সোনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন, সাফল্য-ব্যর্থতা ও তাঁকে নিয়ে যত বিতর্ক

0
সোনিয়া গান্ধী

প্রথম পর্বে রাজীব গান্ধীর সাথে সোনিয়া গান্ধীর কিভাবে প্রেম ও বিয়ে হলো, কিভাবে একজন ইতালিয়ান তরুণী ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে বধু হয়ে আসলেন সে বিষয়ে লেখা হয়েছিল। এই পর্বে  সোনিয়া গান্ধীর রাজনৈতিক জীবন, তাকে নিয়ে যত বিতর্ক সেসব নিয়ে লিখবো। প্রথম পর্ব পড়তে চাইলে নিচের লিংক থেকে পড়ে নিতে পারেন।

লিংকঃ সোনিয়া গান্ধী :সাধারণ পশ্চিমা তরুণী থেকে ভারতীয় বধু হয়ে অসাধারণ হয়ে ওঠা (প্রেম ও বিবাহ অধ্যায়)

১৯৮০ সালে বিমান দূর্ঘটনায় সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যু, ১৯৮৪ সালে দেহরক্ষীর গুলিতে ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকান্ড ও ১৯৯১ সালে তামিল টাইগারদের পাঠানো আত্নঘাতী নারীর বোমা হামলায় রাজীব গান্ধীর হত্যাকান্ড। ১০ বছরে ৩ হত্যাকান্ড গান্ধী পরিবারকে দুর্বল করে দেয়। নেতাকর্মীরা সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ করলেও সেটা প্রত্যাখান করেন সোনিয়া। বাইরের জীবন থেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। নিজের দুই সন্তানকে আগে শিক্ষা দীক্ষায় বড় করতেই মনযোগী হন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী হলেন নরসিমা রাও। কিন্তু কমতে থাকলো কংগ্রেসের জনপ্রিয়তা। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ভাল করতে পারলো না কংগ্রেস। বিজেপির ১৬১ আসনের বিপরীতে কংগ্রেস পেল ১৪০ আসন। কিছুদিন পরেই মৃত্যু হয় নরসিমা রাওয়ের। কংগ্রেসের সভাপতি হলেন সিতারাম কেশরী। কিন্তু সিতারাম কেশরীর উপর অনাস্থা দেখিয়ে ভাঙন শুরু হল কংগ্রেসে। মমতা ব্যানার্জী, পি. চিদাম্বরন, মাধবরাও সিন্ধিয়া সহ বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রসের শীর্ষস্থানীয় নেতা কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে। প্রতিষ্ঠার পর সবচেয়ে বড় সংকটে পড়ে কংগ্রেসে।

নেতাকর্মীরা আকুতি জানালো সোনিয়ার কাছে। কংগ্রেস কে বাঁচাতে হাল ধরতে  এবার এগিয়ে আসলেন সোনিয়া। পুত্র ও কন্যা বড় হয়েছে, ফলে সংসারের দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে পুরোপুরি নেমে পড়লেন রাজনীতির মাঠে।  ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের সভাপতি হলেন সোনিয়া।  ততদিনে তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে ইউরোপের কোন নারী। একেবারে যেন ভারতীয় নারীর প্রতিচ্ছবি!

সোনিয়া গান্ধী
ততদিনে তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে ইউরোপের কোন নারী। একেবারে যেন ভারতীয় নারীর প্রতিচ্ছবি!

একসাথে অনেকজন নেতা বের হয়ে নতুন নতুন দল (যেমন মমতা ব্যানার্জী পশ্চিমবঙ্গে তৃণমুল কংগ্রেস নামে নতুন দল করেন) গঠন করায় নড়বড়ে অবস্থানে কংগ্রেস। ১৯৯৯ সালেই নির্বাচন। নড়বড়ে দলে ঐক্য ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা শুরু করলেন সোনিয়া কিন্তু তখনি মুখোমুখি হলেন এক কঠিন ও তিক্ত সত্যের। নিজের দলেরই কয়েকজন শীর্ষ নেতা সোনিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। নির্বাচনে জিতলে সোনিয়া প্রধানমন্ত্রী হবেন, কিন্তু একজন বিদেশীকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে দিবে না তারা। এই বিদ্রোহীদের তালিকায় ছিল শারদ পাওয়ার, তারিক আনোয়ারের মত শীর্ষস্থানীয় নেতারা। ৩০ বছর ধরে নিজেকে আমূল বদলে পুরোপুরি ভারতীয় হয়ে গেলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর চাইলে ইউরোপে চলে যেতে পারতেন, তা না করে সবকিছু থেকে দূরে থেকে সন্তানদের নিয়ে কাটিয়ে দিলেন তাঁকেই বিদেশি বলে নিজ দলের নেতারাই বিরুদ্ধে দাঁড়াল!  বিস্মিত সোনিয়া পদত্যাগ করতে চাইলেন। কিন্তু অন্যান্য নেতা কর্মীরা সোনিয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে দাঁড়ালো। শেষ পর্যন্ত সোনিয়া সভাপতি হয়েই রইলেন। আরেকবার ভাঙলো কংগ্রেস। দল থেকে বের হয়ে নতুন দল করলো শারদ পাওয়ার, আইকে গুজরাল, তারিক আনোয়ার, পিএ সাংমার মত নেতারা।

ভাঙন কবলিত দল নিয়ে ১৯৯৯ সালের নির্বাচনে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয় সোনিয়া। বিভিন্ন প্রদেশের সাবেক নেতারা আলাদা দল করায় এটা অনেকটা অনুমিতই ছিল। আসন সংখ্যায় নির্বাচনে হেরে গেলেও আগেরবারের চেয়ে ২.৫ ভাগ ভোট বাড়ে কংগ্রেসের। নিজে আমেথি ও বেলেরি থেকে বিজয়ী হন। বেলেরিতে বিজেপির হেভিওয়েট প্রার্থী সুষমা স্বরাজকে (বর্তমানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) পরাজিত করেন। লোকসভায় বিরোধী দলীয় নেতা হলেন সোনিয়া।

বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে সংসদীয় রাজনীতি ভালোভাবেই শিখে গেলেন সোনিয়া। বিপদগ্রস্ত কৃষক আর আশাহত বেকারদের নিয়ে দেশব্যাপী ক্যাম্পেইন করে কংগ্রেস ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় কিন্তু সরকার গঠনের মত আসন পায় না। ফলে অন্য দলের সাথে জোটবদ্ধভাবে সরকার গঠন করতে হয়।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কে হবে? সোনিয়া ছাড়া আর কে?

সেটাই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সোনিয়াকে আরেকবার দেখতে হলো রাজনীতির কদর্যতা।বিদেশি কোন নারীকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানবে না বলে হুশিয়ারি দেয় বিজেপি, শিবসেনা সহ উগ্রবাদী সংগঠন। বিদেশি কোনো নাগরিক ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলে কঠোর আন্দোলনের হুমকি দেয় তারা। অথচ ১৯৮৩ সালে সোনিয়া ভারতীয় নাগরিকত্ব পান। এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইতালীর নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায় কারণ ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ইতালি দ্বৈত নাগরিকত্বের অনুমতি দেয়নি।

বিতর্ক ও দেশজুড়ে বিক্ষোভ, দাঙ্গা এড়াতে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার ঘোষনা দেন সোনিয়া। লক্ষ লক্ষ কংগ্রেস নেতা কর্মী সোনিয়াকে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু সোনিয়া বিনীতভাবে তাদের অনুরোধ করেন তার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে। তিনি জানান এই মুহুর্তে সবচেয়ে জরুরী একটি স্থিতিশীল ধর্ম নিরপেক্ষ সরকার গঠন করা। আমি সেটাই করছি। প্রধানমন্ত্রীত্ব আমার লক্ষ্য নয়। নেতাকর্মীদের বারবার দাবী সত্ত্বেও দেশব্যাপী সহিংসতার আশংকায় এবং উগ্রবাদী দলগুলোর হাতে ইস্যু তুলে না দিতে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দিলেন সোনিয়া। সুযোগ পেয়েও প্রধানমন্ত্রী পদ না নেওয়ার ঘটনা ইতিহাসে বিরল, তাও আবার ভারতের মত বৃহৎ ও উঠতি সুপারপাওয়ার দেশের।  দ্যা গার্ডিয়ানের ভাষায় “Sonia Gandhi declines Indian prime ministership.”

প্রধানমন্ত্রী বানালেন মনমোহন সিং কে। নিজে থাকলেন কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে।  সরকার গঠন করে সবচেয়ে বড় যে কাজে শুরুতেই হাত দিয়েছিলেন সেটা হল National Rural Employment Guarantee Act 2005 – গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের জীবিকার নিশ্চয়তা তথা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগ ভারতে মাইলফলক হয়ে থাকবে।

পরের নির্বাচনেও যখন জিতলো কংগ্রেস অনেকেই ভেবেছিল এবার হয়ত প্রধানমন্ত্রী হবে রাহুল গান্ধী। কিন্তু আবারো সেই মনমোহন সিং-ই হলেন প্রধানমন্ত্রী। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে এই সিদ্ধান্ত ছিল সোনিয়ার চরম ভুল সিদ্ধান্ত। মনমোহনের অতীত যোগ্যতা ও সততা নিয়ে কারো প্রশ্ন ছিল না কিন্তু ৭৮ বয়সে উপনীত হওয়া মনমোহনকে ভারতের জন্য উপযুক্ত মনে করেন না তারা। ভারতের মত দেশে তুলনামূলক তরুণ ও ‘এনার্জেটিক’, বক্তৃতায় পটু কাউকেই দরকার প্রধানমন্ত্রী পদে। বিশেষ করে তরুণ ভোটার দের আকর্ষণ করতে মনমোহন যোগ্য নয়। বিশ্লেষকদের অনুমান সত্য করে পরের নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে কংগ্রেসের! তবে কি নিজেকে বেশি উদার প্রমাণ করতে গিয়ে দলেরই ক্ষতি করলেন সোনিয়া? বিজেপি সহ উগ্রবাদী দলগুলো যা চাইতো সে অনুযায়ী  তার ‘স্যক্রিফাইস’ বিজেপিকে সুযোগ করে দিল?

সোনিয়া গান্ধী
২য় মেয়াদে মনমোহন সিং-কে প্রধানমন্ত্রী করা কি সোনিয়ার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?

তবে আবার অন্য বিশ্লেষকদের মতে সোনিয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সাধারনত পরপর দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকলে সেই দলের জনপ্রিয়তা কমে যায় এমনিতেই। বিরোধী দলের জেতার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সেকারনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের জেতার সম্ভাবনা নেই বুঝেই সোনিয়া রাহুলকে আনেননি যাতে তরুণ রাহুলের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে আগেই কোন ব্যার্থতার কালি না লাগে। বরং ২০১৯ বা ২০২৪ এ যেন কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে এবং রাহুল প্রধানমন্ত্রী হতে পারে সেটাই লক্ষ্য নির্ধারণ করছিলেন সোনিয়া।

প্রায় ২০ বছর সভাপতি থাকার পর (কংগ্রেসের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী সভাপতি, ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ১৮ বছর) ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি পুত্র রাহুল গান্ধীর হাতে দায়িত্ব দিয়ে কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। তার সময়কালে কংগ্রেস যেমন সাফল্য পেয়েছে, ভাঙণের ক্ষতি সামলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে তেমনি দেখেছে চরম ব্যর্থতা। ২০০৪ ও ২০০৯ সালের নির্বাচনে জিতে দুই মেয়াদে সরকার গঠন করতে পারলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ফল দেখতে হয়। বিজেপির ৩৮৩ আসনের বিপরীতে মাত্র ৪৪ টি আসনে জয়ী হয় কংগ্রেস।

সোনিয়াকে ঘিরে বিতর্কও যে কম হয়েছে তা নয়। স্বামী রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সুইডেনের বেফোর্স কোম্পানির কাছ থেকে সামরিক অস্ত্র কেনা নিয়ে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। সুইডেনের এই কোম্পানি ও ভারত সরকারের মাঝে মধ্যস্ততাকারী ছিলেন ইতালিয়ান ব্যবসায়ী ওটাভিও কোয়াট্টোরচি। অভিযোগ করা হয় এই ইতালিয়ান ব্যবসায়ীর সাথে সোনিয়ার পারিবারিক সম্পর্ক ছিল। এছাড়া মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন বহুল প্রচলিত কথা ছিল মনমোহন আসলে পুতুল প্রধানমন্ত্রী। পেছনে সকল কলকাঠি নাড়েন সোনিয়া নিজেই। এমনকি অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহনে সোনিয়া নাকি ছিলেন স্বেচ্ছ্বাচারী। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে সোনিয়ার কথাই ছিল শেষ কথা। কংগ্রেস সরকারের দুই মেয়াদের অর্থ সম্পদও নাকি বেড়েছে কয়েকগুন। সোনিয়া গান্ধীর কন্যা প্রিয়াংকা গান্ধীর স্বামী রবার্ট ভদ্রকে নিয়েও কয়েকবার হয়েছে বিতর্ক।

তবে সোনিয়ার বিরুদ্ধে বিরোধীরা সবচেয়ে মারাত্নক যে অভিযোগ করে তা হলো সোনিয়া নাকি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির এজেন্ট। কেজিবির নির্দেশেই নাকি সোনিয়া রাজীবকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে গান্ধী পরিবারে প্রবেশ করে। এবং সোনিয়াকে ক্ষমতায় বসাতে একে একে পরিকল্পনা মাফিক সঞ্জয়, ইন্দিরা ও রাজীবকে হত্যা করা হয়।

তবে এ অভিযোগ পুরোটাই রাজনীতির মিথ্যাচার বলেই মনে হয়। প্রথম কথা সকল তথ্যপ্রমাণ সাক্ষ্য দেয় যে রাজীবই সোনিয়ার প্রেমে পড়ে। এবং রাজীবের আগ্রহেই তাদের প্রেম হয়। সোনিয়া রাজীবকে প্রলুব্ধ করেনি।আবার রাজীব পড়তো কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে। আর সোনিয়া ভর্তি হয় বেল কেমব্রিজ নামের ভাষা ইনস্টিটিউটে ইংরেজি ভাষা শিক্ষা কোর্সে। কেজিবি যদি সোনিয়া কে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিত তাহলে রাজীবের কলেজেই ভর্তি করানোর কথা বা সে কলেজের কাউকেউ এজেন্ট বানানোর কথা। কারন প্রেম হওয়ার সম্ভাবনা ক্লাসমেটের সাথেই বেশি থাকে। সাড়ে ৫ মাইল দূরের কোথাও এজেন্টের ভর্তি হওয়ার কথা না। ভার্সিটির রেস্টুরেন্ট এর ওয়েটার করে প্রেম হওয়ার রিস্ক নেয়ার কথা না।  আবার রাশিয়ার সাথে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের সম্পর্ক এমনিতেই ভালো ছিল।

রাজীবের কলেজ ও সোনিয়ার কলেজের দুরত্ব ছিল সাড়ে ৫ মাইল

প্রেম হওয়ার পরে এজেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা শুধু তর্কের খাতিরেই মেনে নেয়া সম্ভব। যদি প্রেম হওয়ার পরেও এজেন্ট হয়, তাহলে রাজীব গান্ধীকে রাজনীতি আসার ক্ষেত্রে বাঁধা দেয়ার কথা না। রাজীবের মৃত্যুর পর নিজেরও রাজনীতি থেকে দূরে থাকার কথা না। পরে আবার যখন রাজনীতিতে এসে জয়লাভ করলেন তখনো প্রধানমন্ত্রীত্ব পদ ছেড়ে দেয়ার কথা না। এখানেও অবশ্য তর্কের সুযোগ থাকে। তর্কের খাতিরে ধরে নেয়া যায় স্বামীর মৃত্যু ভয়ে স্বামীকে রাজনীতিতে আসতে দিতে চাননি এবং নিজের মৃত্যু ভয়ে প্রধানমন্ত্রী হন নি সোনিয়া। কিন্তু কংগ্রেসের ১০ বছরের সরকার আমলে রাশিয়ার সাথে এমন কোন চুক্তি বা কোন তথ্য দিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।

রাশিয়ার কেজিবির এজেন্ট বলা ছাড়াও আরেকটি পক্ষ সোনিয়াকে খ্রিস্টান ধর্মের পোপ কর্তৃক নিযুক্ত এজেন্ট বলে। ভারতে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের সুবিধার্থে সোনিয়াকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ভারতের প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে প্রবেশ কয়ায় ক্যথলিক খ্রিস্টানদের সংগঠন ইতালির (ভ্যাটিকান সিটি) ক্যাথলিক চার্চ।

এসবের কোনটাই তথ্যদিয়ে প্রামণিত নয়, তাই সবই রাজনৈতিক স্বার্থে বিরোধীদের অপপ্রচার বলেই মনে হয়।

২০০৪ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনে সোনিয়াকে পৃথিবীর তৃতীয় ক্ষমতাধর নারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একই ম্যাগাজিনে ২০০৭ সালে ৬ষ্ঠ এবং ২০০৯ সালে ৯ম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে তার নাম আসে। সাধারন পোশাকে থাকা সোনিয়াকে ইন্দিরা গান্ধীর মতই স্টাইলিশ বলা হয়। পত্রিকায় তাঁকে উল্লেখ করা “সিম্পল স্টাইলিশ” বলে।

সোনিয়াকে নিয়ে ভারতে ও ভারতের বাইরে অনেকেই বই লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জেভিয়ের মুরোর ‘The Red Sari’।  কংগ্রেস ও গান্ধী পরিবার থেকে এসব বই এর অধিকাংশ তথ্য মিথ্যা বলে দাবী করা হয়েছে। সোনিয়া গান্ধীর সম্পাদিত ও লিখিত ৩টি বই আছে। সেগুলো হলো :

১। Indira Gandhi : Selected Sayings ২। Two Alone, Two Together (ইন্দিরা গান্ধী ও জহরলাল নেহেরুর মাঝে বিনিময় হওয়া চিঠি নিয়ে লেখা বই) ৩। Rajiv’s World

এছাড়া নিজের আত্নজীবনী নিয়ে একটা বই লেখার কথা আছে তার। যেখানে নিজের বিরুদ্ধে সকল অপপ্রচারের জবাব তিনি দিবেন বলে জানিয়েছিলেন।

৭১ বয়সী সোনিয়া হয়ত ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিবেন সবকিছু থেকে। কিন্তু উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়েই থাকবেন। শুধুই কি রাজনীতির ইতিহাসে? এখনো ভারতে সেরা প্রেমিক জুটির কথা আসলে রাজীব-সোনিয়া জুটির কথা আসে তালিকার প্রথম দিকেই। প্রেমের জন্য নিজেকে যে আমুল বদলে সম্পূর্ন নতুন পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে মানিয়ে নেয়া যায় সেটার উজ্জ্বল উদাহরণ তো সোনিয়া নিজেই! রাজনীতিবিদ হিসেবে কেমন ছিলেন সে বিতর্ক হয়ত থাকবে কিন্তু প্রেমিকা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে সোনিয়া গান্ধী তাকে নিয়ে বিতর্কের সুযোগ রাখেন নি।

সোনিয়া গান্ধী
প্রেমিকা হিসেবে, স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে সোনিয়া গান্ধী বিতর্ক করার সুযোগ রাখেন নি

লেখকঃ আসিফ আল রাজীব