সম্রাট আকবরের বিতর্কিত ও ব্যর্থ ধর্ম ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ প্রবর্তনের কারন ও ফলাফল

0
দ্বীন-ই-ইলাহী

ইতিহাসে যেসব শাসক, সম্রাট সর্বাধিক আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন, সম্রাট আকবর তাদের অন্যতম। একজন সফল সম্রাট, দক্ষ সেনাপতি, কৌশলী সমরবিদ ও দোর্দণ্ড প্রতাপশালী শাসক বলতে যা বুঝায়, সম্রাট আকবর তার সমন্বিত রূপ। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর শাসন পরিচালনা করা এই মোঘলকে ইতিহাসজ্ঞরা আখ্যায়িত করেছেন ‘আকবর দ্যা গ্রেট’ উপাধিতে।

সম্রাট আকবরের জন্ম ১৫৪২ সালের ২৩শে নভেম্বর। তার জন্ম হয়েছিল এমন এক সময়ে, যখন তার পিতা হুমায়ূন শের শাহ সূরীর কাছে পরাজিত হয়ে অমরকোর্টের হিন্দুরাজা রানা প্রাসাদের রাজ্যে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। নির্বাসিত জীবনের দুর্ভাগা সময়ে জন্ম নেয়া আকবর বরং সৌভাগ্যবান ছিলেন। হুমায়ূনের মৃত্যুর পর মাত্র তেরো বছর বয়সে দিল্লির মসনদে আরোহণ করেন।

আকবর তার শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে ইতিহাসকে যতটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন, অতটা খুব কম ভারতীয় শাসকই করতে পেরেছেন। শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে আকবর তার শাসনকে প্রথমত দুইভাগে বিভক্ত করেন : ১. কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, ২. প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা।
কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার প্রধান ছিলেন স্বয়ং আকবর। অর্থনৈতিক বিভাগ, সমর, বেতন ও হিসাব বিভাগ, বিচার বিভাগ, ডাক বিভাগ, গোয়েন্দা বিভাগসহ কেন্দ্রের অধীনস্থ বিভিন্ন মন্ত্রীদের দায়িত্বে ছিল বিভিন্ন বিভাগ।

আকবরের সময়কালে সাম্রাজ্য বিস্তার চলতেই থাকে। ফলে, বিশাল সাম্রাজ্যকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করার জন্য মোট পনেরোটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি প্রদেশে একজন প্রধান শাসনকর্তা নিযুক্ত হত। এই প্রাদেশিক প্রধানকে বলা হত নাজিম। প্রতিটি প্রদেশের প্রধান বিচারক নিয়োগ দিতেন স্বয়ং আকবর। অন্যান্য বিচারকগণক নিয়োগ পেতেন প্রধান বিচারকের মাধ্যমে। যার দরুন প্রাদেশিক বিচারবিভাগের সমস্ত বিষয়াদিও সম্রাটের গোচরের মধ্যেই থাকত।

দূরদর্শী আকবর তার জীবনে সবচেয়ে বিতর্কিত যে কর্মটির জন্ম দেন, তা হচ্ছে নতুন একটি ধর্ম প্রবর্তন। নতুন ধর্মটির নাম দেন ‘দ্বীন-ই-ইলাহী।’ বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ভারতবর্ষে নতুন ধর্ম প্রবর্তনের উদ্দেশ্য সকলকে এক ছায়াতলে নিয়ে আসা হলেও, কার্যত এটি ছিল একেবারেই অসম্ভব। নতুন ধর্ম প্রবর্তনের প্রেক্ষাপট, কার্যকারণ, রীতিনীতি ও এর ফলাফল আলোচনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

আকবর
সম্রাট আকবর

আকবরের প্রাথমিক ধর্মবিশ্বাস হিসেবে ইতিহাসে ইসলাম পাওয়া যায়। আকবর ছিলেন একজন সাধাসিধে সরল বিশ্বাসী মুসলমান। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নিয়মিত পালন করতেন। তার সময়ে মসজিদে সপ্তাহে সাতদিনের জন্য সাতজন ইমাম নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কি কারনে আকবর ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কাজ কর্ম শুরু করেছিলেন?

দ্বীন-ই-ইলাহী প্রবর্তনের কারণ :
ভারতবর্ষ মূলত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী, বিভিন্ন ভাষা ও ধর্মবৈচিত্রের মিলনকেন্দ্র। বিভেদ হবার মতো এতগুলো বিষয়কে সামনে রেখে নির্বিরোধ রাজ্য পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব এক ব্যাপার। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিদ্রোহ ও যুদ্ধপরিচালনা এটাই প্রমাণ করে। ভাষা ও জাতিভেদের চেয়ে বেশি প্রভাবক ছিল ধর্মবৈচিত্র। ফলে, মুসলমানের সাথে হিন্দুর বিরোধ বা ধর্মীয় ভেদাভেদ রাজ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠা ছিল সময়ের ব্যাপার। তাই ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য আকবরের মাথায় এই অভিনব ধর্ম প্রবর্তনের চিন্তা গেঁথে বসে।

ভাববাদী মতাদর্শ নামের একটি দল আরও আগে থেকেই সব ধর্মের ভেদাভেদ উঠিয়ে দিয়ে সব ধর্মের ভাবাদর্শের সমন্বয়ে একক ধর্ম প্রবর্তনের এক অসম্ভব স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিল। আকবরের সভাকবি, নবরত্নসভার সদস্য আবুল ফযলের বাবা শেখ মুবারক ছিলেন এই ভাববাদী দর্শনের একজন বলিষ্ঠ প্রচারক। ফলে, আবুল ফযলও ছিলেন অভিন্ন মতাদর্শের। আকবরের এই চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে আবুল ফযল সক্রিয় হয়ে ওঠেন। অক্ষরজ্ঞানহীন সম্রাট আকবরের জন্য আবুল ফযল ছিলেন উক্ত ধর্ম প্রবর্তনের প্রধান সহায়ক।

এছাড়াও তৎকালে ভারতবর্ষের শক্তিশালী গোষ্ঠী ছিল রাজপুতগণ। রাজপুতদের সাথে উঠাবসার ফলে হিন্দুধর্মের প্রতি আকবরের অনুরাগ সৃষ্টি হয়। রাজ্যকে শক্তিশালী রাখার জন্য রাজপুতদের সমর্থনও আকবরের জন্য বেশ জরুরী ছিল। আর এই লক্ষ্যেই তিনি রাজপুত নারী যোধাবাইকে বিয়ে করেন। ইসলামের শর্ত অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী হতে হলে ইসলাম গ্রহণের শর্ত থাকলেও আকবর যোধাবাইকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলেন নি। যোধাবাই হিন্দু ধর্মই পালন করতেন।

এইসব কার্যকারণের ফলে আকবর দ্বীন-ই-ইলাহী প্রবর্তন করতে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন এবং ১৫৮২ সালে তা প্রবর্তন করেন।

দ্বীন-ই-ইলাহীর রীতিনীতি ও প্রবর্তন পদ্ধতি :
১৫৭৫ সালে আকবর ফতেহপুর সিক্রিতে একটি উপাসনালয় তৈরি করেন, যার নাম দেন ধর্মসভা। সেখানে বসে বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদের কাছ থেকে তাদের ধর্মের সারকথা, মৌলিক রীতিনীতি ও আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদি শুনতেন। আকবর সেসব থেকে বাছাই করে দ্বীন-ই-ইলাহীর রীতিনীতি প্রবর্তন করেন। ফলে, ইসলাম, হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ইত্যাদির এক মিশ্র রীতিনীতি হয়ে দাঁড়ায় দ্বীন-ই-ইলাহীর মূল ভিত্তি।
দ্বীন-ই-ইলাহীর মৌলিক রীতিনীতিগুলো নিম্নরূপ :

১. দ্বীন-ই-ইলাহীর কালিমা ছিল ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খলীফাতুল্লাহ।’
২. দ্বীন-ই-ইলাহীর অনুসারীরা পরস্পর সাক্ষাতে নতুন প্রথায় সম্ভাষণ জানাত। প্রথমজন ‘আল্লাহু আকবর’ এবং দ্বিতীয়জন উত্তরে ‘জাল্লা-জালালুহু’ বলত।
৩. মদ, জুয়া, সুদ ইত্যাদি বৈধ ছিল।
৪. আকবরকে সিজদা করা হত।
৫. কসাই, জেলে ইত্যাদি পেশার ভিত্তিতে জাতপাত নির্ধারণ করে মেলামেশা পরিহার করা হত।
৬. ইসলামের দুই স্তম্ভ হজ ও যাকাত বাতিল করা হয়েছিল।
৭. দ্বীন-ই-ইলাহীর অনুসারীদেরকে সম্পদ, জীবন, সম্মান ও ধর্ম সম্রাটের জন্য উৎসর্গ করতে হত।
৮. গরু জবাই নিষিদ্ধ করা হয়।

এইসব রীতিনীতি নিয়ে কোনো কোনো ঐতিহাসিক দ্বিমত করার চেষ্টা করলেও ইতিহাসে এগুলোই অধিক প্রসিদ্ধ। আকবরের এই ধর্মের প্রধান শিষ্যরা ছিলেন তার কয়েকজন সভাসদ ও তার সন্তানেরা। বীরবল, যুবরাজ সেলিম, আবুল ফজল ইবন মুবারক, যুবরাজ মুরাদ, কাশিম খান, আজম খান, শেখ মুবারাক, আবদুস সামাদ। সভাসদ ও সন্তানদের সহযোগিতায় আকবর আশ্বস্ত হয়ে দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রচারে মনোনিবেশ করেন।

ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া :
আকবর শাসক হিসেবে দ্য গ্রেট হলেও ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন। শাসনব্যবস্থা শক্ত হাতে সামলালেও জ্ঞানের দৈন্যতায় হোক কিংবা ভিন্ন কারণে, আকবর জনগণের ধর্মীয় মনোভাব ও অনুভূতি বুঝতে পারেননি। ফলে, এই ধর্মের প্রবর্তন করা হলেও কোনো ধর্মের অনুসারীরাই সহজে তা মেনে নিতে পারেননি এবং জনগণের মাঝে তা ব্যাপকভাবে গৃহীতও হয়নি। দ্বীন-ই-ইলাহী প্রবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মুসলিম সম্প্রদায় এবং ইসলাম ধর্ম। আনুকূল্য পেয়েছিল রাজপুতরা।

এই ধর্ম প্রবর্তনের ফলে সামগ্রিকভাবে আকবর হয়ে ওঠেন একজন বিতর্কিত সম্রাট। ঐতিহাসিকদের মতে, আকবরের জীবনে সবচেয়ে অদূরদর্শী সিদ্ধান্তগুলোর একটি এই ধর্ম প্রবর্তন। আবার কেউ কেউ দ্বীন-ই-ইলাহীকে নতুন ধর্মমত হিসেবে মানতেই নারাজ। তাদের এই মানতে না-চাওয়াও যুক্তিযুক্ত। কারণ, একটি ধর্মমতের মৌলিক বিষয়সমূহ; যেমন– স্রষ্টার প্রতি নিবেদন, স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির স্পিরিচুয়াল রিলেশন, স্রষ্টার প্রতিনিধি প্রেরণ, স্রষ্টার দিকে তার আহ্বান, পরকাল-ভাবনা ইত্যাদি বিষয়সমূহের তেমন কোনো উপস্থিতি বা যৌক্তিক সমাধান ছিল না। ফলে, এটা কেবলই একজন প্রতাপশালী সম্রাটের বিলাসী ইচ্ছা ও কারো কারো মতে ‘রাজনৈতিক দূরদর্শিতা’ হিসেবে প্রাধান্য পেয়েছে তাদের কাছে।

প্রকৃতপক্ষেও দ্বীন-ই-ইলাহী ছিল বিভিন্ন ধর্মের সুবিধাবাদী রীতিনীতির জগাখিচুড়ি এক গোঁজামিল মাত্র। যার ফলে, আকবরের মৃত্যুর কিছুদিন পরেই এই ধর্মমত বিলুপ্ত হয়ে যায়। আকবরের পুত্র সম্রাট জাহাঙ্গীরের শেষ জীবনে দ্বীন-ই-ইলাহী বিলুপ্ত হয়। ইতিহাসে বিশেষ করে মুসলমানদের কাছে আকবর এক নিকৃষ্ট সুবিধাবাদী ও ধর্মত্যাগী হিসেবে বিবেচিত হন।

লেখকঃ মাহমুদ সিদ্দিকী