শক্তিমান চাকমা খুন হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই আবার লাশ পড়ল রাঙামাটিতে। এবার খুন হয়েছেন খোদ ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) বিভক্ত অংশ গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফের প্রধান তপনজ্যোতি চাকমা ওরফে বরমাসহ পাঁচজন। সঙ্গীদের নিয়ে তপনজ্যোতি নানিয়ারচরের বগাছড়ি ইউনিয়নের কুকুরমারা গ্রামে যাচ্ছিলেন শক্তিমান চাকমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে। পথে ওতপেতে থাকা আততায়ীর ব্রাশফায়ারে চার সঙ্গীসহ খুন হন তিনি।
নিহত এই পাঁচজনের একজন অবশ্য তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসের ড্রাইভার মো. সজীব (৩২)। অন্য তিনজন হলেন সুজন চাকমা (৩০), তনয় চাকমা (২৪) ও সেতুলাল চাকমা (২৪)। সুজন সংস্কারপন্থি জেএসএসের মহালছড়ি উপজেলা সংগঠক এবং তনয় ও সেতু দলটির খাগড়াছড়ি জেলা কমিটির সদস্য। আহতদের মধ্যে ছয়জনের নাম পাওয়া গেছে। তারা হলেন- নীতিপূর্ণ চাকমা, সুমন্ত চাকমা, বিগ্রন্ত চাকমা, প্রনুস চাকমা, প্রীতি চাকমা ও শান্তি চাকমা। আহতদের সবাই গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ ও সংস্কারপন্থি জেএসএসের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। ঘটনার জন্য প্রসিত বিকাশ খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফকে দায়ী করেছে তপনজ্যোতি চাকমার দল গণতান্ত্রিক ইউপিডিএফ।
ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে। আমরা খবর পাই ১২টা বাজার কয়েক মিনিট পর। নানিয়ারচর শহরে যাওয়ার জন্য তখন চেঙ্গি নদীর তীরে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ নদীতীরে সেনা সদস্যদের ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেল। জিজ্ঞেস করতেই এক সেনা সদস্য জানান, ‘বেতছড়িতে পাহাড়িদের কয়েকজন খুন হয়েছেন।’ নানিয়ারচরের চেঙ্গি তীর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে হামলার ঘণ্টা দেড়েক পর গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে টিলার গায়ে উল্টে পড়ে আছে তপনজ্যোতিদের বহন করা মাইক্রোবাসটি। পাশে একটি জিপে রাখা হয়েছে তিনটি লাশ। তাদের তিনজনের পুরো দেহই ছিল রক্তাক্ত। তিনজনের পরনেই শর্ট প্যান্ট। তপনজ্যোতির দীর্ঘদিনের সঙ্গী ঝিমিত চাকমা চিনিয়ে দিলেন তার মৃতদেহটি।
ঝিমিত বলছিলেন প্রসিত বিকাশ খীসার ক্যাডার বাহিনীই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ঝিমিতদের বহনকারী মাইক্রোটি পেছনে পড়ে যাওয়ায় তারা রক্ষা পেয়েছেন। তপনজ্যোতির গায়ে ছিল জিন্সের শার্ট ও হাতে ঘড়ি। অন্য দু’জনের গায়ে ছিল টিশার্ট।
লাশ রাখা জিপের পাশেই দেখা যায়, রাস্তার ধারে টিলার সঙ্গে লেগে উল্টে রয়েছে একটি মাইক্রোবাস। এটির সামনের অংশের গ্লাস গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছে এবং ভেঙে পড়েছে একটি অংশ। ভেতরে আসনগুলোতে লেগে রয়েছে ছোপ ছোপ রক্ত। রাস্তায়ও দেখা গেছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে হতাহতদের রক্ত আর রক্ত। এ সময় পুলিশ লাশগুলোর সুরতহাল রিপোর্ট লিখছিল। ঘটনাস্থলে অবস্থান নিতে দেখা গেছে সেনাবাহিনীকেও।
কিলিং মিশনে দুটি গ্রুপ :আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে সশস্ত্র দুটি গ্রুপ। একটি গ্রুপ রাঙামাটি-মহালছড়ি-খাগড়াছড়ি সড়কের বেতছড়ি এলাকার যেখানে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে সেখানকার ছোট্ট একটি টিলার ওপর অবস্থান নিয়েছিল। অন্য গ্রুপটি সড়কের পাশে ঝোপঝাড়ে ছিল। তপনজ্যোতি ও তার সঙ্গীদের বহন করা মাইক্রোবাসটি যাওয়ার সময় তাদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে টিলায় লুকিয়ে থাকা গ্রুপটি। সামনে থেকে ব্রাশফায়ার করায় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন এবং রাস্তার ধারের টিলায় গিয়ে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায় মাইক্রোটি। এরপর খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, তপনজ্যোতি চাকমার মাথার পেছনের অংশে গুলি লেগে মগজ বেরিয়ে পড়েছে। অন্য দু’জনের মধ্যে একজনের কানের পাশে গুলি লেগেছে, অন্যজনের শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলি লেগে ঝাঁজরা হয়ে যায়।
যেখানে হামলার ঘটনা ঘটে সেখানে টিলায় একটি বাঁশের বেড়া ও টিনের তৈরি পরিত্যক্ত ঘর ছিল। ওই ঘরের আঙিনা থেকে প্রথমে গুলি চালানো হয়। কোনো গ্রুপ যদি ব্যর্থ হয় তাহলে যাতে অন্য গ্রুপ হামলা করে মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারে সেজন্য দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে হামলা চালানো হয়।
মামলা হয়নি :ঘটনার পরপরই বেতছড়ি এলাকার ঘটনাস্থলে ছুটে যান সেনাবাহিনী ও পুলিশের কর্মকর্তারা। পরে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ঘটনাস্থলে যান রাঙামাটির জেলা পুলিশ সুপার মো. আলমগীর কবির। এ সময় জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমরা নিহত উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমার বাড়িতে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ছিলাম। তখন জানতে পারি, বেতছড়ি এলাকায় তিনটি লাশ পড়ে রয়েছে। দ্রুত ঘটনাস্থলে লাশগুলো দেখতে পাই। পরে জানতে পারি, আরও দু’জন নিহত হয়েছে। তাদের লাশ খাগড়াছড়ি হাসপাতালে রয়েছে।’ সন্ধ্যায় তার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করা হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত অভিযান চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। তবে গতকাল সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত দুটি হত্যাকাণ্ডের কোনোটির ঘটনায়ই মামলা হয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
আতঙ্কের জনপদ :বিকেলে নানিয়ারচর থেকে রাঙামাটি ফেরার পথে দেখা গেল রাস্তায় টহল দিচ্ছে সেনারা। সকাল থেকেই যানবাহন চলাচল সীমিত। পরে তপনজ্যোতিদের খুন হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় যানবাহন। ঘর থেকে বের হচ্ছে না লোকজন। সন্ধ্যা না হতে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হওয়া রাঙামাটি হয়ে যায় ফাঁকা।
শক্তিমানের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া :গতকাল দুপুরে নানিয়ারচর উপজেলার কুকুরমারা এলাকায় পারিবারিক শ্মশানে দাহক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। এতে সংস্কারপন্থি জেএসএসের নেতাকর্মী এবং শক্তিমানের আত্মীয়-স্বজন অংশ নেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে এই কাজ সম্পন্ন হয়।