ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ সপ্তাহের শেষ দিকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে এক ‘ঘরোয়া শীর্ষ সম্মেলনে’ মিলিত হতে চীন সফরে যাচ্ছেন। এপ্রিলের ২৭ ও ২৮ তারিখে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী য়ুহান শহরে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে। মাত্র কয়েকমাস আগেই ভারত ও চীনের সেনারা যেভাবে ডোকলামে দিনের পর দিন মুখোমুখি অবস্থানে ছিল, তার এত অল্প সময়ের মধ্যেই দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব ঘরোয়া আলোচনায় মুখোমুখি বসতে পারবেন তা অনেকেই ভাবতে পারেননি।
কিন্তু কেন ভারত ও চীন এই আলোচনায় বসতে রাজি হল? দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে ঠিক কী নিয়েই বা কথাবার্তা হতে পারে? সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও-র বৈঠকে যোগ দিতে বেজিং গিয়ে দুদিন আগে ভারতের পরারাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ যখন য়ুহানে নরেন্দ্র মোদী ও শি জিনপিংয়ের মধ্যে ঘরোয়া সামিটের কথা ঘোষণা করেন, তা কূটনৈতিক মহলে ছিল রীতিমতো অভাবিত।
মিস স্বরাজ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর চীনে আসার কথা ঘোষণা করে জানান, এই শীর্ষ সম্মেলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার বিশদে আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে নানা স্তরে যে আলোচনা হয়ে আসছে এটাও তারই অংশ বলে তিনি মন্তব্য করেন। অথচ ২০১৭ ছিল স্মরণকালের মধ্যে ভারত-চীন সম্পর্কে সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ বছর।
ডোকলাম সীমান্তে টানা ৭২ দিন ধরে সামরিক উত্তেজনাই শুধু নয়, এই বছরেই চীন নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে ভারতের প্রবেশে বাধা দিয়েছে, জাতিসংঘে ভেটো দিয়ে বারেবারে আটকে দিয়েছে জইস-ই-মহম্মদ নেতা মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসবাদী ঘোষণার চেষ্টা।
তবে জহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও চীন-বিশেষজ্ঞ অলকা আচারিয়া মনে করেন, সম্পর্কটা তলানিতে ঠেকেছিল বলেই সম্ভবত দুই দেশই তা পুনর্গঠনের তাগিদটা অনুভব করেছে।
ড: আচারিয়া বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, দুই দেশের সম্পর্ককে এখন যে আবার ‘রিসেট’ করার কথা বরা হচ্ছে, ডোকলাম সঙ্কটের তলানিটাই কিন্তু তাকে গতি দিয়েছে। আমার মতে ডোকলামটা দুদেশের জন্যই ছিল একটা ওয়েক-আপ কল। সম্পর্কটা যাতে আরও খারাপের দিকে না-গড়ায়, দুই নেতাই সেই সুযোগটা নিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।
ভারতের সদ্যবিদায়ী পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্করও মনে করছেন, দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে বৈঠকটা যেহেতু ‘ইনফর্মাল’ বা অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে হচ্ছে – তাই খোলামেলা আলোচনার সুযোগও এখানে অনেক বেশি।
তার কথায়, ঘরোয়া সামিটই প্রমাণ করে দুই নেতাই এই সম্পর্কের গুরুত্বটা অনুধাবন করছেন ও তার মেরামতের দায়িত্বও নিজেদের কাঁধেই নিয়েছেন। ইনফর্মাল সামিটের বিশেষত্বই হল এখানে কোনও নির্দিষ্ট এজেন্ডা থাকে না, সব বিষয় নিয়ে উন্মুক্ত আলোচনার সুযোগ থাকে – তাই ফর্মাল কাঠামোর বাইরে গিয়ে নেতারা ব্যক্তিগত স্তরেও মতবিনিময় করতে পারবেন।
প্রফেসর অলকা আচারিয়াও বিশ্বাস করেন, বিশ্বের ভূরাজনীতিতে ইদানীং এত দ্রুত পটপরিবর্তন হচ্ছে যে ভারত ও চীনের মধ্যে জরুরি আলোচনার বিষয়েরও কোনও অভাব নেই।
তিনি বলছিলেন, বিশ্বের অর্থনীতিতে শুল্ক বসানো নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, এই অঞ্চলে অবকাঠামো উন্নয়ন কিংবা সন্ত্রাসবাদ – কথা বলা দরকার তো কত কিছু নিয়েই। কিন্তু বাস্তব এটাই, চীন ও ভারত এতদিন এগুলো নিয়ে কোনও আলোচনা করেনি। কিন্তু আমার ধারণা, য়ুহানের সামিট থেকে দুই দেশ আবার এগুলো নিয়ে কথা বলতে শুরু করবে।
এ বছরের গোড়ায় দেশের মন্ত্রী-আমলাদের তিব্বতি ধর্মগুরু দালাই লামার সব অনুষ্ঠান থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে ভারত সরকারও বুঝিয়ে দিয়েছিল চীনের অনুভূতির প্রতি তারাও সংবেদনশীলতা দেখাতে চাইছে।
আর তার কিছুদিনের মধ্যেই য়ুহানে মোদি-শির ঘরোয়া বৈঠক সম্ভবত এটাই প্রমাণ করছে যে সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার তাগিদটা পারস্পরিক। সূত্র: বিবিসি বাংলা।