বিরানব্বইয়ের বর্ষাকালে কোন এক সন্ধ্যায় সুটকেস ভর্তি বই আর একটি কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে উনিশ-বিশ বছর বয়সী তরুণ আনুরাগ সিনেমায় কাজ করবেন বলে মুম্বাইয়ের আন্ধেরি স্টেশনে যখন পদার্পণ করে,তার ধারণা ছিল না যে মুম্বাইয়ের বৃষ্টি টানা মাসের পর মাস চলতে পারে।তার এও ধারণা ছিল না যে স্বপ্নের প্লাটফর্ম ‘বলিউড’ কিছু ফিল্মফ্যামিলি দ্বারা শাসিত যারা বহিরাগতদের নিয়ে প্রচন্ড পরিমাণে ইনসিক্ইয়ুর।
মধ্যবিত্তদের স্টেরিওটাইপ্ড ‘ইঞ্জিনিয়ার’ হওয়ার স্বপ্নের বেড়াজাল ভেঙ্গে আনুরাগ সিনেমায় কাজ করবেন বলে ঠিক তো করেছিলেন,কিন্তু এবিষয় সম্পর্কে তার ধারণা ছিল শ্যূণ্যের কোটায়।বন্ধুর পরামর্শে নিউকামারদের স্বর্গ বলে পরিচিত ‘পৃথিবী’ থিয়েটারে গিয়ে তিনি দেখলেন এখানে কাজ পাওয়া তো দুরের কথা,ভেতরে ঢোকাই দায়।ছাত্রজীবনে মেধাবী আনুরাগ, ‘পৃথিবী থিয়েটার’-এ ঢুকলেন চা দেয়ার কাজে,তাও আবার ফ্রীতে। স্টেজ ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে অভিনেতাদের কাহিনী পড়ে শুনানো সবই করা শুরু করেন এখানে,ফ্রীতে কাজ করেন বলে কিছুটা জনপ্রিয়ও হয়ে গেলেন।
ইতিমধ্যে নিজের আরেকটি প্রতিভা আবিষ্কার করে ফেলেন আনুরাগ।পেজের পর পেজ গল্প লিখে যেতে পারেন তিনি।টেলিভিশনের ‘ডেইলি সোপ’ বিপ্লব তখন কেবল শুরুর দিকে।প্রত্যেকটি এপিসোডের জন্য নতুন গল্প দরকার,দ্রুত লিখায় প্রডিউসাররা ছুটে যেতেন আনুরাগের কাছে,আনুরাগ ক্রেডিটও চাইতেন না,পারিশ্রমিকও চাইতেন না।পর্দার আড়ালে অনেক টিভি শো-র সফলতার পিছনে আনুরাগের হাত ছিল,যে হাত অন্তরালেই থেকে যেত।কিন্তু হুমায়ুন আহমেদের ভাষায় বললে,’লেখকরা তো ভাই জোছনার আলো খেয়ে বাচে নারে ভাই,তাদেরও টাকা পয়সা লাগে”।আনুরাগের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হতে লাগলো।এক পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন আনুরাগ।
তখনই দৃশ্যপটে আবিভার্ব পাগলাটে ধরনের প্রডিউসার মাহেশ ভাটের।এক টিভি শো এর জন্য মাসে ১০০০০ রুপি পারিশ্রমিকে সাইন করালেন আনুরাগকে।অন্যদিকে রাম গোপাল ভার্মাকে ‘Satya’ র স্ক্রিপ্ট লিখে দিলেন ।’Satya’ মুক্তির পরে সফলতা পাওয়ার পর স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন আনুরাগ।
এতদিনে আনুরাগ বুঝে গিয়েছিলেন ইন্ডাস্ট্রির মানুষ নতুন কিছুই করতে অপারগ। আনুরাগের ভাষায়,’No one wanted to make movies that I wanted to make.I like to make people uncomfortable with my movies and These type of movies were not made”
জীবনের গ্যাম্বলিং এ আরেকটি ঝুকি নিলেন আনুরাগ,স্ক্রিপরাইটিংয়ের পারিশ্রমিক খরচ করে এবার সিনেমা বানাবেন বলে ঠিক করলেন।এক ক্যামেরাম্যানকে পটিয়ে ধার করা ক্যামেরা দিয়ে কিছু শর্ট ফিল্ম বানালেন।যেগুলোর বাজেট ছিল নিতান্তই কম। ভরা বাজারে অভিনেতাদের দিয়ে সিন শ্যুট করে বেরিয়ে যেতেন।কেউ ঘুর্ণাক্ষরে টের পেতো না।
২০০৫ সালে তার লেখা কানাডিয়ান সিনেমা ‘Water’ একাডেমী এওয়ার্ড জিতলে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে থেকে বানালেন ‘Black Friday’।ছবিটার প্লট ছিল ১৯৯২ এর মুম্বাই বম্বিংয়ের উপর।স্পর্শকাতর টপিক হওয়ায়, সেন্সরবোর্ড এপ্রুভ করে নি ছবিটি।তবুও দমে যাননি আনুরাগ।
জন আব্রাহামকে নিয়ে তৈরি সাইকোপ্যাথিক থ্রিলার ‘No Smoking’। বক্স অফিসে মুখ থুবগে পড়ে মুভিটি।কিন্তু ক্লাসি সেকশনের দর্শক ও ক্রিটিক্সের কাছে সমাদৃত হয় এই ছবিটি।
এরপর একে একে তৈরি করলেন, ‘Dev D’ ও ‘That girl in a Yellow Boot’। বক্স অফিসে সফলতা পায় নি এর কোনটিই।অবশ্য আনুরাগ সফলতাও খোজ করছিলেন না।তার লক্ষ্য ছিল নিজের সিনেমার একটা অডিয়েন্স বানানো।আনুরাগ বুঝতে পেরেছিলেন তরুণ প্রজন্মের অনেকেই ইউটরেন্ট থেকে মুভি ডাউনলোড করে।তার ভাষায় এসব ‘মুভি গিকরাই’ তার সিনেমা ফ্রেন্ডদের রেকমেন্ড করবে ,এভাবেই পাব্লিসিটি বাড়বে।আবার আনুরাগ বিদেশে নিজের সিনেমার সিডি ফ্রি টিস্ট্রিবিউট করেছেন,কোনও আয় ছাড়াই। ডার্ক মুভির জন্য আনুরাগের সৃষ্ট অডিয়েন্স তাকে রেসপন্স করে বলিউডের তর্ক সাপেক্ষে সেরা ডার্ক কমেডি ‘Gangs of Wassepur’ ডুয়োলজির তুমুল সফলতা দিয়ে। নাওয়াজউদ্দীন সিদ্দিকে একদিন কথা দিয়েছিলেন,তাকে নিয়ে একক মুভি বানাবেন।একথাও রাখেন আনুরাগ।
ভারতের তুলনামূলক ‘গ্রাম্য’ অঞ্চল বিহারকে কেন্দ্র করে বানানো ‘Gangs of Wassepur ‘ তরুণদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এই সিনেমাটিই প্রডিউসার আনুরাগকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করে। এরপর ‘Ugly’ এবং ‘Bombay Velvet’ নামক দুটি ছবি ,সম্প্রতি ‘Raman Raghav 2.0′ নির্মাণ করেন আনুরাগ।’Ugly’ বক্স অফিসে ফ্লপ করলেও মুগ্ধ করে ‘ মুভি গিক’-দের।তবে ‘Bombay Velvet ‘ বিগ বাজেট সিনেমা হওয়ায় এর চরম ব্যর্থতা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রল সবকিছু সহ্য করে আবারও ঘুরে দাড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেন আনুরাগ,এক ফেসবুক পোষ্টে।
আনুরাগের প্রোডাকশন হাউস Phantom সফলতা অবশ্য চোখে পড়ার মত।’The Lunchbox’, ‘Udta Punjab’ ‘Queen’ এর মত সফল কিছু ছবি দিয়েছে Phantom।
আনুরাগ কাশ্যপের হাত ধরে নতুন ধারার সিনেমা বিকশিত হচ্ছে বলিউডে।অনুরাগেরই হাত ধরে নতুন স্বপ্ন দেখছে বলিউড।
Gangs of Wassepur একটি ডায়লোগ দিয়ে লেখাটা শেষ করছি,
‘জাব তাক ইন্ডিয়া মে সালিমা (সিনেমা) হ্যায়,লোগ চুতিয়ে বানতে রাহেঙ্গে’
পদ্মাবতী নিয়ে হইচই দেখে বলতে ইচ্ছে হয়,ভালোই বলেছেন কাশ্যপ সাহেব।
-রওনক রাদ