দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বেশ কয়েকটি চক্র রীতিমতো অফিস খুলে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সার্টিফিকেট বিক্রি করে আসছে। এরমধ্যে অন্যতম হলো মহাখালীর ডিওএইচএসের ৩২ নম্বর রোডের ৪৮০ নম্বর বাসায় ‘স্টাডি হেল্প লাইন’ (ওরফে মালিহা গ্রুপ) নামের প্রতিষ্ঠান এবং অন্যটি তেজগাঁও কলেজের পাশে অবস্থিত সাকসেস কোচিং নামের প্রতিষ্ঠান। প্রকাশ্যে এমন অবৈধ বাণিজ্য করলেও এরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
পরীক্ষার ব্যবস্থা না করে কৌশলে ফাঁদে ফেলে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয় তারা। কোনও শিক্ষার্থীর শিক্ষা বিরতি থাকলেও সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে প্রাইভেটে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, কারিগরি বোর্ডের অধীনে ডিপ্লোমা, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসএসসি থেকে মাস্টার্সসহ বিভিন্ন প্রোফেশনাল কোর্স, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি পাস কোর্স এবং মাস্টার্স পাস কোর্সে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কিছু অসাধুচক্র প্রাইভেটে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা এবং সহজে পাস করার সুযোগ আছে বলে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণার জাল বিছিয়ে রেখেছে।
এছাড়া স্ট্যামফোর্ড, সাউদার্ন, আমেরিকা বাংলাদেশ, প্রিমিয়ার অব টেকনোলজি, রয়েল, ইবাইস, সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লাসহ বেশ কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটও বিক্রি করে তারা। যদিও সেসব সার্টিফিকেট ‘ফেইক’ (ভুয়া) বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ।
কিছুদিন পরপর চক্র খোলস বদলাচ্ছে
এর আগে ২০১৭ সালের ১৯ জুন ‘সুলভ মূল্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বিক্রি করছে মালিহা গ্রুপ’ শিরোনামে সংবাদ মাধ্যমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরদিন সকালেই তারা লিংক রোডের (গ-১০৩, মধ্যবাড্ডা, প্রাণ-আরএফএল সেন্টারের বিপরীতে ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা) অফিসের দরজায় তালা ঝুলিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। দীর্ঘদিন লুকিয়ে থাকার পর আবারও প্রকাশ্যে এসেছে তারা। ‘মালিহা গ্রুপ’ এবং ‘এডুকেশন হেল্প সেন্টার’ নাম দিয়ে এখন সার্টিফিকেট বাণিজ্যের পসরা সাজিয়েছে ‘স্টাডি হেল্প লাইন লিমিডেট’ এবং ‘প্রাইভেট স্টাডি হেল্প লাইন’ নামে। `Private Exam Helpline BD’ এবং `Private Study Helpline’ নামে দুটি ফেসবুক পেজ ব্যবহারও করে প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটি দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েও সংগ্রহ করছে কাস্টমার। লিফলেট ছড়ানো হয় রাজধানীর বাসে বাসে।
গত কয়েক মাস ধরে তাদের সঙ্গে একজন আগ্রহী পরীক্ষার্থী সেজে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সংবাদ মাধ্যমে এ প্রতিবেদককে তারা ঠিকানা দিতে চায়নি। কয়েক মাস আগে জানানো হয়েছিল তাদের অফিস নর্দা এলাকায়। এর দুই মাস পরে জানায়, তাদের অফিস উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে। সর্বশেষ গত ২১ মে জানানো হলো তাদের অফিস মহাখালীর ডিওএইচএসের ৩২ নম্বর রোডের ৪৮০ নম্বর বাসার দোতলায়।
জানা গেছে, এই চক্রটি গত এক বছরে অফিস বদল করেছে তিন থেকে চারবার।
গত ২৪ মে সকালে এই চক্রের অফিসে গিয়ে দেখা যায়, দোতলায় একটি ফ্ল্যাটে সাজানো অফিস। চারটি রুমে চেয়ার-টেবিল বসিয়ে কর্মীদের ডেস্কের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামনে করা হয়েছে রিসিপশন ডেস্ক। কাস্টমারদের বসার জন্য রাখা হয়েছে কয়েকটি সোফা। প্রতিটি কক্ষে লাগানো হয়েছে সিসি ক্যামেরা। এমনকি সিঁড়ির ভেতরে এবং ফ্ল্যাটে ঢোকার দরজার ওপরেও রয়েছে সিসি ক্যামেরা। আর দরজার বাইরে বাড়তি একটি কলাপসিবল গেট লাগানো হয়েছে। এই অফিসে ৭ থেকে ১০ জন নারী কর্মী এবং অন্তত ৫ জন পিয়ন কর্মরত রয়েছে।
নারী কর্মীদের পদ এখানে ‘স্টুডেন্ট কাউন্সিলর’। প্রাইভেটে পরীক্ষা দিতে আগ্রহী একজন হয়ে মিতু নামে এক কর্মীর সঙ্গে অফিসে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, স্কুল-কলেজ, উন্মুক্ত এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রাইভেট পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। নোট-সাজেশনসহ প্রোপার কেয়ার দিয়ে নিশ্চিত পাসের সমাধান রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অরজিনাল সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। এসবের বিনিময়ে নির্ধারিত রয়েছে আলাদা আলাদা পরিমাণ অর্থ।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে স্ট্যামফোর্ড, সাউদার্ন, আমেরিকা বাংলাদেশ, প্রিমিয়ার অব টেকনোলজি, রয়েল, ইবাইস, সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা’র যেকোনও বিভাগের সার্টিফিকেট দিতে পারেন বলে জানান তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ভেদে সার্টিফিকেটের দাম ৩ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা চাইলে অনেক দরকষাকষির পর ওই কর্মী নিজ হাতে লিখে একটি চিরকুট মেলে ধরেন এই প্রতিবেদকের সামনে। সেখানে দেখা যায়, সাউদার্ন, আমেরিকা বাংলাদেশ এবং প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট দিতে পারবেন ৬০ হাজার টাকায়। স্ট্যামফোর্ড, রয়েল এবং ইবাইস ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট দিতে পারবেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় এবং সিটি, ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা এবং গণবিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট দিতে পারবেন ২ লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে। মাত্র এক মাসেই সেসব সার্টিফিকেট দেওয়ার সম্ভব বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘যেকোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট অর্ডার করলে ৫০ শতাংশ টাকা তখনই দিতে হবে। বাকি টাকা সার্টিফিকেট নেওয়ার সময়। আর সার্টিফিকেট দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে অনলাইন ভেরিফিকেশন করিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হবে সেই সার্টিফিকেট অরজিনাল। ফলে ভুয়া সার্টিফিকেট হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। নির্দ্বিধায় নিতে পারেন।’
কীভাবে অরজিনাল সার্টিফিকেট দেবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তাদের মালিকের সঙ্গে এসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খুব ভালো সম্পর্ক। এ জন্য টাকা দিলেই তারা সার্টিফিকেট তৈরি করে দিতে পারেন।’
ওইদিন কথা বলে ফিরে আসার পর সার্টিফিকেট নেবো কিনা, অথবা কবে নেবো জানতে একাধিকবার ফোন করেন মিতু। অনুসন্ধানের জন্য গত ২৬ মে দ্বিতীয়বারের জন্য অফিসটিতে গেলে দেখা যায়, রিসিপশনে সুমান নামে একজন রিসিপশনিস্টসহ চার-পাঁচজন পিয়ন রয়েছেন।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, জিয়াউর রহমান সোহেল এবং কামরুন্নাহার মিতু স্বামী-স্ত্রী এই চক্রের হোতা। জিয়াউর রহমান সোহেল তার স্ত্রী মিতুকে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান পদে রেখে নিজে ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে বসেছেন। তারা সবসময় গাঢাকা দিয়ে চলেন। পরে অনেক চেষ্টা করেও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।