রয়্যাল ম্যাসাকারের নেপথ্যে: ইতিহাসের প্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হওয়ার স্বপ্ন

0
মুজতাহিদ

‘#মুজতাহিদ’। সৌদি আরবের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ এবং জনপ্রিয় টুইটার এডমিন। রাজপ্রাসাদ এবং রাজপরিবার থেকে নিয়ে রাষ্ট্রের টপ-সিক্রেট অথরিটিগুলোর গোপন সংবাদ পাওয়ার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম। কেবল একটি টুইটার এডমিন হওয়া সত্ত্বেও দুনিয়ার তাবৎ বাঘা বাঘা সংবাদ মাধ্যমগুলো তার তথ্যগুলো গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে। এর থেকেই আঁচ করা যায় এটি কতো নির্ভরযোগ্য সোর্স। ধারণা করা হয় যে, এই একাউন্টটি যে ব্যাক্তি পরিচালনা করছে সে সৌদি রাজপরিবার অথবা সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার অনেক উঁচু পদের কেউ। বাদশাহ আব্দুল্লাহর মৃত্যুর সময় আব্দুল্লাহ-পুত্র প্রিন্স মুতইব এবং তৎকালীন রাজকীয় অধিদপ্তরের প্রধান খালেদ আল তুওয়াইজিরি মিলে সালমানের হাত থেকে ক্রাউন প্রিন্সের মুকুট কেড়ে নেয়ার জন্য যে কঠিন চক্রান্ত করেছিলো তার বিস্তারিত বিবরণ ফাঁস করেছিলো এই ‘মুজতাহিদ’- যা পরবর্তীতে পুরোপুরি সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। ‘মুজতাহিদ’কে নিয়ে এই কথাগুলো বলার কারণ হচ্ছে ৫ই নভেম্বরের রয়্যাল ম্যাসাকারের নেপথ্য কারণ নিয়ে তার কয়েকটি টুইট। তার মতে বিন সালমানের এই উদ্যোগটি মূলত অর্থনীতি কেন্দ্রিক। বাকী হিসাব-নিকাষগুলো আসছে দ্বিতীয় সারিতে। ৫ই নভেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে তার কয়েকটি টুইটবার্তার সরাসরি অনুবাদ এখানে দিচ্ছি-
মুজতাহিদ
তার কথামতে এই গ্রেফতার অভিযান এখানে থামবে না; বরং তার পরিধি আরও বিস্তৃত হবে। মুজতাহিদ এক টুইটে বলছেন-
“যদি এই অভিযানের প্রথম পর্ব কোন ঝামেলা ছাড়া শেষ হয়, তাহলে দ্বিতীয় পদক্ষেপ হবে বিভিন্ন শহরের তুলনামূলক ছোট আমীরদেরকে বহিষ্কার এবং গ্রেফতার করা। এদের মধ্যে তাবুক, মক্কা, আল শারকিয়া এবং রিয়াদের আমিরগণ রয়েছে। তাদের স্থলে বিন সালমানের অনুগত লোকদেরকে বসানো হবে।”

মুজতাহিদের মতে এই ঘটনার লক্ষ্য হচ্ছে ২ টি –

“প্রথম লক্ষ্য, যার ব্যাপারে বিন সালমান তাঁর পিতার ক্ষমতারোহনের পর থেকে চিন্তা ভাবনা করছিলেন এবং তাঁর একান্ত বৈঠকগুলোতে যার ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করতেন, সেটি হচ্ছে তিনি ইতিহাসের সর্বপ্রথম ট্রিলিয়নিয়ার হবেন। তিনি বলতেন- বিলগেটস, তাঁর চাচা মিশআল, প্রিন্স আব্দুল আজিজ বিন ফাহাদ, প্রিন্স খালেদ বিন সুলতান এবং প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন ফাহাদ- এরা সবাই এক সময় তাঁর অর্থনৈতিক শক্তির সামনে বামন এবং হতদরিদ্র প্রমাণিত হবে। তাঁর প্রাচুর্য একদিন গিনেস বুকে জায়গা করে নিবে।”

“তাঁর এই হামলার দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই’কে রাজপরিবারের তাঁর বৈরী পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাবহার করা। যারা তাঁর ক্ষমতাগ্রহনের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, তাঁর বিরুদ্ধে যেকোনো পদ্ধতিতে বিদ্রোহ করতে পারে- এমন সব প্রিন্সদেরকে বন্দী করা, যাতে তাঁর ক্ষমতারোহনের পথের সব কাঁটা সরে যায়।”

মুজতাহিদ বলছেন-
“বিন সালমান মনে করতেন যে তাঁর এই অর্থলিস্পা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অর্থনৈতিক চুক্তি, লেনদেন, অস্ত্রচুক্তি এবং বিভিন্ন পদের ছুতায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ আত্মসাৎ করার মাধ্যমে পূরণ হবে। পরে যখন বিশ্ববাজারে তেলের মূল্যে ধস নামে তখন তাঁর পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রচুর পরিমানে ট্যাক্স বাড়িয়ে দেয়া হয়। কিন্তু অর্থ আয়ের এই মাধ্যমগুলো এতো ধীর গতির যে এগুলোর মাধ্যমে তাঁর লক্ষ্য অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। তাই বিকল্প ব্যাবস্থা নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করলেন।”

বিকল্প ব্যাবস্থাটি হচ্ছে রাজপরিবারের সদস্যদের বিশাল ধনভাণ্ডারের উপর দখল কায়েম করা।

মুজতাহিদ বলছেন- “বিন নায়েফকে সরিয়ে দেয়ার পর যখন তিনি একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হলেন তখন থেকেই প্রিন্সদের সম্পদের উপর তাঁর লুলুপ দৃষ্টি পড়ে।”
তিনি বলছেন- “এ ব্যাপারে তাঁর প্রথম পরীক্ষাটি ছিল প্রিন্স আব্দুল আজীজ বিন ফাহাদকে গ্রেফতার করা এবং তার ধন সম্পদের বিষয়ে তাকে বিভিন্নভাবে উত্ত্যেক্ত করা। উদ্দ্যেশ্য ছিল রাজপরিবারের প্রতিক্রিয়া যাচাই করা এবং আব্দুল আজীজের ভাইদের পদক্ষেপ কি হয় তা দেখা। যখন দেখল যে, তেমন কিছুই হয়নি, তখন পরবর্তী পদেক্ষেপ নেয়।”

তিনি বলছেন-
“বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিন সালমানের কাছে এই রিপোর্ট আসে যে বিভিন্ন প্রিন্সদের হাতে কয়েক ট্রিলিয়ন রিয়াল রয়েছে। সাথে সাথেই দুর্নীতি দমনের নামে অভিযান শুরু করে। প্রথমেই পথের সবচেয়ে বড় কাঁটা জাতীয় নিরাপত্তাবাহিনী প্রধান প্রিন্স মুতইব বিন আব্দুল্লাহকে দুর্নীতির অপবাদে গ্রেফতার করে নিরাপত্তাবাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। যেসব মন্ত্রী ব্যাবসায়ীদেরকে গ্রেফতার করা হয় তারাও প্রত্যেকজন বিলিয়নিয়ার। তাই তারাও এই খড়গ থেকে মুক্তি পায়নি। কেবল সাবেক রাজকীয় দপ্তর প্রধান খালেদ তুওাইজিরী রাজকীয় দফতরের দায়িত্ব পালনকালে বাদশাহ আব্দুল্লহার আস্থার সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন রিয়াল আত্মসাৎ করে।”

তিনি আরও বলছেন-
“এই পদক্ষেপ গ্রহণ করার ঠিক পূর্বে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবাহিনী এবং সশস্ত্রবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল এনে এগুলোর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবুও নিশ্চিত হতে না পেরে মিশরী সেনাবাহিনীর বিশাল একটি বহর এবং কুখ্যাত ব্ল্যাক ওয়াটারের কয়েক প্লাটুন কমান্ডো ভাড়া করে নিয়ে আসে। ফলে তাঁর এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ সংঘটিত হতে পারেনি।”

তিনি আরও বলছেন-
“বিন সালমান ইচ্ছে করেই তাঁর এই অভিযানকে বিশালভাবে মিডিয়া হাইলাইট করেছে। উদ্দ্যেশ্য- সেনাবাহিনী এবং রাজপরিবারের বৈরী পক্ষগুলোর অন্তরে ভয় ধরিয়ে দেয়া, যাতে তাঁরা কোনরকম প্রতিরোধের চিন্তাভাবনা করতে না পারে।”

মুজতাহিদের তথ্যমতে- “বিন সালমান এই অভিযানের মাধ্যমে ২ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন রিয়াল জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে। সেখান থেকে আধা ট্রিলিয়ন মতো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেবে। বাকীগুলোর গন্তব্য হবে তাঁর নিজের একাউন্ট।”
তিনি আরও লিখেছেন- “রাজপরিবারের যাদের ব্যাপারে বিন সালমানের ভয় আছে তাদের সবার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে রেখেছেন। কিন্তু তাঁর ভয় হচ্ছে রাজপরিবারের নিরব পক্ষগুলোকে নিয়ে। কারণ, তাদের পক্ষ থেকেও যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।”

এগুলো তো গেলো মুজতাহিদের কয়েকটি টুইটবার্তা। তাঁর এই তথ্যগুলোর পক্ষে আরেকটি শক্তিশালী প্রমাণ হচ্ছে গতরাত সৌদি আরবের আসীর এলাকায় হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রিন্স মনসুর বিন মুকরিনসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকজন দায়িত্বশীল নিহত হন।

এবার একটি মুবারক ফতোয়া দিয়ে আজকের পর্ব শেষ করি। শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাবের বংশধর, সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল আযীজ বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়খ ফতওয়া দিয়েছেন-

“আমীরদের সমালোচনা করা হারাম। মিডিয়ায় তাঁদের দোষত্রুটি প্রকাশ করা একটি শয়তানী কাজ।”

যেহেতু শরীয়তের ফতওয়া তাই সম্মান করতেই হবে। আপনি মানেন আর না মানের সেটা আপনার ব্যাপার। তবে, কোন দুর্জন প্রশ্ন করে বসতে পারে – “তাহলে আজ দুইদিন ধরে এতগুলো আমীরকে যে শুধু মিডিয়ায় নয়; দশ বাজারে উলঙ্গ করে নাচানো হলো এবং এখনও হচ্ছে, তা কি এই ফতওয়ার মধ্যে পড়ে নাকি পড়ে না? আমরা তো জানি হালাল হারামের বিষয়টি সর্বসাধারণের জন্য হয়ে থাকে। তাহলে গ্র্যান্ড মুফতীর এই যুগান্তকারী ফতওয়া সম্পর্কে কি বিন সালমান আদৌ অবগত নন, তাই তিনি এই হারাম কাজটি করছেন, না কি শরীয়তের প্রয়োগের মানদণ্ড সবার ক্ষেত্রে সমান নয়?”

এইসব দুর্জন দুষ্ট লোকদের জবাবে আমরাও ফতওয়া দেব –

“নবীর দেশের সম্মানিত মুফতী সাহেবগণের ফতওয়ার ব্যাপারে কথা বলা, সেগুলো নিয়ে জনমনে সংশয় তৈরি করা রাফেজী কুবুরী খান্নাসদের কাজ”।

Muhammad Noman

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে