দুর্দমনীয় চেঙ্গিস বাহিনীর পরাজয় মুসলমানদের হাতেই!

0

মানব সভ্যতার ইতিহাস কখনো সংকুচিত হয়ে পড়েনি। বরং কালে কালে করেছে বিস্তৃতি লাভ। যাদের হাত ধরেই রচিত হয়েছে ইতিহাস, তারা যে সারা জীবন জয়ীই হয়েছে তাও না। একেক যুগে একেক সভ্যতার উৎসারন ঘটেছে। আবার পরাজয়ও ঘটেছে তেমনি। এমন এক ইতিহাস রচনাকারী জাতি ছিল মঙ্গলীয়রা। যাদের হাতে এক সময়ে অর্ধবিশ্ব শাসিত হয়ে আসছে। আর এই মঙ্গোলীয়দের ইতিহাস শুরু হয়েছেও এক বিখ্যাত পুরুষের হাত ধরে, যাকে আমরা সবাই এক নামে চিনি। তিনি আর কেউ নন, ইতিহাসের বহুল সমালোচিত রাষ্ট্রনায়ক তেমুজিন ওরফে চেঙ্গিস খান।
চেঙ্গিস খান
১২০৬ সাল। তৎকালীন মঙ্গলীয় বীর তেমুজিনকে দেয়া হলো গ্রেট খান উপাধি। এই গ্রেট খানই চেঙ্গিস খান। যিনি সমগ্র মঙ্গোলীয়দের এক জাতিতে পরিণত করতে সমর্থ হন। এবং বনে যান মঙ্গোলীয়ার স্তেপের রাজাধিরাজ। সেখান থেকেই শুরু মঙ্গলীয়দের জয়। জয় করলো তারা ইউরোপ। জয় করলো এশিয়া। মালিক হলো প্রায় অর্ধবিশ্বের। লুট করলো রাজ্যের পর রাজ্য। দখল করলো ভূখণ্ডের পর ভূখণ্ড। তারাই পরিণত হলো তৎকালীন বিশ্বের ত্রাসে।

এতকিছু তাদের দখলে চলে গেল, কিন্তু সময় লাগলো মাত্র বছর পঞ্চাশেক। এই পঞ্চাশ বছরে তারা শুধু জয়ই করেছে বিভিন্ন রাষ্ট্র। একেকবার একেক রাষ্ট্রকে আত্মসমর্পণ করার জন্য বলেছে। সমর্পণ না করলেই শুরু করেছে গণহত্যা। লাখ লাখ সামরিক বেসামরিক লোক খুন হয়েছে তাদের হাতে; বাদ যায়নি সাধারন জনগণও। বিস্ময়কর ব্যপার বটে! এতগুলো যুদ্ধ করেছে তারা এই অর্ধশত বছরে। কিন্তু কোনো যুদ্ধেই তারা না জিতে ফিরেনি।
মঙ্গলবাহিনী
মঙ্গলীয়দের এই বাহিনীর নাম ছিল তাতার বাহিনী। আলেপ্পো, সমরখন্দ, বাগদাদ, বুখারা, বেইজিং কোনো শহরই রক্ষা পেলো না এই তাতারি হামলার হাত থেকে। মাটির সাথে মিশে গেলো সব। পূর্ব পশ্চিমের সব রাজ্যই তখন তাদের ভয়ে তটস্থ। এমন কোনো রাজ্যের সাহস হয়নি তাদেরকে রুখে দেবে।

এই যখন অবস্থা, চেঙ্গিস খান মারা গেলেন। তবু থামেনি তার বাহিনী। পাগলা ঘোড়ার মত দাপিয়ে বেড়াতে লাগল বিশ্বজয়ের নেশায়। কোটি কোটি মানুষ মারা গেলো তাদের আক্রমণে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায়।

কিন্তু সবকিছুরই অবসান আছে। আসলো ১২৬০ সাল। ক্ষেপা মঙ্গলীয়দের পরাজয়ের বছর। এ যেন সেই প্রবাদের মত, পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে। তাতারিদের রাজ্য জয়ের এই পাগলা নেশাকে পিপীলিকার পাখা গজানোর অবস্থার সাথে তুলনা করা যেতে পারে।

মঙ্গলদের যখন উত্থান হলো সেইসময়কার মধ্যপ্রাচ্য ছিল ছোট ছোট কিছু মুসলিম রাজ্য অধ্যুষিত। এদিকে তাতারিদের রাজ্যজয়ের পথিমধ্যে মুসলিম এই দেশগুলোও ছিল। তাতার বাহিনী এক সময়ে এসে এই রাজ্যগুলো একেবারে ধ্বংস করে দেয়ার ছকও আঁকে। আর সেটাই তাদের জন্য শেষ পরিণতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মোঙ্গল বাহিনী
মুসলিম শাসন তখন আব্বাসীয় শাসকদের হাতে। কিন্তু এই আব্বাসীয়দের কেবল পূর্বপুরুষের ইতিহাস ঐতিহ্য ছাড়া নিজেদের বলতে গৌরব আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। তাদের রাজধানী ছিল বাগদাদে। নিজেরাই নিজেদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ত যখন তখন। মত্ত থাকত আরাম আয়েস আর ভোগ বিলাস নিয়ে।

এই যখন তখনকার (মধ্যপ্রাচ্যের) মুসলিমদের অবস্থা, হালাকু খান আক্রমণ করলেন বাগদাদ। আক্রমণের কারণ ছিল, ধর্মীয় আক্রোশ। তাছাড়া আব্বাসীয় খিলাফত তখন প্রচুর ধনসম্পদে পরিপূর্ণ। এই সম্পদ লুণ্ঠনের লোভও সামলাতে পারেননি হালাকু খান। এই আক্রমণে ধুলোয় মিশে গেলো বাগদাদ; হলো লুণ্ঠিত ও নির্যাতিত। প্রাণ গেলো দশ লক্ষ বাগদাদীর।

কিন্তু থামলেন না হালাকু খান। আক্রমণ করলেন ইরাক, লুটে নিলেন সিরিয়া, নজর দিলেন মিশরের দিকে। বিভিষিকা দেখলো আলেপ্পোও। মুসলিম অধ্যষিত এই শহরের মানুষদের অনেকেই খুন হালো, কেউ কেউ দিকবিদিক জ্ঞান শূণ্য হয়ে পালাতে শুরু করলো। চেঙ্গিস বাহিনীর নেতা হালাকু খানের তখনকার আপাতত প্ল্যান মিশর জয়। তখন মিশর জয় করতে পারলেই আফ্রিকা জয়ের স্বপ্ন পূরণ হবে আর স্পেনে ঢোকার পথ হবে উন্মুক্ত। স্পেনে ঢুকতে পারলে তো আর কথাই নেই ইউরোপ দখলেরও স্বপ্ন হবে পূর্ণ।
চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরী পূরণ করতে চলছে তারই বিশ্বজয়ের অপূর্ণ স্বপ্ন পূরণ। মিশরই এখন তাদের টার্গেট।

মিশরের অধিপতি তখন মামলুক সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজ। মঙ্গলবাহিনীর নেতার চিঠি এলো সাইফুদ্দিন কুতজের হাতে। চিঠিতে লেখা মঙ্গোলীয়দের অভ্যাসমতো হুমকি দেয়া বিভিন্ন কথা। চিঠির মুল কথা হল, আত্মসমর্পন না করলেই মৃত্যুর বিভিষিকা দেখতে হবে।
চিঠিতে ছিল তাদের হাতে পরাজিত হওয়া বিভিন্ন জাতির ভয়াবহ ইতিহাসের কথার উল্লেখ। সেই চিঠিতে ছিল তাদের জয়ের ইতিহাস বর্ণনা। তাতে আরো ছিল তাদের বর্বরতার কথা বলে ভয় দেখানো।

মূলত এই তাতারিদের যুদ্ধে নামার আগেই যে অস্ত্র ব্যবহার করার অভ্যাস ছিল, সেটা ছিল রীতিমত ত্রাস বা আতঙ্ক সৃষ্টি করা। আর এই আতঙ্ক সৃষ্টি করেই এর আগে সব রাষ্ট্রকে বাগে এনেছিল। মিশরের সাথেও সেটাই করতে উদ্যত হলো। কিন্তু এখানেই শুরু হলো বিপত্তি।
হাজার ভয় দেখানো কিংবা হুমকি ধামকি দিয়ে পাঠানো চিঠিতে টললেন না সুলতান সাইফুদ্দিন কুতুজ। তিনি জানতেন আগের সব রাজ্যের ঘটনা। অন্যদের মত নিজেও নির্বিবাদে নিজেকে সঁপে দিতে চাইলেন না। মরতে যদি হয়ই তো যুদ্ধ করেই মরব, সেই সিদ্ধান্তে অটল হলেন তিনি। চিঠির উত্তর তো তিনি দিলনেই না। বরং প্রাণ ভিক্ষা চাইবার পরিবর্তে তিনি শিরশ্ছেদ করে হত্যা করলেন তাতারবাহিনীর চিঠি নিয়ে আসা দুতকে।

আর দূত হত্যা মানেই তো অঘোষিতভাবেই যুদ্ধ অবধারিত। সুতরাং মামলুক সুলতান প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন তাতারিদের মোকাবেলার জন্য। এবং তাতে তিনি নিজের দেশের জনগণের সর্বাত্মক সমর্থন পেলেন। এবং দলে দলে কুতুজের বাহিনীতে যোগ দিতেও শুরু করলেন। যোগ দিলেন সিরিয়ার এক কিংবদন্তী কমান্ডারও।

দূত হত্যার খবর পৌঁছালো তাতারি নেতা হালাকু খানের কানে। কালবিলম্ব না করেই মিশর আক্রমণে ছুটলেন তিনি ছয় লক্ষ সৈন্য নিয়ে। কিন্তু পথিমধ্যেই খবর পেলেন মারা গেছে তার ভাই মঙ্গে খান। পাল্টে গেলো সিদ্ধান্ত। তিনি ফিরলেন আবার বাড়ির পথে। সংগে নিলেন পাঁচ লক্ষ সৈন্য। এক লক্ষ পাঠালেন মিশর আক্রণে। দায়িত্ব দিলেন তার বিশ্বস্ত সেনাপতি কিতবুকার হাতে।

কিতবুকার সৈন্য চলছে মিশর আক্রমণে। এদিকে সুলতান কুতুজ বুঝতে পারলেন তাতারি বাহিনীর মুখে পড়া মানেই বিপদ ডেকে আনা। তাই যা করার করতে হবে ঠাণ্ডা মাথায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, মুখে পড়া যাবে না মঙ্গলীয়দের। নিজে নিজের মতো নিরাপদ অবস্থানে শক্ত ঘাঁটি গড়ার পরিকল্পনা করলেন। আর তিনি তাতারিদের যুদ্ধ কৌশল সম্পর্কে আগেই অবগত ছিলেন।

মঙ্গলবাহিনী তথা তাতার বাহিনীর সেনাদের অস্ত্র চালনা এবং অন্যান্য সব কিছুতেই ছিল বিস্ময়কর দক্ষতা। তাদের ক্ষিপ্রতাও বিস্ময়কর। তাদের তুলনায় মুসলিম বাহিনী কিছুই না। এছাড়া তাতারিদের আরো একটি কৌশল ছিল যে কৌশলে তারা সুযোগ বুঝেই প্রতিপক্ষকে ঘিরে ফেলত। তাই আর তারা না পারত লড়তে, না পারতে পিছু হটতে। ফলস্বরুপ বর্বরোচিত হত্যার শিকার হত সবাই।

এই সব কিছুর বিবেচনায় সুলতান এগিয়ে গেলেন আইনজালুত প্রান্তরের দিকে। এবং তাতারি মোকাবেলায় এই জায়গাটিই তার জন্য অধিক নিরাপদ বলে মনে হলো। কারণ সেটি ছিল কিছুটা সংকীর্ণ প্রান্তর। আর সংকীর্ণ প্রান্তর হলে তাতার বাহিনী চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলতে সক্ষম হবে না। এবার যুদ্ধের পালা।

দলে দলে ভাগ করা হলো মুসলমান সৈন্যদের। পেছনে এলিট বাহিনী রেখে তুলনামূলক ছোট দলটি দেয়া হলো সামনে। কারণ তাদের মধ্যে পিছু হটার সম্ভাবনা প্রবল ছিল। ছোট দলটি প্রথমে আক্রমন করতেই মুসলমান সৈন্যদের অবস্থা বেহাল হতে শুরু করল। কিন্তু সুলতান দমে যাবার পাত্র নন। তিনি নিজেই অবতীর্ণ হলে যুদ্ধে, সাহস যোগাতে লাগলেন অন্য সৈন্যদের।

জায়গা যেহেতু সংকীর্ণ, তাই মঙ্গলীয়রা পারল না তাদের পুরনো কৌশল ব্যবহার করতে। চারপাশ দিয়ে ঘিরতে তো পারলোই না, বরং এবার পড়লো মুসলিম এলিট বাহিনীর হাতে। ক্রমশই দিকবিদিক হয়ে পড়ল মঙ্গলবাহিনী। পালাতে শুরু করল তারা। অভ্যস্ত রণকৌশল তাদের কাজে লাগেনি। ধরা খেল মুসলিম বাহিনীর কৌশলের কাছে। পরাজয় হলো একটি জাতির। অবসান ঘটলো একটি ক্ষিপ্ত জনগোষ্ঠির অহংকার। রক্ষা পেলো মুসলিম জাতি। মুক্ত হলো বিশ্ব একটি যুদ্ধপাগল জাতির হাত থেকে। মঙ্গলবধ হলো মুসলমানদের হাতেই।

লেখকঃ আল আমিন