“দেড়টা বছর সময় পেয়েও আমরা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারলাম না”

0

শরীফুল হাসান

বাংলাদেশের অবস্থা তো দিনে দিনে আরও খারাপ হচ্ছে। কোনদিন মৃত্যুর রেকর্ড ভাঙছে তো কোনদিন আক্রান্তের। আজ অবশ্য মৃত্যু ও শনাক্ত দুটোরই নতুন রেকর্ড হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২৩০ জন মারা গেছে, নতুন রোগী শনাক্ত ১১ হাজার ৮৭৪ জন। ভারতে যেখানে এখন দুই শতাংশ রোগী সেখানে আমাদের রোগী ৩০ শতাংশ। কোন কোন জেলায় আবার সেটা ৫০ শতাংশও।


আমার শুধু আফসোস লাগে, দেড়টা বছর সময় পেয়েও আমরা যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারলাম না। না হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, না সাধারণ মানুষের সচেতনতা কোনটাই হলো না। এক আইসিইউ সংকটে কতো যে রোগী মারা যাচ্ছে। অবশ্য কারও কারও লেখা দেখেছি হুট করে আইসিউই তৈরি করা যায় না। বুঝলাম আইসিইউ হুট করে বানানো যায় না কিন্তু হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলাও কেন যাওয়া যাবে না? এটা পেতেও কী বছর লাগে?


আমরা সবাই গত বছর থেকেই জানি, করোনা আক্রান্তদের মধ্যে তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের জন্য আইসিইউ বেডের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা। এর মাধ্যমে রোগীদের ৮০ লিটার পর্যন্ত অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া যায়। যুগান্তরের একটা খবর দেখলাম দুদিন আগে, সরকারি পর্যায়ে চট্টগ্রামে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে মাত্র ৪৭টি। এর অর্ধেকই নাকি নষ্ট। সারাদেশেই একই সংকট।


আমার মাঝে মধ্যে প্রশ্ন জাগে, গত ৫০ বছরে স্বাস্থ্যখাতে আমরা করলামটা কী? বিশেষ করে গত দেড়বছরে। কথা বললে এমন অনেক কথাই বলা যায়। অবশ্যই জনগনকে সচেতন হতে হবে। কিন্তু আমাদের নীতি নির্ধারকরাও কী যথাসময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারলো? হিসেব করে দেখেন, গত এক বছরে তিনবার আমাদের পরিস্থিতি খারাপ হলো। যখুনি পরিস্থিতি খারাপ হয় কিছু কাজ হয়, আবার যা তা।
বাস্তবতা হলো, স্বাস্থ্যখাতে আমরা আসলেই যথাযথ নজর দেইনি। দেয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। আমি মনে করি না সরকারের বাজেটের সংকট আছে। আচ্ছা এই দেশের জেলা-উপজেলা এবং বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো আধুনিক মানের করতে কতো টাকা লাগে? একটা করে মডেল হাসপাতাল কেন গত ৫০ বছরেও আমরা বানাতে পারিনি? নাকি আমাদের মডেল মসজিদ হলেই চলে।


আবার দেখেন কথায় কথায় সরকারি দপ্তরগুলোতে কোটি কোটি টাকার গাড়ি কেনা হয়। হিসেবে করলে দেখবেন, এই দেশে যতো কোটি টাকার সরকারি গাড়ি আছে তার অর্ধেক বাজেট দিয়েই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা বদলে দেয়া যায়। কিন্তু আমরা আসলে প্রয়োজনই বোধ করি নাই। কারণ আমাদের সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক ছিল। দেশে ছিল বেসরকারি সব দামী হাসপাতাল। আমাদের নীতি নির্ধারকদের কয়জন জেলা উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা নেন? তারা কী জানেন সেখানকার পরিস্থিতি?


জানি এসব জবাব আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে নেই। ভারতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তো দারুণ সফল। দারুণ সব গোজামিল দিতে পারি। ৪২৫ টাকায় কেনা টিকার খরচ তারা দেখান ৩০০০ টাকা। মাস্ক কেনায় ভয়াবহ রকমের দুর্নীতি হওয়ার পর এখন তারা বলেন মাস্ক কেনাই হয়নি।
ঢাকার সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের কথা মনে আছে? ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে যিনি তামাশা করেছিলেন? আসলে কর্ম এবং কর্মফল বলে তো কিছু আছে।
যাই হোক, নেতিবাচক সব কথা বলতে ভালো লাগে না। নীতি নির্ধারকদের কাছে শুধু অনুরোধ, করোনা পরিস্থিতি যাই হোক সামনের দিনগুলোতে অন্তত স্বাস্থ্যখাতটা ঢেলে সাজান। প্রত্যেকটা উপজেলায় মডেল হাসপাতাল বানান। ৫০০ উপজেলায় ৫০০ মডেল হাসপাতাল, ৬৪ জেলায় ৬৪ টা, মেডিকেল কলেজগুলো আধুনিক এসব করতে যে বাজেট লাগবে সেই বাজেট বাংলাদেশে আছে। দয়া করে সেদিকে নজর দিন। করোনা যাবে আরও অনেক রোগ-ব্যাধি আসবে। কিন্তু স্বাস্থ্যখাতটা যেন ঠিক হয়। আমরা না হয় মরে যাব, ভবিষ্যত প্রজন্ম অন্তত যথাযয়থ চিকিৎসাটুকু পাক।
গত কয়েকদিন ধরে রোজ একটা কথা বলছি, এবারের সংকটটা ভয়াবহ। আমরা সবাই দায়িত্বশীল না হলে এই যে মৃত্যু আর শনাক্তের রেকর্ড সেটা চট করে থামবে না। শুধু লকডাউনে এবারকার পরিস্থিতি সামলানো যাবে বলে মনে হয় না।

এর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ মডেল ধরে প্রত্যেকটা এলাকায় কমিটি গঠনের কথা লিখেছিলাম। গতকাল তথ্য অধিদপ্তরের একটা বিবরণীতে দেখলাম, প্রতিটা ইউনিয়ন উপজেলায় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। যতো দ্রুত এগুলো সক্রিয় হয় ততো মঙ্গল। আর আমরা জনগনও যেন সচেতন হই। প্রয়োজনে ডাবল মাস্ক পরি। খুব প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের না হই। টিকার নিবন্ধন করি। টিকা দেই।


আমি জানি না সামনের দিনগুলোতে কী হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আজ বলেছে, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি যদি আগামী ২ সপ্তাহে নিয়ন্ত্রণে না আসে এবং বর্তমান অবস্থা চলতে থাকে তাহলে পরিস্থিতি করুণ হয়ে যাবে। হাসপাতালে শয্যার সংকট দেখা দিতে পারে। অবশ্য সংকট এখুনি দেখা গেছে। দেশের বহু হাসাপাতালে এখন মেঝেতেও রোগী। ওদিকে ময়মনসিংহে পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় রোগীরা যথাযথ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন না। একই অবস্থা দেশের বহু জায়গায়।
বুঝতে পারছি আরও খারাপ সময় আসবে। আমাদের এখন সম্মিলিতভাবে কাজ করা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। পাশাপাশি আমাদের নাগরিকদের অনেক বেশি সচেতনভাবে চলতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে ভালো রাখুন। স্বজনহারাদের এই কান্না থামুক। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ।