চুপচাপ ধরনের একজন মানুষ। খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া তাকে কথা বলতে শোনা যায় না। যদিওবা বিশ্বের তাবৎ সব ম্যাগাজিন-মিডিয়ার সাক্ষাৎকার দিতে একদম বেগ পেতে হয় না তাকে। পিয়ানো হাতে সুরের মুর্ছনায় মুগ্ধ করেছেন বিশ্বের কোটি মানুষকে। বলছিলাম ‘মাদ্রাজের মোৎজার্ত’ খ্যাত এ আর রেহমানের গল্প। যিনি সুরের জাদু দেখিয়ে গর্বিত করেছেন পুরো উপমহাদেশকে। দিলীপ কুমার থেকে আল্লাহ রাখা রেহমান, ধর্মান্তরিত হওয়ার পেছনেও রয়েছে অলৌকিকতার ছোঁয়া। সে গল্প যথাসময় করা হবে। প্রথমে চলুন যাওয়া যাক বাহান্নো বছর আগে চেন্নাইয়ের একটি গ্রামে।
৬ই জানুয়ারী ১৯৬৬ মালায়াম ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ এক পিয়ানো আর্টিস্ট আর কে শেখরের পরিবারে এল নতুন সদস্য, নাম রাখা হলো দিলীপ কুমার।পিয়ানো আর্টিস্ট শেখর আস্বস্ত হলেন, যাক এবার তার ছেলে পারবারিক ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখবে। মাত্র চার বছর বয়স থেকে বাবার পাশে বসে পিয়ানো বাজানো শুরু করেন দিলীপ। ছোট্ট দিলীপের আগ্রহ ছিল বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্রতি। বাবার পিয়ানো হাতে পেয়ে তার মন্দ লাগলো না। মাত্র নয় বছর বয়সে পিঁয়ানো বাজাতে দক্ষ দিলীপ, স্টেজ শোগুলোতে পার্ফম করা শুরু করলেন। অবশ্য এর পিছনে পরিবারের অর্থনৈতিক সমস্যাও ছিল। দিলীপ কুমারের বয়স যখন এগারো, তার বাবা পরলোকগমন করেন। ছোট্ট দিলীপকে ছাড়তে হলো স্কুল, ধরতে হলো পরিবারের হাল। পিঁয়ানো বাজিয়েই সংসার চলতো দিলীপ কুমারের। এসময়ে বাবার বাদ্যযন্ত্রগুলো ভাড়ায় দিয়ে সংসার চালাতেন দিলীপ কুমার। এছাড়া বাবার এক বন্ধুর অর্কেস্ট্রায় কাজ করতেন তিনি। এসময় এ আর রেহমানকে পড়াশুনা ছাড়তে হলেও বিশেষ পারদর্শীতার জন্য লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ তাকে ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের উপর পড়াশুনা করার সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে মাদ্রাজে অধ্যয়নরত দিলীপ বন্ধুদের সাথে নিয়ে নেমেসিস নামক একটা ব্যান্ডও চালাতেন।
১৯৮৮ সালে দিলীপ কুমারের পরিবারে আবারও নেমে আসে ঘোর বিপদ। দিলীপের বড় বোন আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। ডাক্তাররা জানালেন, তাদের পক্ষে আর তাকে বাঁচানো সম্ভব না। মুসলিম বন্ধুর পরামর্শে দিলীপ কুমার অঙ্গীকার করেন, তার বোন যদি সুস্থ হয়, তিনি তার পরিবারসহ ইসলাম ধর্মগ্রহণ করবেন এক শীতের বিকালে পুরোটাই কাটালেন হজরত নাজিমুদ্দিন আউলিয়া (রা:) এর মাজারে, আল্লাাহর জিকির করে। অলৌকিকভাবে তার বোন সুস্থ হয়ে ফিরে আসলেন মৃত্যুর কোল থেকে। দিলীপ কুমার তার পুরো পরিবারসহ ধর্মান্তরিত হলের। নিজের নাম রাখলেন আল্লাহ রাখা রেহমান/এ আর রেহমান।
ততদিনে এ আর রেহমান শুধু পিঁয়ানো বাজা থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের ছোট্ট জিংগেল সুর করতে শুরু করেন। এমন সময় তার পরিচয় হয় বলিউড পরিচালক মানি রত্নমের।
মানি রত্নম এ আর রেহমানকে তার নতুন ছবির ‘রোজা’-র সুরকারের দায়িত্ব দেন রেহমানকে। ১৯৯২ সালে মুক্তি পাওয়া রোজার গানগুলো ছড়িয়ে যায় মানুষের মুখে মুখে। এই সিনেমায় দেয়া সুরের জন্যই, ন্যাশনাল সিলভার লোটাস পুরষ্কার জিতেন রেহমান। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাকে। ‘ছাইঁয়া ছাইঁয়া,উড়ভাশি’-র মত জনপ্রিয় গানগুলো দিয়ে এ আর রেহমান আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান। প্রযুক্তিপ্রেমী রেহমান ১৯৯২ সালে পাঞ্চানাথাম নামে একটা হাই টেক মিউজিক স্টুডিও খোলেন, যা ছিল এশিয়ার অন্যতম সেরা স্টুডিও। একের পর এক সাফল্য পাওয়া রেহমান ১৯৯৫ সালে সায়রা বানুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ২০০২ সালে ‘লাগান’ সিনেমার মাধ্যমে অস্কারে পরিচিম হন এ আর রেহমান। সেবার কোন পুরষ্কার না পেলেও, হলিউডে নিয়মিত কাজ পেতে থাকেন এর পর থেকেই।
২০০৩ সালে ব্রিটিশ সুরকার অ্যান্ডিউ ওয়েবারের সাথে কাজ করেন লন্ডনের কিছু স্টেজ শো তে। এর পরেই ‘The lord of the rings’,’Inside Out’ ‘Elizabeth’ এর মত হলিউড মুভিতে সুর এবং আবহসঙ্গীত দেন এ আর রেহমান।
২০০৪ সালে ‘ টাইমস ম্যাগাজিন ‘ তাকে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৯ সালে লন্ডনের ওয়ার্ড মিউজিক ম্যাগাজিন তাকে “ভবিষ্যৎ পৃথিবীর মিউজিক আইকন” দের মধ্যে একজন বলে অভিহিত করে।
কিন্তু ২০০৯ সালে ড্যানি বয়েল পরিচালিত,’Slamdog Millionare ‘ মুভিতে অসাধারণ কাজ করে প্রথম ভারতীয় সুরকার হিসেবে দুইটি ক্যারিয়ারে অস্কার জিতেন এ আর রেহমান। সম্প্রতি এ আর রেহমান বলেন ‘Slumdog Millionaire’ এ কাজ করার সময় পেয়েছিলেন মাত্র বিশ ছাড়া। একটি গোল্ডেন গ্লোব, দুইটি গ্রামি, একটি ব্রিটিশ এ্যাকাডেমি অফ মিউজিক এন্ড টেলিভিশন আর্ট এওয়ার্ড, ১৫টি ফিল্ম ফেয়ার, ১৬টি ফিল্ম ফেয়ার সাউথসহ আরও অজস্র পুরষ্কার জিতেন তিনি।
এ আর রেহমান ,’127 Hours’ ‘Pele:The Birth of a Legend’, ‘Rockstar’ ‘Highway’ সিনেমাগুলোতে কাজ করে প্রশংসিত হন।
ব্যক্তিগত জীবনে মৃদুভাষী রেহমান যথেষ্ঠ ধার্মিক। তার রয়েছে নিজের একটি মিউজিক স্কুল।
বর্তমানে উপমহাদেশে এ আর রেহমানের মত বিশ্ব পরিচিত-প্রশংসিত সুরকার আর নেই। এজন্য উপমহাদেশে এ আর রেহমান একজর উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে দ্যুতি ছড়াবেন, যতদিন গান শোনা হবে, গান লেখা হবে,গান সুর করা হবে।
মোহাম্মদ সালাহ : খ্যাতির শিখরে উঠেও ইসলামকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন ফুটবলের নতুন রাজপুত্র