১.
ম্যাকগাইভার : ১৯৯১ (বিটিভি) – বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে ম্যাকের কপালে। সচল টাইম বোমার সামনে বসে আছে সে। জুতোর বাক্সের সমান একটা বোমার বাক্স। হাতে আছে আর সেকেণ্ড বিশেক। খুব ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় বাক্সের ভেতরে ছোট্ট একটা হ্যামার আছে, অনেকটা হাতঘড়ির ব্যাটারীর মতো দেখতে। সময় হয়ে গেলেই খাড়া নেমে আসবে সেটা। এক বাড়িতেই সব উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সেটাকে থামাতে গেলে কী দিয়ে ঠেকানো যায়! ছোট্ট একটা কাঁচি দিয়ে চেষ্টা করা হলো। হাতলের প্লাস্টিকটার জন্য আটকে গিয়ে জায়গা মতো পৌঁছাল না কাঁচির ব্লেড। আর দশ সেকেণ্ড! কী হবে ম্যাক?? কী আছে হাতে? ৫… ৪… ৩… এই তো, একটা বিজনেস কার্ড। এটা দিয়েই হবে। একটু ঠেলে জায়গা মতো লাগিয়ে দিতেই সময় শেষ! খট করে একটা আওয়াজ করে হ্যামার নেমে এলো নিচে। সংযোগ ঘটেনি। বোমা ফাটল না! হাঁপ ছেড়ে বাঁচল ম্যাক। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল দর্শকদের ।
ঢাকা অ্যাটাক ২০১৭ (শ্যামলী হল) : ভিলেনের মুখে দাঁত ক্যালানো হাসি- ‘আমার নিজস্ব টেকনিক দিয়ে বোমা বানিয়েছি। একসাথে বোমা ব্লাস্ট সেলিব্রেট করব এবার।’ ওদিকে হাতে আছে ২০ সেকেণ্ড। আরেফিন শুভ বোতল খুলে মুখে পানি ছিটাচ্ছেন। কী হবে এবার? নিজস্ব টেকনিক মানে তো একেবারেই নিজস্ব! আর কী শেষ রক্ষা হবে? আরে এই তো বোতল! জলদি বোতল কেটে গেটিস দাও! কেটে কেটে বাক্সের ভেতর ঢুকিয়ে দিতেই হ্যামার নেমে এলো- খটাং! সংযোগ ঘটেনি। বোমাও ফাটেনি। ভিলেন জিসানের মুখ চুন;
হলজুড়ে দর্শকদের হুল্লোড়। আমি ভাবছি- এ আমি কী দেখলাম!!
২.
মাহিয়াকে নেয়া পরিচালকের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে মনে করছি। এই ভুল মাহির নয়। সে প্রচলিত বাংলা ছবিতে অভিনয় করে অভ্যস্ত। একটু অফট্র্যাকের বাংলা ছবিতে কী করতে হবে জানে না। পরিচালক তাকে কাজে লাগাতে পারেননি।
সত্যি কথা বলতে কী, এই ছবি তৈরি করা হয়েছে দর্শকদের গতিময়তার আনন্দ দেবার জন্য। দুই নায়িকা মাহি আর নওশাবা ক্রমাগত স্পিড ব্রেকারের কাজ করেছে। দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসারের ঘরে গর্ভবতী স্ত্রী থাকবে এ তো বহুল ব্যবহৃত সিনেমা টেকনিক! ওদিকে টাইম বোমা নিয়ে শুভ গলদঘর্ম, অপরাধীর খোঁজে সুমন উদভ্রান্ত- এই অবস্থায় গল্পকে এগিয়ে যেতে পথ আটকে রাখছে সুমনের হাসপাতালগামী স্ত্রী। চিত্রনাট্যকারকে দর্শকদের আসনে বসে আরো ভাবতে হতো। সিকুয়েলে এ সব ঠিক হয়ে যাবে আশা করি।

৩.
তিনজন অভিজ্ঞ, বর্ষীয়ান অভিনেতাকে নিয়ে এই ছবিতে কী করানো হয়েছে? হাসান ইমাম গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছেন। ওইটুকুই তাঁর কাজ। মিটিঙের টেবিলে আলমগীরের ঠোঁটের লিপস্টিক দেখলে ছবির হিরোইনও লজ্জা পাবে। আফজালের ডাবিং কে করেছে? এইসব ছোটখাটো বিষয়ই কিন্তু ধীরে ধীরে বড় আকার নেয়।

৪.
ছবির গ্রাফিকাল কাজ ছিল একেবারেই আনাড়ি লেভেলের। ভিএফএক্স দেখলে মনে হয় ৫/৭ বছর আগের কোন পিসি গেমস দেখছি। গতকালই পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলছিলাম। তিন কোটি টাকা বাজেটের প্রসঙ্গে তিনি খুব খুশি ছিলেন। এই টাকা মালয়েশিয়ায় অনর্থক শুটিং না করিয়ে গ্রাফিক্সের দিকে সুদৃষ্টি দিলে কাজের কাজ হতো।
৫.
কেউ কি ‘নিউ দিল্লী’ হিন্দি ছবিটা দেখেছিলেন? ১৯৮৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত আমার দেখা প্রথম একটা হিন্দি ছবি যাতে কোন গান ছিল না! পুরো ছবিতে ক্রাইম- পুলিশ- রিভেঞ্জ- চেসিং সব কিছু ছিল কিন্তু গান না থাকায় বিস্মিত হয়েছিলাম। এই প্রথম জানতে পারি যে গান ছাড়াও বাণিজ্যিক হিন্দি ছবি হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক ছবিও গান ছাড়া হতে পারে। ‘ঢাকা অ্যাটাক’ থেকেই যদি এডিট করে গানগুলো সরিয়ে ফেলি (কাহিনীর প্রয়োজনে ‘টিকাটুলি’র খানিকটা রাখতে হবে) তাতে ছবির কোন ক্ষতি হয় কি? আমার তো মনে হয় বাড়তি মেদ ফেলে দিয়ে ছবিটা আরো ঝাঁ-চকচকে হয়ে উঠবে। এই ছবিতে আবহসঙ্গীতের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শকদের সামান্যতম সময়ের জন্যেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে দেয়া হয়নি। নীরবতারও নিজস্ব ভাষা রয়েছে- একটু যদি মাথায় রাখা যেত !
৬.
কুড়িগ্রাম শহরের শেষ সিনেমা হলটিও বন্ধ হয়ে গেছে কয়েকদিন আগে। ভাল ছবির অভাবে হল মালিকরা ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন। কুড়িগ্রামের কথা মনে পড়ে। আমার ছোটবেলায় মামার বাড়িতে গেলে মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখতে গিয়েছি। বাংলা ছবির স্বর্ণযুগের শেষ অধ্যায় ছিল সেটি। একটি সমৃদ্ধ শিল্পমাধ্যম ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এই সময়ে ‘ঢাকা অ্যাটাক’ আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে। প্রথম দিনেই দেড় কোটি টাকার টিকেট বিক্রির অর্থ হলো সেই পুরনো মধ্যবিত্ত দর্শক হলে ফিরতে ইচ্ছুক। নির্মাতারা ভাল ছবি দিলে তবেই সুদিন ফিরবে।
ব্যক্তিগত রেটিং : ৫/১০
হলে গিয়ে ঢাকা অ্যাটাক দেখুন।
লেখকঃ নিলয় নন্দী