‘কিতনা হ্যায় বদনসিব জাফর/ দফনকে লিয়ে দো গজ জমিনভি মিল নাহি সাকি।’
জাফর, তুমি এতই দুর্ভাগা, ভালবাসার দেশে তোমার কবরের জন্য দু’গজ মাটিও জুটল না।
১৭৫৭ সালে বাংলা, ১৭৯৯ সালে মহীশুর চলে যায় ইংরেজদের হাতে। একে একে ১৮৫৭ সাল অবধি ৫৮ বছরে ভারতের অধিকাংশ এলাকার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজরা। ১৮৫৭ সালে যখন ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়, তখন বিজেতা পক্ষের কাছে সবচেয়ে বড় হয়ে যে প্রশ্নটি দেখা দেয়, তা হল- এদের নেতা শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে কি করা উচিত?
বিজেতা যেহেতু ইংরেজ আর ভারতও যখন পুরাপুরি তাদের আয়ত্বে চলে এসেছে তখন বারবার বাধাদেওয়া মুঘল বংশের শেষ সম্রাটকে কি করা হবে এটা খুবই কঠিন প্রশ্ন।
শাস্তিটাও ছিল অত্যন্ত কঠিন আর নির্মম ।
বাহাদুর শাহ জাফর (১৭৭৫-১৮৬২) ছিলেন ভারতের শাসক বংশ মোগল বংশের (শাসনকাল ১৫২৬-১৮৫৮) শেষ সম্রাট , দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামী মজলুম বাদশাহ, এক বেদনাহত অমর কবি ও লেখক। ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার্থে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের অবদান এ দেশবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সূচনা করেছিল। মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার্থে তিনি ব্রিটিশ বেনিয়াদের শায়েস্তা করার জন্য আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার শ্রেষ্ঠ প্রচেষ্টা হিসেবে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর মোগল সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছায় রাজ মর্যাদা প্রত্যাহার করে জনগণের কাতারে নেমে এসে সত্যিকার একজন দেশপ্রেমিকের পরিচয় দিয়ে গেছেন।
১৮৫৭ সাল অবধি ভারতের অধিকাংশ এলাকার ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজরা। বাহাদুর শাহ জাফর পরিণত হলেন মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি ও প্রতীকে। নামে মাত্র সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে কোনোদিনই সুখের মুখ দেখতে পাননি দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর। দিল্লিতেও ইংরেজ ও তাদের দালাল মারাঠা হিন্দুদের আধিপত্য সুসংহত। মোগল রাজ পরিবারেরই কারো কারো রক্তে জেগে উঠলো স্বাধীনতা ও ঐতিহ্য চেতনার বন্যা। জগতে তোলপাড় করা মোগল ডাইনেস্টি ভারতের বুক থেকে বিদায় নেবে এ কথা ভাবতে কষ্ট হয় তাদের। অপর দিকে দেশের বীর সিপাহি-জনতার মনে এ চিন্তা-চেতনা দানা বেঁধে উঠল যে কোনোক্রমেই দিল্লির পতন ঘটতে দেয়া যায় না।
নিজের দেশে ব্রিটিশ বেনিয়া সাম্রাজ্যবাদীদের অধীনতাপাশে আবদ্ধ থাকতে হবে এটি মেনে নিতে রাজি নয় বীর সিপাহি-জনতা। সম্রাট স্ত্রী জীনাত মহল এ সুযোগটি গ্রহণ করলেন অতি দক্ষতার সাথে। তিনি গোপনে যোগাযোগ করলেন এসব দেশপ্রেমিক সৈনিকদের সাথে। তিনি এসে দাঁড়ালেন দেশের সৈনিকদেরকে উৎসাহ জোগাতে সম্রাটের কাজে। তিনি সম্রাটকে বুঝাতে সক্ষম হলেন ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে।
সম্রাটের সমর্থন লাভ করে সিপাহি-জনতার সাহস বহুগুণ বেড়ে গেল। একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে উত্তাল হয়ে উঠল দিল্লি। অযোধ্যা, আম্বালা, কানপুর, ঝাঁসি, বহরমপুর, লাক্ষেèৗ ইত্যাদি অঞ্চল থেকে সেনাদল এসে জমায়েত হতে লাগল দিল্লিতে। দিল্লি দুর্গে গোপনে সংগ্রাম-পূর্ব প্রস্তুতি নিতে লাগলেন বেগম জিনাত মহল। তিনি তাঁর তীক্ষ বুদ্ধি দিয়ে সিপাহি বিপ্লব কিভাবে সার্থক করা যায় তা নিয়ে বিপ্লবী সেনাদের সাথে পরামর্শ করলেন। অবশেষে ১৮৫৭ সালের ২৩ জুন বিপ্লবের দিন ঠিক হলো। ঠিক এক শ’ বছর আগে এমন এক দিনে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা থেকে ইংরেজরা কেড়ে নিয়েছিলো স্বাধীনতার লাল সূর্য। এক শ’ বছর পর স্বাধীনতার সেই হারানো সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে তেজোদীপ্ত সিপাহি-জনতা। কিন্তু তাদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হলো এক অত্যুৎসাহী মঙ্গল পান্ডের কর্মকাণ্ডে। তিনি ২৯ মার্চ সবাইকে অবাক করে দিয়ে একাই অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ইংরেজদের ওপর। তার হাতে কয়েকজন ইংরেজ সামরিক অফিসার নিহত হলো। বন্দী হলেন মঙ্গল পান্ডে। একুশে এপ্রিল ফাঁসিতে ঝুলানো হলো মঙ্গল পান্ডেকে।
এবার শুরু হলো বিচারের প্রহসন। অনেকে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে ছিলো ইংরেজদের বিচারের দিকে। বিপ্লবের সময় অনেক সাধারণ ইংরেজকে আশ্রয় দিয়েছেলন জিনাত। কিন্তু না, ইংরেজরা কঠোর সিদ্ধান্ত নিলো। ছয় ছেলের মাথা কেটে প্লেটে করে তার সামনে এনে বলা হয়েছে, এরপরও কি দিল্লীর মসনদ চাও? তারপরও নত হননি সম্রাট।বাহাদুর শাহের বিরুদ্ধে চারটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে সামরিক আদালতে তাঁর বিচার শুরু করে।
ইয়াঙ্গুনের বিখ্যাত শোয়ে ডন প্যাগোডার পূর্ব পাশে ৬ জিওয়াকা সড়কের একটি বাড়িতে বাহাদুর শাহ ও তাঁর স্বজনদের রাখা হয়। তখন এটি ছিল সেনাছাউনি। তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র চারটি কক্ষ। সেখানে বাহাদুর শাহকে লেখার কলম ও কাগজ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।মাসের পহেলা দিনে সাবান, তোয়ালে কেনার জন্য মাথাপিছু দু’টাকা করে দিতেন। কোনো লোককে তাদের সাথে দেখা করতে দেয়া হতো না। চাকর-বাকররা পাস নিয়ে তাদের কাছে যেতে পারতো। কারাগারের অভ্যন্তরে এক বদ্ধ প্রকোষ্ঠে, শতরকম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যেই তিনি রচনা করেছিলেন অসংখ্য সুবিখ্যাত পংক্তিমালা, গজল, শায়েরি। সম্রাটের ইচ্ছা ছিল স্বদেশের মাটিতে সমাহিত হওয়া। জন্মভূমির প্রতি ছিল প্রচণ্ড অনুরাগ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন জীবনের শেষ সময় ঘনিয়ে আসছে। সম্রাটকে শুতে দেয়া হয় একটা পাটের দড়ির খাটিয়ায়। ভারতের প্রিয় মাতৃভূমি থেকে বহু দূরে রেঙ্গুনের মাটিতে সম্রাটের জীবনের বাকি দিনগুলো চরম দু:খ ও অভাব অনটনের মধ্যে কেটেছিল। সম্রাট পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলেন। এমন বিড়ম্বনাপূর্ণ জীবনের অবসান হয় ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর, শুক্রবার ভোর ৫টায়। তবে সম্রাটকে অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে দাফন করা হয়। কবরটি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য, যা একসময় নষ্ট হয়ে যাবে, ঘাসগুলো গোটা জায়গা আচ্ছাদিত করে ফেলবে। কোথায় সর্বশেষ মুঘল সম্রাট শায়িত আছেন, তার চিহ্নিও কেউ খুঁজে পাবে না।
সম্রাট হলেও তিনি ছিলেন নামমাত্র সম্রাট। বাহাদুর শাহ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পেনশনভোগী ছিলেন। তিনি বার্ষিক ১ লাখ টাকা ভাতা পেতেন। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও সম্পদ সব কিছু হারিয়ে সম্রাট প্রাসাদের চার দেয়ালের অভ্যন্তরে জীবন কাটাতে বাধ্য হলেন। এ সময় অমর্যাদার মনোবেদনা ভুলে থাকার জন্য তিনি গজল ও মুশায়েরায় নিমগ্ন থাকতেন ; লালকেল্লায় সাহিত্যের আসর বসিয়ে সময় কাটাতেন। তিনি নিজেও কবিতা লিখতেন। জীবনের কষ্ট ও বিষাদ তাঁর কবিতার মূল বিষয়। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে দু:খ ও বিষাদের সাথে দেশ ও জাতির পরাধীনতার কথা বিধৃত। একটি কবিতায় আছেঃ
“উমর এ দারাজ কে লিয়ে থে চার দিন, দো আরজু মে কাট গায়ে; দো ইন্তেজার মে”
যার অর্থ:
“চার দিনের জন্য আয়ু নিয়ে এসেছিলাম। দু’দিন কাটল প্রত্যাশায় আর দু’দিন অপেক্ষায়।”
নিদারুণ দু:খে তিনি লিখেছেন একের পর এক কালোত্তীর্ণ কবিতা। এই মর্যাদাহীন ‘সম্রাট’ উপাধি কে উপহাস করে বিষাদ কণ্ঠে তিনি বলছেনঃ
“ইয়ে মুঝে আফসার-ই-শাহানা বানায়া হোতা, ইয়ে মেরা তাজ গাদায়ানা হোতা”
ইংরেজি অনুবাদে অর্থ হলঃ
“You should have made me the chief of the kings or
Instead you should have given me a crown that a beggar may wear.”
দেশের মাটিতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ কিংবা সমাহিত হওয়ার সাধ কোনোটাই পূরণ না হওয়ার বেদনায় লিখেছেনঃ
“কিতনা হ্যায় বদ নসিব জাফর’ ,
দাফন কে লিয়ে দো গজ জমিনভি মিল নাহি সাকে”
অর্থঃ
“এতই হতভাগা জাফর, দাফনের প্রয়োজনে,
নিজের দেশে দু’গজ মাটিও মিললনা।”
সন্দেহ নেই সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফর ইতিহাসের এক ট্র্যাজিক নায়ক যার জীবন বিষাদ, বঞ্চনা, অবহেলা আর উপেক্ষার পদাবলীতে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তবু তিনিই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা, আমাদের চেতনার অঙ্কুরোদগম তাঁর হাত ধরেই হয়েছে।
১৮৬২ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে ডেভিস দিল্লিতে পত্র লিখে জানালেন, গত ৭ নভেম্বর বাহাদুর শাহ জাফর নামক একজন রাজবন্দী মারা গেছেন। দিল্লির শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ৬ নভেম্বর তৃতীয় বারের মত পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং পরদিন মৃত্যুবরণ করেন। সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফর ২৬ অক্টোবর থেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। উপযুক্ত চিকিৎসাও পাননি। এ অবস্থায় ডেভিস কাছে ইট আর চুন জোগাড় রাখতে বললেন যাতে বাহাদুর শাহকে কবর দেয়া যায়। যেদিন ভোরে তিনি মারা যান সেদিন বেলা ৪টায় কবর দিয়ে তা মাটির সমান করে ঘাসের আবরণে ঢেকে দেয়া হয়। ডেভিস বারবার এসে দেখতো যেন সম্রাটের কবরের সাথে অন্যদের কবরের কোনো ফারাক না থাকে এবং কবরটার সন্ধান যেন কেউ না পায়। একজন মৌলভী লাশ দাফনে সাহায্য করেন। অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় এই যে, শেষ মোগল সম্রাটের মৃত্যুর পর ইংরেজ বেনিয়ারা তাঁর প্রতি শেষ শ্রদ্ধাটুকুও প্রদর্শন করার প্রয়োজন অনুভব করেনি। দাফনের সময় সম্রাটের কোনো উপাধি বা পদবি ঘোষণা করতে দেয়া হয়নি।
অনেক বছর পর বার্মার মুসলমানদের বারবার আবেদনের ফলে তহবিল সংগৃহীত হয়। ১৯৩৪ সালে গঠিত একটা কমিটি কবরের ওপর মামুলি ধরনের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে। সমাধিসৌধের পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরি করা হলেও তা আজও গড়ে ওঠেনি। আর সে স্মৃতিসৌধের গায়ে আজও উৎকীর্ণ রয়েছে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের স্বরচিত কবিতার একটি এপিটাক
‘কিতনা বদ-নসিব হ্যায় জাফর। দাফনকে লিয়ে/দো গজ জমিন না মিলে।’
উর্দু সাহিত্যের অমর কবি বাহাদুর শাহ জাফর। উর্দু সাহিত্যাঙ্গনে তিনি ‘জাফর’ ছদ্মনামে খ্যাত। জাফর এ ছদ্মনাম তার নিজের লেখা উর্দু কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বিশেষভাবে বিধৃত হয়ে আছে। বাহাদুর শাহ জাফরের কাব্য প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর ভাস্বর হয়ে ওঠে তাঁর রচিত অসংখ্য পঙ্ক্তিমালায়। তাঁর রচিত কবিতাকে ‘শেরু’ (দ্বিপদী কবিতা), গজল (আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গের কবিতা) ও নজম (গীতি কবিতা) এ তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। জাফরের কবিতায় উপদেশ, প্রেম ও আধ্যাত্মিক অনুষঙ্গ যেমন আছে, তেমনি আছে আপন দুর্ভোগের অনুতাপ আর অনুশোচনায় ভরা মর্মবেদনা।
অবিভক্ত ভারতের মানুষের কাছে বাহাদুর শাহের সমাধি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী সমাধি পরিদর্শনকালে লিখেছিলেন,
“দু গজ জমিন তো না মিলি হিন্দুস্তান মে, পার তেরী কোরবানী সে উঠি আজাদী কি আওয়াজ, বদনসীব তো নাহি জাফর, জুড়া হ্যায় তেরা নাম ভারত শান আউর শওকত”
লেখকঃ সাইফুল ইসলাম