বাংলাদেশের প্রায় ৫২ শতাংশ মেয়েরই ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয়ে যায়। এই বাস্তবতার বাইরে ছিলো না গৃহকর্মী ফাতেমা খাতুনের জীবন। কিন্তু প্রযুক্তির ছোঁয়ায় ফাতেমা এখন মাইক্রোসফটের অ্যাম্বাসেডর।
অভাব অনটনের সংসারে মাত্র ৯ বছর বয়সে সামান্য টাকা বেতনে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ফাতেমাকে পাঠানো হয় মধ্যবিত্ত একটি পরিবারের গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে। এর প্রায় দুই বছর পর ফাতেমার বয়স যখন ১১ বছর তখন হঠাৎ একদিন তারা বাবা-মা তাকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল । ফাতেমা খুশি হল বাবা-মায়ের ডাক পেয়ে। ফাতেমা বাড়িতে আসার পরে জানতে পারলো ২৫বছর বসয়ী এক যুবকের সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করেছে পরিবার। মুহূর্তেই ফাতেমার সব আনন্দ মাটি হয়ে গিয়েছিল। বিয়ের সব আয়োজন করার পরে বিয়ের ঠিক আগের মুহূর্তে সেখানে গিয়ে হাজির হয় স্থানীয় আশার আলো পাঠশালা নামের বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা। ফলে বাল্য বিয়ের ছোবল থেকে রক্ষা পায় ফাতেমা। বিয়ে বন্ধ হওয়ার পর ফাতেমার শিক্ষার দায়িত্বও নেয় সংস্থাটি। তবে তারপরও ফাতেমার বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ ছিল।
কিন্তু ফাতেমাও ছিল দৃঢ় প্রতিজ্ঞ- বিয়ে সে করবে না। ইয়াং বাংলা ও আশার আলো পাঠশালার মাধ্যমে ফাতেমা আইসিটি শিক্ষা নিয়ে তার জীবনকে পরিবর্তন করেছে। ফাতেমা এখনও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং দারিদ্র্য ও বাল্য বিয়ের কবল থেকে তার মতো অন্য মেয়েদের বাঁচাতে কাজ করছে সে। এছাড়াও এখন সে অন্য যেসব কিশোরী বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে আছে তাদের ডিজিটাল দক্ষতার উপর প্রশিক্ষণ দেয়।
ফাতেমা জানান, অভাবের তাড়নায় নয় বছর বয়সে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি। বাবা-মা মানুষের বাড়িতে দিনমজুর ও ঝি এর কাজ করতেন। এর মধ্যে বড় বোন আমেনার বিয়ে হয়। বিয়েতে অনেক খরচ হওয়ায় সংসার আরো ভেঙে পড়ে। যে কারণে সামান্য টাকার বিনিময়ে একজনের বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ নেন ফাতেমা।
তিনি বলেন, ‘দুই বছর সেখানে কাজ করে বাড়িতে টাকা দেই। এরপর একদিন বাবা আমাকে সেখান থেকে নিয়ে আসেন। ভাবলাম লেখাপড়াটা আবার শুরু করতে পারব। কিন্তু বাড়িতে এসে দেখি আমার বিয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। পাত্র আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।’
ফাতেমা যে বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন সেখানেই পরিচয় হয় ‘আশার আলো পাঠশালা’র প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিত বর্মনের সঙ্গে। তিনিই ফাতেমার বাবা-মাকে বুঝিয়ে বিয়ে বন্ধ করেন। সেইসঙ্গে ফাতেমাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
ফাতেমা বলেন, ‘এরপর আমি আশার আলো পাঠশালায় ভর্তি হই। শুরু করি নতুন জীবন। এখান থেকেই প্রাথমিক, জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে পাশ করি। কলেজে ভর্তি হই। এখন পর্যন্ত আশার আলো সংগঠন আমাকে সহযোগিতা করছে। এখানেই লেখাপড়ার পাশাপাশি মাইক্রোসফটের দেয়া ল্যাবে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। স্বল্প সময়ের মধ্যে এমএস ওয়ার্ড, এক্সেল,পাওয়ার পয়েন্টসহ ব্যাসিক কম্পিউটারে দক্ষ হই।’
এর মধ্যেই ২০১৬ সালে আসেন মাইক্রোসফটের নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশের ম্যানেজিং ডিরেক্টর সোনিয়া বশির কবির। ফাতেমার দক্ষতা দেখেন এবং জীবনের গল্প শোনেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে মাইক্রোসফট এর তত্বাবধানে ফাতেমাকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচার করা হয়। এরপর তারা ফাতেমাকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর মনোনীত করে।
ফাতেমা বলেন, ‘আমাকে অ্যাম্বাসেডর নিযুক্তির খবরটি চলতি মাসে বিশ্বজিত স্যারের মাধ্যমে জানানো হয়। এ সংবাদে আমি অত্যান্ত খুশি। আমার বাবা-মা এবং পরিবারের সবাই খুশি হয়েছে।’
ফাতেমা কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পূর্ব রামখানা গ্রামের আয়নাল হক এবং ফরিদা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। নিজের ইচ্ছাশক্তি এবং আশার আলো পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বজিত বর্মনের সহযোগিতায় অনেক বড় জায়গায় পৌঁছেছেন।
তিনি এখন রায়গঞ্জ ডিগ্রি কলেজের ১ম বর্ষের ছাত্রী। সেইসঙ্গে আশার আলো ওয়ার্ল্ড উইনার আইটির স্কুল অ্যান্ড কলেজের কম্পিউটার প্রশিক্ষক। এখানে তিনি বাল্য বিয়ের সমস্যায় থাকা মেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তার প্রত্যাশা আইটি শিক্ষক হয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মেয়েদের সহযোগিতা করা এবং বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে যাওয়া।