দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত কারাবন্দি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। তার ‘অসুস্থতা’ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে রাজনীতির মাঠে বইছে নতুন মিশ্র হাওয়া। যদিও গতকাল শুক্রবার কারা চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া সম্পূর্ণ সুস্থ রয়েছেন।
এরই মধ্যে গতকাল শুক্রবার বিকেলে কারাগারে গিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান শিথি, খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ডা. মামুনসহ পরিবারের ছয় সদস্য। তারা প্রায় ৩০ মিনিট বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে একান্তে সময় কাটিয়েছেন।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে খালেদা জিয়াকে জামিনে মুক্তি দিয়ে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। দলটি বলছে, খালেদা জিয়া অসুস্থ হওয়ায় গত বৃহস্পতিবার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তার সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করতে পারেননি। গতকাল শুক্রবারও বিএনপির পক্ষ থেকে তার স্বাস্থ্য পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার জন্য যা যা দরকার, তার সবই করা হবে। দেশে কিংবা বিদেশে- সুচিকিৎসা যেখানে দরকার হয়, সেখানেই করা হবে।
গতকাল বিকেলে যোগাযোগ করা হলে কারা চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান খালেদা জিয়ার ‘সম্পূর্ণ সুস্থ’ থাকার কথা জানিয়ে বলেন, কারাগারে আসার আগে তার শারীরিক অবস্থা যেমন ছিল, এখনও তেমন আছে। এখানে তার বিশেষ কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়নি। তার প্রেশার ভালো। ডায়াবেটিস নেই। তাই বাড়তি কোনো ওষুধও দিতে হয়নি। তবে একটি মাল্টিভিটামিন খাচ্ছেন। আর আগে থেকেই তার পিঠ ও হাঁটুতে ব্যথা রয়েছে। তিনি আর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। বার্ধক্যজনিত কিছু সমস্যাও মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, খালেদা জিয়া ও তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কারা চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান বলেন, নিয়মিত খালেদা জিয়ার শারীরিক পরীক্ষার জন্য একজন চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট রয়েছে। তারা প্রতিদিন তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তিনি গুরুতর কোনো শারীরিক সমস্যায় ভুগলে অবশ্যই তাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দেখানো হতো। তবে সে ধরনের কিছু হয়নি। তিনি নিয়মিত কারাবিধি অনুযায়ী খাওয়া-দাওয়া করছেন। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ডা. মামুন এসে তাকে দেখে যাচ্ছেন।
কারা সূত্র জানায়, গতকাল বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারীদের মধ্যে ছিলেন ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমানের স্ত্রী সৈয়দা শর্মিলা রহমান শিথি, নাতনি জাহিয়া রহমান, ভাই শামীম এস্কান্দার, ভাবি কানিজ ফাতেমা, শামীম এস্কান্দারের ছেলে অভিক এস্কান্দার ও ভাগ্নে ডা. মো. মামুন। এই প্রথম কোকোর স্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে কারাগারে গেলেন। প্রায় ৩০ মিনিটকাল অবস্থানের সময় তারা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন ও কথা বলেন। তবে এ বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কারাগারের দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে বাইরে পাল্টাপাল্টি যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। তিনি পুরোপুরি সুস্থ রয়েছেন।
সর্বশেষ গত বুধবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় রাজধানীর বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে খালেদা জিয়াকে হাজির করার দিন ধার্য ছিল। কুমিল্লায় হত্যা মামলায়ও তাকে আদালতে হাজির করার জন্য একই দিন ধার্য ছিল। তবে বুধবার কোনো আদালতেই তাকে কারা কর্তৃপক্ষ হাজির করেনি। ওই দিন দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের জানান, ‘অনিবার্য কারণে কারা কর্তৃপক্ষ খালেদা জিয়াকে আদালতে হাজির করেনি।’
আদালতে হাজির না করার কারণ হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষ আদালতকে জানায়, আগে থেকেই খালেদা জিয়ার হাতে ও পায়ে ব্যথা ছিল। আদালতে নেওয়ার জন্য তিনি শারীরিকভাবে উপযুক্ত নন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে ঢাকার সিভিল সার্জন গত বুধবার কারাগারে যান। তারা তার সঙ্গে শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা বলেন। তবে সিভিল সার্জন তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন দেননি।
এর আগে গত ২৫ মার্চ বিএনপির ছয় আইনজীবী কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই দিন কারা ফটকে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা জমিরউদ্দিন সরকার সাংবাদিকদের বলেন, ‘খালেদার মনোবল শক্ত রয়েছে। তিনি শারীরিকভাবে ভালো আছেন।’
তবে গত বৃহস্পতিবার মির্জা ফখরুল ইসলাম কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারার পর থেকে তার স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন করে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়। গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তাদের সুস্পষ্ট প্রস্তাব রয়েছে। তা হচ্ছে, খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের অবিলম্বে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য যেতে দিতে হবে। তাদের সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোত্তম ব্যবস্থা হচ্ছে, ফলো আপ চিকিৎসার জন্য দ্রুত তাকে জামিন দিয়ে বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা।
তবে সংশ্নিষ্ট কেউ কেউ জানাচ্ছেন, মির্জা ফখরুল ইসলামের এই দাবি বিএনপির হাইকমান্ডের কেউ কেউ ভালোভাবে নেননি। তাদের ভাষ্য, এটাকে ‘সুযোগ’ হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে। বিএনপির অনেকেই আশঙ্কা করছেন, সুচিকিৎসার কথা বলে খালেদা জিয়াকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘কারাগারে অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। কারামুক্তির পর খালেদা জিয়া দেশে নাকি বিদেশে চিকিৎসা করাবেন, সে বিষয়ে তিনি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবেন।’
এদিকে গতকাল শুক্রবার ঢাকার ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সভা শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, খালেদা জিয়ার অসুস্থতার মাত্রা বুঝে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী সব ব্যবস্থাই নেবে সরকার। জেলে আছেন বলে তার প্রতি অমানবিক আচরণ করার মতো সরকার তারা নন। অবশ্যই দেশে তার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। তবে বিদেশে নেওয়ার দরকার হলে তাই করা হবে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় দণ্ডিত হয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। নাজিমুদ্দিন রোডের পুরাতন কারাগারের ডে-কেয়ার সেন্টারে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দির মর্যাদায় তাকে রাখা হয়েছে।