মেয়ের ছবি এবং মাঝে মধ্যে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তার কবর দেখেই দুটি বছর পাড় করেছি, বার বার সিআইডির অফিসার ন্যায় বিচারের আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিচার মনে হয় পাবো না। মেয়ের শোকে তনুর বাবা তিন মাস অফিসে যেতে পারছে না, বিছানায় পড়ে আছে।’ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যা মামলার দুই বছর পূর্ণ হলো আজ ২০ মার্চ। দুই বছরেও মেয়ে হত্যার বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেন তনুর মা আনেয়ারা বেগম।
দীর্ঘ দুই বছরেও তনুর খুনিরা শনাক্ত কিংবা মামলার অগ্রগতি কি তাও জানে না তনুর পরিবার। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ তনুর পরিবার, স্বজন এবং সচেতন মহল। মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি এরই মধ্যে দফায় দফায় অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও মামলার অগ্রগতির বিষয়ে পরিবার কিংবা মিডিয়ায় এ নিয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজী হননি সিআইডি।
২০১৬ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় কুমিল্লা সেনানিবাসের ভেতরে একটি বাসায় টিউশনি করতে গিয়ে আর বাসায় ফিরেনি তনু। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে রাতে বাসার অদূরে সেনানিবাসের ভেতর একটি জঙ্গলে তনুর মরদেহ পায় স্বজনরা। পর দিন তার বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহায়ক ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে কোতয়ালী মডেল থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। তার মরদেহ দাফন করা হয় জেলার বাঙ্গরা থানাধীন মির্জাপুর গ্রামে।
এ ঘটনায় কুমিল্লাসহ সারাব্যাপী বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করে প্রতিবাদী জনতা, ছাত্র সমাজ ও বিভিন্ন সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন। থানা পুলিশ ও ডিবির পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল থেকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় সিআইডি কুমিল্লা। ঢাকা থেকে একাধিকবার কুমিল্লায় ছুটে যান সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহ্হার আখন্দসহ পুলিশ, র্যাব, সিআইডিসহ একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তরা। কিন্তু ফলাফল এখনও একই বৃত্তে বন্দি।
রহস্যে ঘেরা দুই দফার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন।
ওই বছরের (২০১৬) ৩০ মার্চ কবর থেকে তনুর মরদেহ উত্তোলন করে পুনরায় ২য় দফায় ময়নাতদন্ত করা হয়। কিন্তু ৪ এপ্রিল ও ১২ জুন দাখিলকৃত পৃথকভাবে দুই দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তনুর মৃত্যুর কারণ খুঁজে না পাওয়ার কথা জানায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগ। শেষ ভরসা ছিল ডিএনএ রিপোর্ট। গত বছরের মে মাসে সিআইডি তনুর জামা-কাপড় থেকে নেয়া নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে তিনজন পুরুষের শুক্রানু পাওয়ার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল। তাই দুই দফায় ময়নাতদন্ত করেও মৃত্যুর কারণ খুঁজে না পাওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে এবং এ নিয়ে সচেতন মহলে শুরু থেকেই সমালোচনার ঝড় উঠে। পরে সন্দেহভাজনদের ডিএনএ ম্যাচিং করার কথা থাকলেও তা করা হয়েছে কি না- এ নিয়েও সিআইডি এখনো তনুর পরিবারকে কিছুই জানায়নি বলে জানিয়েছেন তনুর মা।
এদিকে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২২ নভেম্বর ঢাকা সিআইডি কার্যালয়ে তনুর বাবা ইয়ার হোসেন, মা আনোয়ারা বেগম, চাচাতো বোন লাইজু ও চাচাতো ভাই মিনহাজকে দিনভর পুরনো বিষয়গুলো জিজ্ঞেস করেন ঢাকা সিআইডির কর্মকর্তারা। তখনও তাদেরকে সিআইডির পক্ষ থেকে তনুর ঘাতকদের চিহ্নিত ও বিচারের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। কয়েক দফায় তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পর বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছেন সিআইডি কুমিল্লার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দীন আহমেদ। তনুর বাবার অসুস্থতার কথা শুনে ওই তদন্ত কর্মকর্তা সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার তনুর সেনানিবাসের ভাড়া বাসায় গিয়ে আবারো ন্যায় বিচারের কথা শুনিয়েছেন বলে তনুর মা আনোয়ারা বেগম জানিয়েছেন।
পরিবার ও সচেতন মহলে ক্ষোভ ও হতাশা
তনুর মা আনোয়ারা বেগম বলেন, তনুর ছবি ও মাঝে মধ্যে তার কবর দেখেই দুই বছর পাড় করেছি। আমাদের চোখে যারা সন্দেহজনক ছিল তাদের নামের তালিকা ঘটনার পর আমরা সিআইডিকে দিয়েছি। কিন্তু সিআইডি শুধু বার বার আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে কোনো ফলাফল দেখতে পারছি না।
তিনি বলেন, তনুর বাবা মেয়ের শোকে গত ৩ মাস যাবৎ বিছানায়, তিনি অফিসে যেতে পারছেন না। তার শরীরের যে অবস্থা মনে হয় চাকরিটাও করতে পারবেন না। তনুর মা বলেন, দুই বছরে এ দেশে কোনো হত্যার রহস্য বের হবে না, এটা কেমন কথা। আমরা গরীব বলে কি এ বিচার পাবো না? তিনি এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সিআইডি কুমিল্লার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার জালাল উদ্দীন আহমেদ বলেন, তদন্ত অব্যাহত আছে। এ যাবৎ তনুর পরিবার ছাড়াও অন্যান্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে, সঠিক তদন্তের মাধ্যমে রহস্য উদঘাটন করে অপরাধীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।