগুলোর অনুসন্ধান এবং উদ্ধারের জন্য পাঠানো হয় পিভিএম ম্যারিনার নামে একটি বিমান। কিন্তু ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, উদ্ধারকারী বিমানটিও হারিয়ে যায় তার ১৩জন ক্রুকে নিয়ে প্রায় একইভাবে। সেসময়, ফ্লোরিডা উপকূলে থাকা একটি ট্যাঙ্কার একটি বিস্ফোরণ দেখার রিপোর্ট করে , ব্যাপক তেল দেখার কথাও বলে, কিন্তু উদ্ধার অভিযানে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনা শেষে আবহাওয়াও দুর্যোগপূর্ণ হয়ে উঠে। বেশি সময় উদ্ধার অভিযান চালানো তাই আর সম্ভব হয়ে ওঠে নি। ফ্লাইট নাইনটিনের সাথে সাথে উদ্ধারকারী বিমানটিও এমনভাবে হারিয়ে যায় যে, সেগুলো যেন একরকম বাতাসে মিলিয়ে গেছে। সেগুলোর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি আর কখনোই, পাওয়া যায়নি কোন ধ্বংসাবশেষ। ঠিক যেন, রহস্যে মিলিয়ে গিয়েছিল ফ্লাইট নাইনটিন এবং উদ্ধারকারী বিমানটি।

যে জায়গায় ফ্লাইট নাইনটিন এবং উদ্ধারকারী বিমানটি নিখোঁজ হয়েছিল, সেই জায়গাটি বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নামে পরিচিত। রহস্যময় বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, কুখ্যাতির জন্য যে জায়গাটিকে শয়তানের ত্রিভুজ বলেও ডাকা হয়। এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে নিয়ে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের রহস্য, শ্রুতিকথা, গুজব এবং গল্প। বারমুডা টায়াঙ্গলকে নিয়ে যেসকল গল্প প্রচলিত রয়েছে তার সারমর্ম অনেকটা এমন, আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত এ সামুদ্রিক এলাকায় অদ্ভুতভাবে হারিয়ে যায় মানুষ, জাহাজ আর উড়োজাহাজ। রেখে যায়না কোনো ধ্বংসাবশেষ। এ এলাকায় প্রবেশ করার পরে কম্পাসের কাঁটাও নাকি ঠিক মত কাজ করে না। এসকল গল্প-উপকথা বেশি ডালপালা মেলে ফ্লাইট নাইনটিনের নিরুদ্দেশের পর।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, ক্যারিবীয় সাগরের মধ্যে অবস্থিত কল্পিত ত্রিভুজাকৃতির বিশেষ একটি এলাকা। এ ত্রিভুজাকৃতি এলাকার এক কোণে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, আর এক কোণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপ এবং তৃতীয় কোণটিতে অবস্থিত পুয়োর্তো রিকো। বারমুডা টায়াঙ্গেলের সঠিক অবস্থান বা আয়তন নিয়ে অবশ্য কিছুটা মতভেদ আছে।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গল
বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, ক্যারিবীয় সাগরের মধ্যে অবস্থিত কল্পিত ত্রিভুজাকৃতির বিশেষ একটি এলাকা। এ ত্রিভুজাকৃতি এলাকার এক কোণে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, আর এক কোণে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বারমুডা দ্বীপ এবং তৃতীয় কোণটিতে অবস্থিত পুয়োর্তো রিকো।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে নিয়ে যেসব গল্প ও উপকথা প্রচলিত তার শুরু সম্ভবত পনের শতকের দিকে, ক্রিস্টোফার কলোম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পূর্বে। কলম্বাস সেসময় জাহাজে করে ঘুরছিলেন পৃথিবীর নতুন কোন ভুখন্ড আবিষ্কারের খোঁজে। আটলান্টিক মহাসাগরের এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের কাছে এসে হঠাৎ এক রাতে তিনি এবং তার জাহাজের নাবিকেরা দেখলেন বাতাসে অতি উজ্জ্বল এক সারি আলোর নাচানাচি। সেসময় কি কারণে জানি একধরণের ধোঁয়ায় ছেয়ে গিয়েছিল চারপাশ। এমন অবস্থার মধ্যে যখন তার জাহাজের নাবিকেরা ভীত হয়ে পড়েছিল ঠিক তখনই তিনি লক্ষ্য করেন, তার কম্পাসের কাঁটা ঠিকমত কাজ করছে না। সেটা উল্টাপাল্টা দিক নির্দেশ করছে। কি কারণে সেই জায়গায় এমন হয়েছিল কলম্বাস বা তার জাহাজের নাবিকেরা এর কোন ব্যাখ্যা খুঁজে পায়নি। ১৪৯২ সালে কলম্বাস তাঁর লগ বুকে এ অদ্ভুত ঘটনা লিখে রেখেছিলেন।

সেসময় এ ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও বর্তমানে অনেক বিশেষজ্ঞ সে ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে- নাবিকেরা যে আলো দেখেছেন তা হয়ত স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত নৌকায় রান্নার কাজে ব্যবহৃত আগুন। আর কম্পাসে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল সম্ভবত নক্ষত্রের অবস্থান পরিবর্তনের কারণে। কে জানে প্রকৃত ঘটনা কি!
কলম্বাসের সেই ঘটনার পর আরও অনেক কাহিনী, উপকথার জন্ম হয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে নিয়ে। কিন্তু এ নিয়ে লেখালেখি আর তেমন একটা হয়নি অনেক বছর ধরে। কিন্তু ১৯৪৫ সালে যখন ফ্লাইট নাইনটিন রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেল, তখন বারমুডা ট্রায়াঙ্গল আবারও ব্যাপক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হলো। নতুন করে মানুষের আগ্রহ সৃষ্টি হলো বারমুডা ট্রায়াঙ্গল নিয়ে। এরই প্রেক্ষিতে প্রথমবারের মত সংবাদপত্রে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলকে নিয়ে লিখলেন, আমেরিকার সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস বা এপির সাংবাদিক ই.ভি.ডব্লিউ জোন্স ১৯৫০ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। এরপর থেকেই সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি হতে থাকল বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্য নিয়ে। লেখা হতে থাকল বিভিন্ন বই। টেলিভিশনে তৈরি হতে থাকল এ নিয়ে নানা অনুষ্ঠান। পৃথিবী ব্যাপী ই ব্যাপকভাবে আলোচিত হতে থাকল বারমুডা ট্রায়াঙ্গল।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গলে এমনি আরও অনেক বিমান ও জাহাজ ডুবির ঘটনা রয়েছে। যেমন, যুক্তরাষ্ট্রের নৌ- ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক (যুদ্ধ ছাড়া) ক্ষতি হচ্ছে ইউএসএস সাইক্লপস (USS Cyclops) নামের বিমান নিখোঁজ হয়ে যাওয়া। অতিরিক্ত ম্যাঙ্গানিজ আকরিক ভর্তি বিমানটি ১৯১৮ সালের ৪ মার্চ বার্বাডোস দ্বীপ থেকে উড্ডয়নের পর একটি ইঞ্জিন বিকল হয় এবং ৩০৯ জন ক্রুসহ নিখোঁজ হয়। যদিও কোন শক্ত প্রমান নেই তবুও অনেক কাহিনি শোনা যায়। কারো মতে ঝড় দায়ী, কারো মত ডুবে গেছে আবার কেউ এই ক্ষতির জন্য শত্রুপক্ষকে দায়ী করে। কেউ বা আবার রহস্যের গন্ধ পায় এ ঘটনার পেছনে।

বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল
যুক্তরাষ্ট্রের নৌ- ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক (যুদ্ধ ছাড়া) ক্ষতি হয় ইউএসএস সাইক্লপস (USS Cyclops) নামের বিমান বারমুডা ট্রায়াঙ্গালে নিখোঁজ হয়ে গেলে

২৮ ডিসেম্বর ১৯৪৮ সালে একটি ডগলাস ডিসি – ৩, ফ্লাইট নাম্বার NC16002, সান জুয়ান, পুয়ের্তো রিকো থেকে মিয়ামি যাওয়ার পথে নিখোঁজ হয়। বিমান থাকা ৩২ জনসহ বিমানটির কোন হদিস পাওয়া যায়নি। সিভিল এরোনটিক্স বোর্ড তদন্ত নথিপত্র থেকে বিমানটি নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাব্য একটি কারণ পাওয়া যায়, সেটি হল – বিমানের ব্যাটারি ঠিকমত চার্জ না করে পাইলট সান জুয়ান থেকে রওনা দেয়। কিন্তু এটা সত্যি কিনা তা জানা যায়নি। এটিকেও অনেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যের সাথে মিশিয়েছেন।

এমনি আরও অনেক বিমান ও জাহাজডুবির ঘটনা রয়েছে এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গল কে ঘিরে। অনেকেই বলেছে এগুলো নিছক দূর্ঘটনা, আবার অনেকেই এর মধ্যে রহস্য খুঁজেছে। হয়তো যৌক্তিক কোন ব্যাখ্যা ছিল বিমান এবং জাহাজগুলি নিখোঁজের পেছনে। কিন্তু কি সেই কারণ এটা কারো পক্ষেই আজ পর্যন্ত ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। তাই এইসকল রহস্যকে অনেকেই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের সাথে জড়িয়ে দিয়ে স্বস্তি খুঁজেছে, হয়েছে রোমাঞ্চিত। রহস্যপ্রিয় মানুষ এর মধ্যেই খুঁজে নিয়েছে আনন্দ।

যারা যৌক্তিকভাবে চিন্তা করেছে তারা অনেকে ব্যাখ্যা করেছে এভাবে, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের কারণে সাগর-মহাসাগরের অনেক জায়গায়ই প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হয়। অনেক এলাকায়ই জাহাজ বা ‍উড়োজাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে, বারমুডা ট্রায়াঙ্গলও তেমনই একটি জায়গা। এর মধ্যে রহস্যের কিছু নেই।
যারা রহস্যপ্রিয় তারা আবার ব্যাখ্যা করেছে অন্যভাবে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে রং চড়িয়ে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে। সৃষ্টি করেছে গল্প আর উপকথার। এ গল্পগুলো নিয়ে টিভিতে বিভিন্ন রকম শো হয়েছে, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে- তবে সেগুলো নিতান্তই গল্প…সেগুলোর বেশিরভাগেরই সত্যতা মেলেনা। বলা হয় যে, মিথ্যে রহস্য তৈরি করা বেশ লাভজনক। কারণ, মিথ্যে রহস্যের উপর ভিত্তি করে বই লিখে, খবর তৈরি করে বা টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করে প্রচুর অর্থ কামানো যায়।

কে জানে বারমুডা ট্রায়াঙ্গলের রহস্যের কতটুকু সত্যি আর কতটুকু গল্প! সত্যিই কি কোন রহস্যে রয়েছে এ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে ঘিরে নাকি পুরোটাই মিথ!

বারমুডা ট্রায়াঙ্গাল
সত্যিই কি কোন রহস্যে রয়েছে এ বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলকে ঘিরে নাকি পুরোটাই মিথ!

লেখক- ইতি মল্লিক