ঋণ সুবিধা দিয়ে গ্রাহকের কাছ থেকে প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন ফারমার্স ব্যাংকের অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহবুবুল হক চিশতী। বিভিন্ন পর্যায়ের গ্রাহকের হিসাব থেকে নগদ অর্থ ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে ওই টাকা চিশতীর মালিকানাধীন বখশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স মিলের হিসাবে জমা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এই ঘুষ গ্রহণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে চিশতী, তার স্ত্রী-সন্তানসহ অন্য ১৭ জনের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। দুদকের এক চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল মঙ্গলবার পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে ওই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে চিশতীর ব্যাংক হিসাবে বিভিন্ন গ্রহকের হিসাব থেকে মোট ১৪৪ কোটি ৯৮ লাখ ৬১ হাজার ৬৪২ টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। এই টাকা চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের হিসাবে স্থানান্তর করা হলেও অবৈধভাবে ওই সংগ্রহ, উত্তোলন ও ভোগের ক্ষেত্রে মূল কর্তৃত্ব ছিল চিশতীর হাতেই।
এর মধ্যে চিশতী ও তার স্ত্রী-সন্তানদের মালিকানাধীন বখশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স মিলের ব্যাংক হিসাবে ১৩৮ কোটি ৮২ লাখ ৯২ হাজার ৬৪২ টাকা স্থানান্তর হয়। জামালপুরের বখশীগঞ্জে ফারমার্স ব্যাংকের শাখায় বখশীগঞ্জ জুট স্পিনার্স মিলের নামে খোলা ওই হিসাব থেকে টাকা উত্তোলনও করা হয়েছে। চিশতী ওই কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন।
দুদকের অনুসন্ধানে চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের হিসাবে পে-অর্ডারের মাধ্যমে এক কোটি ৩৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও চিশতীর মালিকানাধীন মেসার্স রাশেদ এন্টারপ্রাইজের হিসাবে আরেকটি পে-অর্ডারের মাধ্যমে এক কোটি ৮০ লাখ ৮৪ হাজার টাকা জমা হয়েছে। এই টাকাও ঘুষের বলে তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে।
অন্যের টাকায় চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে শেয়ার কেনার তথ্যও মিলেছে। তাদের নামে কেনা শেয়ারের টাকা পরিশোধ করেছেন বিভিন্নজন। গত বছরের ৭ মার্চ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত তাদের নামে কেনা হয়েছে এক কোটি ৩০ লাখ টাকার শেয়ার। এর মধ্যে এক কোটি ২০ লাখ টাকার শেয়ার কেনা হয় চিশতীর নামে। আরেকটি পর্যায়ে ১০ লাখ শেয়ার কেনা হয় তার ছেলে রাশেদুল হক চিশতীর নামে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চিশতী ও তার পরিবারের সদস্যদের হিসাবে জমা হওয়া টাকার সিংহভাগই ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখা থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে। এই শাখায় তিনি ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে ১৪টি হিসাব পাওয়া গেছে। ওই সব হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেনের ঘটনাও ঘটেছে।
সূত্র জানায়, চিশতী ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকাকালে ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫ ধারা লঙ্ঘন করে কৃত্রিম ও ভুয়া ঋণ সৃষ্টি এবং বিভিন্ন অপকৌশল অবলম্বন করে অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যমে শেয়ার কিনেছেন। এ ছাড়া ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতারণা, বিশ্বাস ভঙ্গ ও প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন গ্রাহককে ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন।
জানা গেছে, বেশ কিছুদিন থেকে চিশতী সপরিবারে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে দুদকের উপপরিচালক মো. সামছুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিটি গতকাল ঢাকার মালিবাগে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে পাঠানো হয়েছে। এরপর গতকালই তাদের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম ও উপসহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন।
বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারির সঙ্গে জড়িত ১৭ জন হলেন- মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতী, তার স্ত্রী রুজী চিশতী, ছেলে রাশেদুল হক চিশতী, মেয়ে রিমি চিশতী, মাজেদুল হক চিশতী, রাশেদুল হক চিশতীর স্ত্রী ফারহানা আহমেদ, ফারমার্স ব্যাংকের এমডি অ্যান্ড সিইও এ কে এম শামীম, ডিএমডি আবদুল মোতালেব পাটোয়ারী, ব্যাংকের এসইভিপি গাজী সালাহ্উদ্দিন, ইভিপি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মজুমদার, এসভিপি জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ভিপি লুৎফুল হক, ভিপি মো. মনিরুল হক, এফভিপি মো. তাফাজ্জল হোসেন, এভিপি মোহাম্মদ শামসুল হাসান ভূঁইয়া, এইও মাহবুব আহমেদ ও ইও মোহাম্মদ জাকির হোসেন।
ব্যাংকটির পদত্যাগী চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর ও অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীর বিরুদ্ধে ঋণ জালিয়াতি, ঋণ দিতে কমিশন নেওয়া, গ্রাহকের হিসাব থেকে নিজের হিসাবে অর্থ স্থানান্তরসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। তবে সরকারি দলের সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়নি।