ছিনতাইকারী থেকে কোটিপতি হয়ে যাওয়া একজন নেতার গল্প

0
যুবলীগের আহ্বায়ক আবদুল মান্নান

এক সময় চোরাচালানের বিভিন্ন মালামাল ছিনতাই করতেন তিনি। পরে নিজেই সোনা চোরাচালান শুরু করেন। এরপর বিভিন্ন স্থানে জমি দখল, ঘের দখল, বাড়ি দখল, খুন-খারাবি, মারামারি, টেন্ডারবাজি- কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই তিনি।

সেই তিনি এখন আলিশান বাড়ি, গাড়ি আর কোটি টাকার মালিক। তাঁর আছে বিশাল এক বাহিনী। নাম আবদুল মান্নান ওরফে হাতকাটা মান্নান। বর্তমানে তিনি সাতক্ষীরা জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক। মহান স্বাধীনতা দিবসে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগের এক আলোচনা সভায় হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন মান্নান। এ ঘটনার পর আবদুল মান্নান ফের আলোচনায় উঠে এসেছেন।

বিভিন্ন সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে আসা লিখিত-অলিখিত অভিযোগ, মামলা, সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সংবাদ সম্মেলন থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয় বলে আগেই দাবি করেছিলেন আবদুল মান্নান।

যেভাবে হলেন হাতকাটা মান্নান

১৯৯২ সালে সাতক্ষীরার কাশেমপুর গ্রামের মন্তাজ সরদারের ছেলে আবুল হাসান ওরফে ডাক্তার হাসান একটি মামলায় জেলে যান। জেল থেকে জামিনে আসার পর আবদুল মান্নান সেহরি খাবার নাম করে আবুল হাসানকে ডেকে আনেন। এরপর তাঁর দুই হাত কাঠের ওপর রেখে ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে কব্জি কেটে নেন। সেই থেকে তাঁর নাম ‘হাতকাটা মান্নান’। দুই কব্জি হারানো হাসান এখন বিভিন্ন স্থানে ভিক্ষা করেন। এ ঘটনায় মান্নানের ১০ বছর জেল হয়। কয়েক বছর সাজা খেটে মুক্তি পান তিনি।

যুবলীগে যোগ দেওয়ার পর বেপরোয়া

সাতক্ষীরা সিটি কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ২০০৭ সালে আবদুল মান্নান যুবলীগে যোগ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে ওঠেন জেলা যুবলীগ নেতা। এরপর তাঁর সন্ত্রাসের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। এ সময় সদর উপজেলার আবাদেরহাটের গোপাল ঘোষাল পরিবারের জমি দখল করে নেন তিনি। এ ঘটনায় তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও হয়। একটি জাতীয় দৈনিকে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর আবদুল মান্নান যুবলীগ থেকে বহিষ্কারও হন।

এরপর সাতক্ষীরা সিটি কলেজের পাশে জমি কেনেন আবদুল মান্নান। তাঁর জমির সামনে থাকা একটি জমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে প্রতিবন্ধী দিনমজুর ফয়জুর রহমানের জমি দখল করে নেন। সেখানেই গড়ে তোলেন এক আলিশান বাড়ি। এ নিয়ে ফয়জুর রহমান সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে সবাইকে জানান। এমনকি মামলা করেও জমির দখল নিতে পারছেন না ফয়জুর রহমান।

জমি দখলের পর যুবলীগের সাইনবোর্ড : কিছুদিন আগে ভুয়া মালিক সাজিয়ে সাতক্ষীরা শহরতলীর রসুলপুরে আফরোজা বেগম ও তাঁর স্বজনদের ৩০ শতক ও ৭৬ শতক জমি দখল করে নেন আবদুল মান্নান। এরপর সেখানে যুবলীগের সাইনবোর্ড তুলে দেন তিনি। এ নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

আফরোজার পরিবার অভিযোগ করে, আবদুল মান্নান জমির ভাগ-বাটোয়ারার বিষয়টি সমাধান করতে তাঁর কাছে তাদের যেতে বলেন। তাঁরা গেলে তাঁর (মান্নান) নামে কিছু জমি লিখে দিতে বলেন। এতে অসম্মতি প্রকাশ করায় মান্নান তাঁর সহযোগী সাগর ও তাঁর বাহিনী নিয়ে দখল করে নেন ওই জমি।

এ ছাড়া আবদুল মান্নান দৈনিক যুগান্তরের সাবেক সম্পাদক আবেদ খানের জমিও দখল করার চেষ্টা করেন বলে জানা যায়। তবে এতে ব্যর্থ হন তিনি। ২০১১ সালে আবদুল মান্নান হাতে রাম দা নিয়ে সাতক্ষীরা বাসটার্মিনালে হামলা চালিয়ে ভাড়াটে সন্ত্রাসীর কাজ করেন বলেও জানা যায়। তাঁর এই হামলার কারণে সাতক্ষীরা বাস মালিক সমিতির মালিকানায় পরিবর্তন আসে।

গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন মান্নান : ২০১২ সালে সাতক্ষীরা সিটি কলেজে প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েন আবদুল মান্নান। এ সময় গণপিটুনির শিকার হন তিনি। সরকারি কাজে বাধাদান ও পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

চোরাচালান ব্যবসার সঙ্গেও আবদুল মান্নানের নাম জড়িত। তাঁর বেনামে সীমান্তে বেশ কয়েকটি খাটাল রয়েছে বলে শোনা যায়। এসব খাটাল থেকে নিয়মিত বখরা আদায় করেন তিনি। কিছুদিন আগে খাটাল দখল করতে মান্নান তাঁর বাহিনী নিয়ে সেখানে হামলা করেন।

যুবলীগে ফিরে আহ্বায়ক : দীর্ঘদিন বহিষ্কৃত থাকার পর দলের ঊর্ধ্বতন নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন মান্নান। রাজনৈতিক তদবিরে ফের রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। ২০১৩ সালের ১৩ নভেম্বর জেলা যুবলীগের ৩১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক হন তিনি।

এ সময় তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা থাকলেও তা করেননি মান্নান। যুবলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। এ সময় তাঁরা কমিটি বাতিল ও মান্নানের বহিষ্কার দাবি করে শহরে মিছিল করেন। এই নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়।

ইউপি নির্বাচনেও ঝামেলা : ২০১৬ সালের আগে ইউনিয়ন পরিষদ উপনির্বাচনে মান্নানের ভাই আবদুল হান্নান চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী হন। এ সময় দুই ভাই মান্নান ও হান্নান তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধার সৃষ্টি করেন বলে অভিযোগ ওঠে। পরে আবদুল হান্নান নিজেই মনোনয়ন দাখিলে ব্যর্থ হয়ে একজন নারী মেম্বারকে পাঠান। এরপর দুই ভাই তাঁর কাছ থেকে কাগজপত্র কেড়ে নেন। পরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে পুলিশি পাহারায় চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী অন্য এক আবদুল মান্নান তাঁর মনোনয়নপত্র জমা দেন। মান্নানের ভাই হান্নানের বিরুদ্ধেও ব্যাংক ডাকাতির মামলা ছিল।

সাতক্ষীরার ঘেরমালিকদের অনেকেই এখনো মান্নান ও তাঁর বাহিনীর হামলা ও জমি দখলের আতঙ্কে ভোগেন। সাতক্ষীরা সীমান্তে গরুর খাটালের পরিচালকরাও একই আতঙ্কে রয়েছেন।

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান পণ্ড : গতকাল ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাতক্ষীরা পৌর আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভা চলাকালে আবদুল মান্নান তাঁর বাহিনী নিয়ে হামলা চালান। এ ঘটনায় যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতাসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। এ অভিযোগে রাতেই আবদুল মান্নানকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবদুল মান্নান আবারও আলোচনায় উঠে আসেন।

এই অভিযোগগুলোর কোনোটিই সত্য নয় বলে দাবি করেছিলেন আবদুল মান্নান। বর্তমানে কারাগারে থাকায় তাঁর মন্তব্য পাওয়া না গেলেও এর আগে বিভিন্ন সময় অভিযোগগুলোর বিষয়ে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে মান্নানের কথা হয়।

অভিযোগগুলো অস্বীকার করে আবদুল মান্নান বলেন, ‘খাটালে আমার টাকা আছে। তাই সেখানকার আয়ের ভাগ তো আমি পাবই। আমি কারো জমি দখল করিনি, মালিকের কাছ থেকেই জমি কিনেছি। এসব বিষয়ে আমি পাল্টা প্রেস কনফারেন্স করে আমার বক্তব্য দিয়েছি। ঘের, জমি দখল, সন্ত্রাস সৃষ্টি যাই বলুন এগুলি আমি করি না। আমি আবেদ খানের জমি দখল করতে যাব কেন? আমি ছিনতাইকারী ছিলাম না কখনো।’

সাতক্ষীরায় তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে দাবি করেন আবদুল মান্নান। গত ২৬ মার্চের হামলার প্রসঙ্গ টেনে আবদুল মান্নান গ্রেপ্তারের আগে বলেছিলেন, সাতক্ষীরা সদর আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি ও তাঁর সহযোগীদের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারই জেরে তাঁরা এখন এসব প্রচার করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।