নিষিদ্ধ লোবান: যেখানে ফুটে ওঠেছে চলমান ভয়াবহতা

0
নিষিদ্ধ লোবান: যেখানে ফুটে ওঠেছে চলমান ভয়াবহতা

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াবহ নির্মমতা নিয়ে কম বই নেই। প্রতিটি বইয়ে ফুটে ওঠে পাক হানাদারদের বর্বরোচিত হত্যাকান্ড, আমাদের হাহাকার, ত্যাগ, সাধনার গৌরব, অদম্য সাহসিকতার বিষাদময় বিজয়ের সারাংশ। সৈয়দ শামসুল হক-এর নিষিদ্ধ লোবান এখানে ব্যতিক্রম। চূড়ান্ত বিজয় লিপিবদ্ধ করেননি। তিনি তুলে ধরেছেন চলমান ভয়াবহতা।

বিলকিসের স্বামী আলতাফ পত্রিকা অফিসের চাকুরে। ২৫ মার্চ কালরাত্রের গুরুত্বপূর্ণ কলাম তৈরির দায়িত্ব তার উপর ছিল। রাতে বাড়ি থেকে বের হলেও ঘরে ফেরা হয় না। দিন যায়, মাস গড়ায়। আলতাফের হদিস মেলে না। কোনো চিঠি নেই, কারও মাধ্যমে পাঠানো বার্তা নেই। সহকর্মীরা বলছে আলতাফ ভারতে গেছে। সেখানে মুক্তি ট্রেনিং নিচ্ছে। একদিন ঠিকই ফিরবে। সেই আশায় থাকতে থাকতে বাড়ির কথা মনে পড়ে বিলকিসের। গ্রামের নাম জলেশ্বরী। শান্ত, সুন্দর, ছবির মতো। সেখানে মা, ভাই, দু’টো সন্তান নিয়ে বিধবা বড়ো বোন থাকে। কতদিন হয়ে গেছে বিলকিস কাউকে দেখে না।

পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের নির্দিষ্ট কোচে চেপে বসে বিলকিস। গন্তব্য জলেশ্বরী। নবগ্রামে আসলে ট্রেন থামে। এই স্টেশনে দুই মিনিটের বেশি কখনও না দাঁড়ালেও আজ আর চলে না ট্রেন। যাত্রীরা নেমে পড়ে একে একে। ট্রেনে ওঠার পর থেকে যাত্রীদের মাঝে উৎকন্ঠা ধরতে পারে বিলকিস। ফিস-ফাশ স্বরে কিসের যেন বিপদের সম্ভাবনা ফুটে ওঠে। নবগ্রামে এসে বিলকিসও নেমে পড়ে ট্রেন থেকে। ট্রেন আর এগুবে না। সামনের ব্রিজ মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে।

বিলকিস একা স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে। মানুষগুলো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। যারা বসে আসে তাদের গন্তব্য জলেশ্বরী। বিলকিসের মনে হলো কে যেন তাকে ঝোপের আড়াল থেকে দেখছে। নবগ্রাম থেকে জলেশ্বরী পাঁচ মাইল পথ। হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয় সে। পিছু নেয় একটি ছেলে। সতেরো কী আঠারো হবে বয়স। ঝোপের আড়াল থেকে সে-ই দেখছিল বিলকিসকে। তার নাম সিরাজ। কথাবার্তা বলে বোঝা যায়, এই ছেলে শত্রু নয় বরং মিত্র। তাকে নিয়ে শুরু হয় বিলকিসের যাত্রা।

রাত যায়, ভোর আসে। ওদের অস্থিরতা বাড়ে। বিলকিস লক্ষ্য করে, সিরাজ তাকে কিছু জানাতে চায়। সিরাজ চেয়েও পারে না। অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় চেপে ধরে। বলে ফেলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে। বিলকিসকে সত্য গ্রাস করে নিরবে। সে সত্য জানতো। বিলকিস অভয় দিলে সিরাজ স্বস্তি পায়।

বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ শামসুল হক সব্যসাচী লেখক হিসেবে পরিচিত। কেনো তাকে সব্যসাচী বলা হয়, সাহিত্যের প্রতি বিভাগে নিজের লেখন শক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন। নিষিদ্ধ লোবানেও একেবারে সহজ ভাষায় গভীর বোধ জাগ্রত করতে সক্ষম হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের স্রেফ শরীরের মৃত্যু ঘটেছে। ওরা প্রত্যেকে ফিরে আসে। তাদের অন্তর আত্মা ফিরিয়ে আনে দেশপ্রেম। দেশপ্রেমের সান্নিধ্যে এলে পরিবার, সমাজ তুচ্ছ মনে হয়। মাটির চেয়ে খাঁটি কিছু হতে পারে না। চিতার আগুন কিংবা কবরের মাটি, বেলাশেষে নিঃশব্দের যে প্রবল ঘন্টাধ্বনি স্তব্ধতা ভাঙ্গে, তা তো মাটির কাছে ফিরে যাবার আহ্লাদের প্রকাশ। নিষিদ্ধ লোবানে লেখক বুঝিয়েছেন, যে মৃতদেহে দেশের মাটি লেগে রয়, তার ঘ্রাণ মাদকের চেয়ে ধ্রুপদী, নৈসর্গিক। আঘাত ছাড়া প্রতিরোধ অসম্ভব। নিশ্চল মূর্তি অভিমান করতে পারে, রুখে দাঁড়াবার শক্তি থাকে না। সে কেবলই স্মৃতি রোমন্থন করতে পারে। আঘাতপ্রাপ্ত সত্ত্বা জাতিস্মরে পরিণত হয়। প্রজ্বলিত হয় মশালের মতো। যার দ্যুতি ঝলসে দেয় সমস্ত অপশক্তির অপপ্রয়াসকে। নিষিদ্ধ লোবানের বিলকিস যারা আদর্শ উদাহরণ।