৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। রায়ে খালেদা জিয়ার পাঁচ বছরের জেল ও জরিমানা হয়েছে। দুবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এখন কারাগারে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে খোঁজখবর রাখে, এমন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো এ ঘটনার পর বাংলাদেশের রাজনীতি, দেশটির প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অবস্থান, দুই দলের দুই নেত্রীর ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক জীবন নিয়ে নানা মন্তব্য প্রতিবেদন, সংবাদ ও নিবন্ধ প্রকাশ করছে।
এসব লেখনীতে অনেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। দ্য ডিপ্লোম্যাট এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ে বিশ্লেষণী লেখা প্রকাশের জন্য সুনাম কুড়িয়েছে। গতকাল ১৬ ফেব্রুয়ারি জাপানভিত্তিক এই অনলাইনটি খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের পরে দেশটির রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংবাদ বিশ্লেষণ প্রকাশ করে। বিশ্লেষণটি লিখেছেন কে এস ভেঙ্কটাচালাম। যিনি একজন স্বাধীন কলাম লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত। ভেঙ্কটাচালামের মতে, খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে যাচ্ছে। দেশের মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা দানা বাঁধছে।
ভেঙ্কটাচালাম বলছেন, বিএনপির চেয়ারপারসনের এমন একটা সময় জেল হলো, যখন দেশটির পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাঁর মতে, দেশের প্রধান দুই জনপ্রিয় নেতার মধ্যে একজন খালেদা জিয়া। অপরজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে যদি কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেন, তিনি খালেদা জিয়াই। বিএনপি ছাড়া অন্য কোনো দল আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা রাখে না।
বিএনপি ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বয়কট করেছে। খালেদা জিয়াকে মুক্তি না দিলে ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনও বয়কট করার হুমকি দিয়ে আসছে দলটি। বিএনপি অভিযোগ করছে, সরকার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মামলার রায়কে প্রভাবিত করেছে। এ পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছে। খালেদা জিয়া নির্বাচন না করলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। আর সেটি হলে বিরোধী মত বলতে কিছু থাকবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। সে রকম কিছু হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে কঠিন সময় পার করতে হবে।
দ্য ডিপ্লোম্যাটের সংবাদ বিশ্লেষণ বলছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে সীমাহীন দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে আসে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনেও সে সময়ে বাংলাদেশকে বিশ্বে শীর্ষ দুর্নীতির দেশ বলে উল্লেখ করে। খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ও তাঁর বন্ধুরা মিলে সরাসরি ছায়া সরকার চালিয়ে চাঁদাবাজি ও ঘুষের বাণিজ্য গড়ে তোলেন। সরকার ভয়ংকর যে কাজটি করেছিল, তা হলো জঙ্গিবাদের বিস্তারে সরাসরি মদদ দিয়েছিল। তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকেও গ্রেনেড হামলা করে হত্যার চেষ্টায় সরাসরি তারেক রহমান ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যায়। সেই হামলায় আওয়ামী লীগের দুই ডজন শীর্ষ নেতা মারা যান। তিন শতাধিক নেতা-কর্মী আহত হন। শেখ হাসিনা মৃত্যুর কাছ থেকে পাকেচক্রে বেঁচে ফেরেন।
খালেদা জিয়ার সেই সরকারের মেয়াদ শেষের প্রান্তে আবার ‘অভিনব নাটক মঞ্চায়িত’ হতে দেখা যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বড় দুই দলের মতানৈক্যে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত সরকার ক্ষমতা নেয়। ৯০ দিনের সে সরকার প্রায় দুই বছর শেষে ক্ষমতা ছাড়ে। এরপর সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তৎকালীন মহাজোট সরকার গঠন করে। সামনের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে দুই দলই এখন রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়াতে চাইছে। খালেদা জিয়ার কারাদণ্ডের রায়ে আগুনে ঘি যুক্ত হয়েছে। যদিও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হাসিনার সরকার দেয়নি। ২০০৭-এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ মামলাটি দায়ের করেছিল। সেটির রায় এ বছর এসে হলো।
ভেঙ্কটাচালাম বলছেন, দুর্নীতির বিচার হয়েছে, নাকি নির্বাচন সামনে রেখে সরকার রাজনৈতিক চাল চেলেছে, সেটি এখন আলোচনার মূল বিষয়। বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ ছেড়ে দেওয়ারও কিছু নেই, আবার তাকে মাঠে দাঁড়াতে না দিয়ে সম্পূর্ণ এক মতের সরকার গড়লে সেটিও গণতন্ত্রকেই বিপন্ন করে তুলতে পারে। দরকার এখন রাজনৈতিক সমঝোতার। বিশেষজ্ঞদের তা-ই মত। জনগণও হয়তো সেটির দিকেই তাকিয়ে আছেন।
দ্য ডিপ্লোম্যাট অবলম্বনে…