মাহবুব কবির মিলন
আমি জীবনে শত মুক্তিযুদ্ধার সাথে কথা বলেছি। শুনিনি কেউ যুদ্ধের সময় লুটপাটে ব্যস্ত ছিল। সবাই ছিলেন নির্লোভ এবং স্বাধীনতার জন্য হাসিমুখে জীবন দিতে প্রস্তুত যোদ্ধা। যুদ্ধে ক্যাম্প দখলের পর যা পাওয়া যেত, সব মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে জমা দিয়ে দিতেন তাঁরা। আমার গ্রামের দুই মুক্তিযোদ্ধা (এখনো বেঁচে আছেন), রাজা**কারদের ক্যাম্প দখল করার পর পাওয়া দুই ট্রাঙ্ক ভর্তি সোনা আর রূপার গয়না জমা দিয়েছিলান মিত্র বাহিনীর ক্যাম্পে। ছুঁয়েও দেখেননি তাঁরা সেই গয়না। এখন তাঁদের সংসার চলে মুক্তিযোদ্ধার ভাতা দিয়ে।
স্বাধীনতার পরপর দেখেছি বাবা সহ অনেককেই, যারা সরকারি চাকুরি করতেন, সবাই নির্লোভ ছিলেন। বাবা প্রায় কাঁদতেন আর বলতেন, আমরা বেতন নেব না, তবুও দেশের জন্য কাজ করে যাব। বঙ্গবন্ধুর কথা উঠলেই বা ছবিতে দেখলেই অঝোরে কান্না শুরু করতেন তিনি।
সেই ত্যাগ আর হাসতে হাসতে রক্ত দেয়া জাতির কী হলো আজ!!
এখন এদেশে রাতারাতি বিলিয়নিয়ার হবার সবচেয়ে সহজ রাস্তাই হচ্ছে মানুষের লোভকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা অনৈতিক ব্যবসা থেকে। যত পার লোভী তৈরি কর, তারপর হাতিয়ে নাও।
জেনারেশনের পর জেনারেশন গড়ে উঠছে নীতি নৈতিকতাহীন, যাদের মূল ভিত্তিই হচ্ছে লোভ আর লালসা।
আমার চাওয়া বা পাওয়া কিংবা প্রাপ্ত সুফলের সাথে যদি অন্যের দু:খ, কষ্ট আর কান্না জড়িত থাকে তবে সেটা যে আমার জন্য বৈধ বা ন্যায় সঙ্গত নয়, তা এরা বিন্দুমাত্র ভাবতে রাজী নয়।
ভাবার সে ক্ষমতাও নেই এদের। তিন লাখ টাকার পণ্য কিভাবে পঞ্চাশ হাজার টাকায় দিতে পারে, বাকিটা কার কার টাকা, সেটা চিন্তা করারও সামান্য বিবেক বুদ্ধি নেই এদের।
১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি। মহান স্বাধীনতার মাত্র কয়েকদিন পর। আমরা চট্টগ্রাম যাব রংপুর থেকে। আব্বা, খালু, আম্মা আর আমরা দুই ভাই। ছোট ভাইটি ৫/৬ বছরের। রাস্তা ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট সব ভাঙ্গা। বাসে করে গুলিস্তান নেমেছি প্রায় রাত দেড়টা বাজে। উঠব নবাবপুর রোডের আরজু হোটেলে। প্রচণ্ড শীত, কুয়াশা আর নিশুতি সেই রাতে দুই একটা কুকুর ছাড়া কেউ নেই।
আমরা ভয়ে ভয়ে এগোতে লাগলাম নবাবপুর রোডের দিকে। রাস্তায় খুব কম আলোর দুই একটা লাইট জ্বলছে। দূর থেকে দেখলাম প্রায় ৮/১০ জনের একটি দল আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা একটা আলোর নিচে আসতেই ওনারা সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন।
সাথে আম্মা। ভয়ে আমি আধমরা হয়ে গেছি। তাঁদের প্রত্যেকের চুল লম্বা এবং চোখগুলো যেন বাঘের মত জ্বলছে। আব্বা সব কাহিনী বললেন। আমরা আরজু হোটেলে বাকি রাত থেকে পরদিন চট্টগ্রাম চলে যাব সেটাও বললেন।
তাঁদের প্রত্যেকের গায়ে শাল জড়ানো এবং অস্ত্র দেখা যাচ্ছে। সামনের জন বললেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আমাদের সবার মা। কোনো চিন্তা করবেন না মা। আমরা আছি।
ওনারা আমাদের নিয়ে আরজু হোটেলে গিয়ে দারোয়ান ডেকে তুললেন। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন নিচ তলার একটি ছোট্ট রুমে। কারণ তখনো হোটেল চালু হয়নি।
এরপর তাঁরা বললেন, এত রাতে মা আপনাদের থাকা খুব রিস্কি। আর কেউ নেই এখানে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমাদের তিনজন হোটেলের গেটের সামনে পাহারা দেবে বাকি রাত। আপনারা নিশ্চিন্তে ঘুমান।
হ্যাঁ তাঁরা সকাল পর্যন্ত পাহারায় ছিলেন আমাদের।
কোথায় হারিয়ে গেলেন তাঁরা। কেন আমি এখনো খুঁজি তাঁদের!! কেন কোনো অনিয়ম দেখলে রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে!!
হে নয়া জেনারেশন!! দুর্ভাগ্য তোমাদের। তোমরা তাঁদের দেখা পাওনি, পাওনি ছোঁয়া।
কবে দেখা পাব আবার আমরা তাঁদের!! কত বছর, কত যুগ পরে!!
লেখকের ফেসবুক থেকে