সম্প্রতি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কতৃক জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করায় সারা বিশ্বজুড়ে নতুন এক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ইসরাইল বনাম ফিলিস্তিন সংকটের আগুনে ঘি ঢালার মত অবস্থা তৈরি করেছে এই সিদ্ধান্ত। ফিলিস্তিনিরা ঘোষণা দিয়েছে তৃতীয় ইন্তেফাদা তথা গণ-অভ্যুত্থান। উনিশ শতকের শুরুর ভাগ থেকে এর সূচনা হলেও এর শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। এ নিয়ে বিস্তারিত লিখতে গেলে বড় বই হয়ে যাবে । কিন্তু পাঠকদের জানার জন্য, কিভাবে ইহুদিরা ইসরাইল রাষ্ট্র পেল, কিভাবে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সূচনা হল তা সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।
জেরুজালেম তথা প্যালেস্টাইন তিন প্রধান একেশ্বরবাদী ধর্মালম্বীদের (মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান) কাছেই অতীতকাল থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে পর্যায়ক্রমে ইহুদি, খ্রিস্টান এবং মুসলিমরা আবাস গড়ে তোলে। জেরুজালেম ভিত্তিক ইহুদি রাষ্ট্র প্রথমবার আক্রমণের শিকার হয় ব্যবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার কর্তৃক। এরপর ইহুদিরা বিতারিত হয় রোমানদের দ্বারা। ৭ম শতাব্দীতে মুসলিমরা জেরুজালেম জয় করলে এই অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামের শাসন। ওসমানিয়া (অটোমান) সাম্রাজ্যের পতনের আগ পর্যন্ত এই অঞ্চলে মুসলিমদের শাসন বজায় ছিল। এসময় এই অঞ্চলে বসবাসকারী অধিকাংশই ছিল মুসলিম। অল্পকিছু খ্রিস্টান ও ইহুদি ছিল।
নেবুচাদনেজার, রোমানদের এবং পরে মুসলিম দের শাসনে ইহুদিরা এই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯ শতকের পূর্বে ইহুদিদের ইতিহাস ছিল লাঞ্চনা, গঞ্জনায় ভরপুর। কোনো দেশে তারা শান্তিতে স্থির হয়ে বসতে পারেনি। উনিশ শতকে ইউরোপে তাদের অধিকার একটু একটু করে বাড়ছিল। তখন সারা বিশ্বের অর্ধেক ইহুদী রাশিয়ায় বাস করত। এখান থেকে ১৮৮২ সালে তারা “হোভেভেই জিওন” তথা জায়োনিস্ট বা জায়নবাদী আন্দোলন শুরু করে। অতঃপর ১৮৮৯ সালে ইহুদীরা নিজেদের আলাদা রাষ্ট্র বাস্তবায়নে জায়োনিস্ট সংঘ গড়ে তোলে। জায়ন জেরুজালেমের একটি পাহাড়ের নাম। এই পাহাড়ের পাদদেশে ফিরে আসার আকাঙ্খা থেকেই এই আন্দোলনের নাম হয় জায়নবাদী আন্দোলন।
জায়নবাদীদের বিশ্বাস জেরুজালেম হচ্ছে ঈশ্ব্বর কর্তৃক তাদের জন্য নির্ধারিত ভূমি। তাওরাতে বর্ণিত “প্রমিজ ল্যান্ড” থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফিলিস্তিনে নিজেদের প্রতিশ্রুত ভূমিতে ফেরার আশায় এবং ইউরোপে ক্রমশ ইহুদিবিদ্বেষের মুখে পড়ে সেখানে ১৯০২ সালে সর্বপ্রথম ৩৫ হাজার ইহুদি পুনর্বাসিত হয়। যাদের অধিকাংশই ছিল রাশিয়া থেকে আগত। এর ধারাবাহিকতায় ১৯১৪ সালে আরো ৪০ হাজার ইহুদি ফিরে আসে। সারা বিশ্বে থাকা ধনী ইহুদিরা এক্ষেত্রে অর্থ ও রাজনৈতিক সহায়তা দিত। এর মাঝে অন্যতম ছিল ব্যারন রথচাইল্ড পরিবার। ইংল্যান্ড রাজপরিবারে বেশ প্রভাব ছিল ধনী এই ইহুদি পরিবারের। এছাড়া রাজনৈতিক যোগাযোগ ও সহায়তার ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখে ইউরোপে থাকা এক সাংবাদিক ডঃ হার্জেল। সে জায়নবাদের লক্ষ্য প্রচারের জন্য একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু করে। তার উদ্যোগে বিশ্ব জায়নবাদী সংস্থা (WZO) গঠিত হয় যারা প্যালেস্টাইন অঞ্চলে ইহুদিদের জন্য একটা আলাদা রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগ নেয়। তারা প্রথমে অটোমান সুলতানের কাছে অনুমতি চায় কিন্তু ব্যর্থ হয়।
১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হয় জার্মানি –তুরস্ক। পতন হয় তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের। অটোমান সাম্রাজ্যের পতনের ফলে ফিলিস্তিন সহ বেশিরভাগ আরব অঞ্চল চলে যায় ইংল্যান্ড এর নিয়ন্ত্রণে। ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ড এর পক্ষ থেকে ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এ প্রতিশ্রুতির ফলে দলে দলে ইহুদিরা ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে থাকে। ১৯২২ সালে জাতিসংঘও ইহুদিদের সমর্থন দেয়। ১৯৩০ এর দিকে ফিলিস্তিন অঞ্চলে ইহুদিদের সংখ্যা প্রায় ২ লাখে পৌছায়। ১৯৩৩ সালে ৫০ হাজার ইহুদী ফিলিস্তিনে আসে এবং ১৯৩৮ সালে আরো আড়াই লাখ ইহুদি আসে।
এদিকে ইহুদিদের সহায়তা ও নিরাপত্তায় ইংল্যান্ড এর সহযোগিতায় গুপ্ত ইহুদী প্রতিরক্ষা বাহিনী ‘হাগানাহ’ গঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তারা সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনি জনগণের জমি দখল করে তাদেরকে বিতাড়িত করা এবং বাজার ও রাস্তাঘাটসহ জনসমাবেশ স্থলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তাদের ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত করা ছিল হাগানাহ বাহিনীর কাজ।
ইহুদিদের ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে পুনর্বাসনের পর থেকেই ছোটখাটো জাতিগত দাঙ্গা লেগেই থাকত। ১৯২৯ সালে বড় এক দাঙ্গা সংগঠিত হয় জেরুজালেমের বুরাক দেয়াল নিয়ে। যার ফলে ইহুদিরা জায়োনিস্ট মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে। যারা ১৯৪৬ সালে জেরুজালেমের কিং ডেভিড হোটেলে বোমা বিষ্ফোরণ ঘটায় এবং দেইর গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে হাজার হাজার নিরপরাধ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে।
এদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হিটলারের নাৎসি বাহিনীর নির্মমতায় প্রায় ৬ লাখ ইহুদি নিহত হয়। সারা বিশ্বে ইহুদিদের প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বেড়ে যায়। তাছাড়া ইউরোপ , আমেরিকায় ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা নিজেদের রাষ্ট্রের সমর্থন আদায়ে জোড়ালো ভূমিকা রাখে এবং অর্থ সহায়তা দিয়ে ইহুদিদের সহায়তা অব্যহত রাখে।
১৯৪৭ সালের ৯ মে গঠিত United Nations Special Committee on Palestine এক প্রস্তাব করে। যাতে “স্বাধীন এক আরব রাষ্ট্র, স্বাধীন এক ইহুদী রাষ্ট্র এবং জেরুজালেম শহর মোট তিন ভাগ” করার প্রস্তাব করা হয়। যেখানে মাত্র ৪৫ শতাংশ ফিলিস্তিনিদের এবং বাকি ৫৫ শতাংশ ভূমি ইহুদিদের দেয়ার কথা বলা হয়। সেসময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসকরা পরস্পরবিরোধ, দ্বন্দে জড়িয়ে থাকায় এর বিরুদ্ধে যথাযথ ভূমিকা নিতে ব্যর্থ হয়। ফলে ইসরাইল সহজেই নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে নিতে সক্ষম হয়। এই ঘোষণার ফলে আবারো দাঙ্গা শুরু হয় এবং এক লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের ভূমি থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে তেলআবিব মিউজিয়ামে জ্যুইশ পিপলস কাউন্সিল হয় এবং ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ঘোষণা করে। তৎক্ষণাৎ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান এবং সোভিয়েতের স্টালিন ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয় । তবে আরব লিগের মিসর, জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৪৮ সালে শুরু হয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধ । আরব লীগের রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনকে সাপোর্ট করে এবং আমেরিকা, ব্রিটেন ইসরাইলকে সমর্থন করে। যুদ্ধে মারা যায় ইসরায়েলের ৬,০০০ ও আরবদের ৭০০০ মানুষ। কিছুদিন পর জাতিসংঘ নবগঠিত দুর্বল, অস্ত্রহীন ইসরাইলকে রক্ষা করতে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি করায় আরব্ লীগ ও ইসরাইল কে।
যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে ইসরায়েল জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ভূখন্ড ধরে রাখতে সক্ষম হয় এবং জাফা, রামলা সহ তেলয়াবিব-জেরুজালেম সড়ক, পশ্চিম জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীরের কিছু অংশসহ প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের ৬০% এর উপর কর্তৃক স্থাপন করে।অন্যদিকে আরবরা পূর্ব জেরুজালেমসহ অবশিষ্ট পশ্চিম তীরে এবং গাজা উপত্যকা এর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে। ইহুদিরা নিজেদের অধিকৃত অঞ্চল নিয়ে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠন করতে পারলেও আরবদের অধিকৃত অঞ্চল নিয়ে কোন আরব রাষ্ট্র এখনো স্বাধীনতা পায় নি। ১৯৪৯ এর ১১ মে জাতিসংঘে সদস্যপদ পেয়ে যায় ইজরাইল।
নিচের ছবিটি দেখলে বুঝা যায় কিভাবে পর্যায়ক্রমে নিজেদের ভূমি হারিয়েছে ফিলিস্তিনিরা এবং দখল করেছে ইহুদিরা। ১৯৪৭ সালে সবুজ অংশ ছিল ফিলিস্তিন। আর এখন সবুজ নেই বললেই চলে। পুরো অঞ্চলই প্রায় ইসরালের দখলে।
বর্তমানে ইসরাইলের নাগরিক সংখ্যা প্রায় ৯০ লক্ষ। মোট জনসংখ্যার ৭৫ ভাগ ইহুদি। ১৭ ভাগ মুসলিম ও ২ ভাগ খ্রিস্টান। বাকি ৬ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।
১৯৫৬ সালে ইসরাইল ফ্রান্স ও ব্রিটেনের সহায়তায় মিসর আক্রমণ করে বসে। বিশ্ব নিন্দার মুখে পড়ে অবশেষে পিছু হটে তারা। তারপর আবার ১৯৬৭ সালে ছয় দিনের আরব ইজরাইল যুদ্ধে সারপ্রাইজ অ্যাটাকে আরব লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এর ফলে বিশ্বে ইসরাইলের ক্ষমতা সুসংহত হয়।
গত একশ বছর ধরে চলে আসা এই দ্বন্দ সহসা মিটে যাবে এরূপ আশা করা সুদূরপরাহত। ইসরাইলের ইহুদীদের দাবি তাওরাত মোতাবেক ফিলিস্তিন তাদের প্রতিশ্রুত ভূমি। এ ভুমির প্রকৃত অধিকারী তারাই। যাদের দাবীর প্রতি সক্রিয় সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। আমেরিকার রাজনীতি ও ব্যবসার অনেককিছুই যে নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদিরা। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে এতগুলো মুসলিম দেশের মাঝে ইসরাইলের মত মিত্র খুব দরকার আমেরিকার। ফলে ইসরাইলের প্রতি সকল ধরনের পক্ষপাত সবসময়ই করে চলেছে আমেরিকা। কিন্তু হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসা ফিলিস্তিনিদের সাহায্য করার জন্য দন্তহীন বাঘ আরবলীগ আর আমেরিকার হাতের পুতুল জাতিসংঘ কোনো কাজেরই নয়। জাতিসংঘের নিজেদের প্রস্তাবিত ৫৫% অঞ্চল নিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র ও ৪৫% অঞ্চল নিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করতেও তারা ব্যর্থ।
চারদিকে আরব দেশ তবুও ইরান ব্যতীত প্রায় সকল আরব দেশের আমেরিকার তাবেদারি করার কারনে মাঝখানের ছোট এই দেশটি প্রতিনয়ত করে চলেছে অন্যায়। তাই রক্তের হোলি খেলা চলছেই। ফিলিস্তিনি স্বাধীনতকামীরা আজ নিজভূমে বাস্তুহারার মত বাস করছে। ইসরাইলের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, বিমান ও ট্যাংকের বিরুদ্ধে পাথর আর গুলতি হাতে তুলে নিয়েছে। প্রতিনিয়ত অসংখ্য নারী-শিশু মারা যাচ্ছে ক্ষুধার নির্মম আঘাত আর শত্রুর আকস্মিক বিমান হামলায়। বিশ্ববিবেকের একটাই প্রশ্ন, কবে শেষ হবে এই ধ্বংসযজ্ঞ?
লেখকঃ গাজী আশরাফ