ভারতে বলিউডের ‘পদ্মাবত’ সিনেমাটা (আগে নাম ছিল ‘পদ্মাবতী’ কট্ট্রর হিন্দুদের আন্দোলনের মুখে আদালতে নির্দেশে নাম পদ্মাবত করা হয়েছে) মূলত দিল্লীর সুলতান ‘আলাউদ্দিন খিলজি’ এবং রাণী ‘পদ্মাবতী’র মধ্যকার প্রেম নিয়ে লোক-কাহিনী নির্ভর এবং স্বভাবতই এই সিনেমা তৈরিতে যাদের হাত ছিল তাদের দ্বারা আরও রিফর্ম করা।
রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ মূলত এটা মেনে নিতে চাইছে না যে, ‘পদ্মাবতী’র সাথে আলাউদ্দিন খিলজির কোনও প্রেম ছিল। এত বছর মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের প্রতিরোধ গড়ায় তাদের অনুপ্রেরণার অন্যতম এই উৎসকে তারা দিল্লীর সবচে’ প্রভাবশালী মুসলমান শাসকের প্রেমে দেখতে চান না। বরং তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাকে যোদ্ধা হিসেবেই দেখে অনুপ্রাণিত। যদিও স্বীকৃত ঐতিহাসিক সত্য এটাই যে, ‘পদ্মাবতী’ কেবল রূপকথা। এরপরও সমগ্র ভারতে সিনেমাটা নিয়ে যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, হিন্দুদের মধ্যে তা ‘হিন্দুত্ববাদের’ নব উত্থানের সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দেয়।
অপরদিকে এই সিনেমায় আলাউদ্দিন খিলজির চরিত্রকে ভয়াবহভাবে বিকৃত উপস্থাপন করা হলেও সে নিয়ে মুসলমানদের প্রতিবাদ কিম্বা প্রতিরোধের থেকে বরং সিনেমাটা দেখবার আগ্রহই যেন প্রবল হয়ে উঠেছে। ছবিতে সুলতান এবং তাঁর সেনাপতি মালিক কাফুরকে সমকামী দেখানো হয়েছে। মূলত সুলতানকে দেখানো হইয়েছে মাদকাসক্ত এবং এবং উভকামী যৌনতাতাড়িত জালিম, অত্যাচারী রূপে। অর্থাৎ মানবীয় মন্দ গুণের এমন কোনও কিছুই বাদ রাখা হয় নি যাতে সুলতানকে ঘৃণিতভাবে উপস্থাপনের বাকি রাখে।
আলাউদ্দিন খিলজির প্রয়াণের ২০০ বছর পর সুফি কবি জায়সী রচিত ‘পদুমাবৎ’ তৈরি একটা চরিত্র মাত্র এই ‘পদ্মাবতী’। আর এর ১০০ বছর পর রচিত বৌদ্ধ রাজার অমাত্য মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল এর পদ্মাবতীও একই। এই দুই কখনই ঐতিহাসিক সূত্র হতে পারে না।
সেই সময়ের প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমির খসরু ‘পদ্মাবতীর’ উল্লেখ করেন নি। ষোল শতকের ইতিহাসবিদ ফারিশতা প্রভৃতি মুসলমান ঐতিহাসিকদের কেউই এই কল্পিত ‘হিন্দু রমণী’র অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয় না। নির্ভরযোগ্য হিন্দু ঐতিহাসিক দলিল থেকেও সেরকম কিছুর অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।
সেকালের গ্রীক ইতিহাসবিদেরাও এমন কারও অস্তিত্ব সম্পর্কে জানান নি। ভারতীয় ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব, ব্রজদুলাল চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ভদ্র তাঁদেরও মত, ‘ইতিহাস আলাউদ্দিন খিলজি, চিতোরের রাজা রতন সিং উভয়কেই মানে এবং তাঁদের যুদ্ধের কথাও বলে। কিন্তু তাতে ‘পদ্মাবতীর’ কোনও অস্তিত্ব নেই’।
সিনেমার জন্য একটু টুইস্ট দেবার জন্য কেবল প্রেমকাহিনী ঢুকানো হয়েছে। মূলত উদ্দেশ্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণার চর্চা। সামান্য একটু প্রেমের ইস্যুতে ‘পদ্মাবতী’ হিন্দুত্ববাদীদের প্রতিরোধের মুখে পড়লেও আদতে এটা মুসলিম বিরোধী চলচিত্র। অবশ্য দুই সম্প্রদায়ের জাত্যবোধ বুঝার জন্য অনেকটা মানদণ্ড হয়ে উঠেছে চলচিত্রটি।
একটা কথা আমাদের স্মরণ রাখা উচিত আলাউদ্দিন খিলজি বিজেতা হিসেবে ছিলেন তামাম ভারতের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম। তাঁকে ২য় আলেকজাণ্ডারও বলে কেউ কেউ। উত্তর ভারতের প্রভাবশালী রাজ্য গুজরাট, রণ-থম্ভোর, মালব এবং মেবার বিজয় করেন তিনি। এরপর তিনি মালিক কাফুরের নেতৃত্বে দক্ষিণ ভারতে অভিযান প্রেরণ করেন।
কাফুর দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজা যেমন, রামচন্দ্র, প্রতাপ রুদ্র, তৃতীয় বল্লালকে পরাজিত করেন। অধিকার করেন পান্ড্যব রাজ্য। এভাবে ক্রমে ক্রমে সমগ্র দক্ষিণ ভারত মুসলমানদের হাতে পরাজিত হয়। আলাউদ্দিন খিলজি উদারতা দেখান, কর ও শান্তির বিনিময়ে তিনি পূর্ববর্তী হিন্দু রাজাদেরই অধিকৃত রাজ্যের দায়িত্ব দেন।
মালিক কাফুর নিজেও ভারত শাসন করেছেন। আলাউদ্দিন খিলজি ও মালিক কাফুর উভয়েই মঙ্গলদের পরাজিত করেছেন। আলাউদ্দিনের হাতে পরাজিত হয়েছিল গুজরাটের রাজা কর্ণদেব, মালবের রাজা মহ্লক দেব, রণ-থম্ভোরের রাজপুত রাজা হামির দেব , মেবারের রাজা রতন সিং।
সেনাপতি মালিক কাফুরের হাতে পরাজিত হয়েছে হিন্দুদের প্রাচীন গৌরব, বরঙ্গলের কাকতীয়রাজ, দোরসমুদ্রের হোয়্সলরাজ, পান্ড্যবরাজ আর, দেবগিরির রাজা রামচন্দ্র। ফলত অত্যন্ত স্বাভাবিক ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা এই দুইজনের চরিত্রেই কলঙ্ক লেপন করেছে যথেচ্ছভাবে। ফলত ঐতিহাসিক ভিত্তি ছাড়াই তাঁদের চারিত্রিক কলল্কে মুড়ে দেওয়া হয়েছে।
তাঁরা সমকামী ছিলেন এই দাবিও সেই প্রক্রিয়ার অংশ। এটা একটা ঐতিহাসিক মিথ্যাচার এবং বানোয়াটকাহিনী ছাড়া আর কিছুই না। যে সুলতান তাঁর কাজিউল কুজাত (শরী’আ আইনে প্রধান বিচারপতি)র কথায় ভারতের বাইরে কোথাও নিজের শাসন সীমা বিস্তৃত করেন নি, সে মানুষ ইসলামী দণ্ডবিধি ও মৌলিক জীবনাচারের বাইরে সমকামী জীবনযাপন করবেন এটা অসম্ভব। তাঁর চারজন স্ত্রী ছিলেন।
তাছাড়া, তাঁদের মধ্যকার সমকামী সম্পর্কের ব্যাপারে যাই বলা হোক, এর কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। এসব যাবতীয় অপবাদের উদ্দেশ্য মূলত দুটো। যেন এসব ঐতিহাসিক চরিত্র থেকে মুসলমানদের শ্রদ্ধা সরে যায় আর হিন্দুদের বাড়ে আরও প্রবল ঘৃণা। অথচ আলাউদ্দিন ছিলেন সেই শাসক যিনি বাজারদর ক্রয়ক্ষমতায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন, জমি জরিপ করে সামন্ত ব্যবস্থার রোধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
আলাউদ্দিন খিলজির বিরুদ্ধে অতি-করারোপের অভিযোগ, কারণ ও বাস্তবতাঃ
আলাউদ্দিন খিলজি এমন এক সময় ভারতের শাসন ক্ষমতায় আসেন যখন মঙ্গলরা বিশাল সৈন্যদল নিয়ে ভারতের দিকে ধেয়ে আসছিল। আর ভারতের রাজপুত রাজ, হোয়সলরাজ, কাকতীয়রাজ, আর পান্ড্যবরাজ ইত্যাদি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতীয় হিন্দু রাজ শক্তিগুলো প্রবল বিক্রমে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়ে আসছিল।
ফলত একটা বিশাল সৈন্য বাহিনী গঠন করা ছাড়া অসম্ভব ছিল এইসব সমস্যার সমাধান করা। তাই তিনি প্রায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার সৈন্যের একটা বিশাল অশ্বারোহী এবং পদাতিক স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে তুলেন।
পূর্বে স্থায়ী এত বড়ো সেনাবাহিনী না থাকায় স্বভাবজাতভাবেই নবসৃষ্ট বাহিনীর জন্য রাজকোষে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন পড়ে। সে সময় মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি এবং ভূমি রাজস্ব। ফলত করের জন্য এই দুই খাতই মূল লক্ষ্য ছিল। অধুনিক রাষ্ট্রে ব্যবস্থায় যেমন ভ্যাট এবং আয়কর।
সেসময় বেশিরভাগ ভূমিই ছিল সামন্ত ব্যবস্থার অধীন। জায়গির দেওয়া। জমিদারি ব্যবস্থার মতন। এই সমস্ত জায়গীররা ছিল একইসাথে সামরিক আমলাও। তারা সাধারণ লোক দিয়ে চাষ-বাস করাতেন, বিনিময়ে খাওয়াপরার বন্দোবস্ত করে বাকি সম্পদ রেখে দিতেন নিজের কাছে।
আলাউদ্দিন খিলজি এই সিস্টেমটায় আঘাত হানেন। এর কারণ ছিল বেশকিছু। তিনি চাইছিলেন না, নববিজিত হিন্দু ভূমিতে জায়গীররা এতটা প্রভাবশালী হয়ে উঠুক যে তারা সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে। কিম্বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহও যেন শক্তিশালী না হয়।
তারিখে ফারিশতায় এই জন্যই মন্তব্য করা হয়েছিল যে, তিনি চাইছিলেন না, হিন্দুরা ঘোড়া ও তলোয়ার কেনার মত সামর্থ্য না রাখে (অর্থাৎ যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে না পারে।) এই বিষয়টিই ভারতীয় হিন্দু ঐতিহাসিকেরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হিন্দুদের দুর্বল ও দমন করে রাখার প্রয়াস ছিল বলে চালাচ্ছেন।
তিনি জায়গির প্রথা একেবারে ভেঙে দেন। বরং কৃষকদের মধ্যে ভূমি জরিপ শেষে তা বণ্টন করে দেন। তাঁর আমলেই প্রথম ভারতে পূর্ণাংগ ভূমি জরিপ করে দেন। তবে ভূমি বণ্টনের পর তিনি তাতে রাজকোষে ৫০ শতাংশ কৃষি পণ্যে কর নির্ধারণ করেন।
এর কারণ ছিল সৈন্যদের বেতন প্রদান, অস্ত্র ও অন্য সামরিক সরঞ্জামের জন্য পর্যপ্ত অর্থ সংগ্রহ করা। এর ফলে ভারতীয় কৃষকেরা আদতে ভূমির মালিকানা লাভের সুযোগ লাভ করে। অথচ তাঁর এই ৫০ শতাংশ করের ব্যাপারে অভিযোগ করা হয় তিনি কৃষকের উপর পীড়ন চালিয়েছেন।
৫০ শতাংশ কর নির্ধারণ তাঁর কালে কতটা জরুরি ছিল তা আন্দাজ করা যায় সৈন্যদের বেতন দেখে। তাঁর সময় একজন সৈন্যের বেতন ছিল বছরে ২৩৪ টাঙ্কা, আর ৭৮ টাঙ্কা বরাদ্দ ছিল অস্ত্র ও ঘোড়ার ভাতা বাবদ। অথচ মাত্র ২০ বছর পর, তুঘলকদের সময় সৈন্যদের বেতন ছিল পদবীভেদে ১০ হাজার থেকে ২ লাখ টাঙ্কা অবধি। সেসময় রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই এই কর ধার্য করা জরুরি ছিল। নতুবা মঙ্গলদের হিংস্রতার শিকার হতে হত ভারতবাসীদের।
অতিরিক্ত কর যেন বাজারমূল্য বৃদ্ধি না করে সে জন্য তিনি ‘মার্কেট কন্ট্রোল পলিসি’ গ্রহণ করেন। প্রত্যেক পণ্যের বাজারদর রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারণ করে দেন। প্রতি মণ ময়দা সাড়ে ৭ জিতাল, চাল ৫ জিতাল, চিনি সের প্রতি ১ থেকে দেড় জিতাল, গরু ৪/৫ টাঙ্কা, ঘোড়া ২০০-২৫০ টাংকা।
তিনি নিত্য প্রয়োজনীয় কৃষি পণ্য, বিলাস পণ্য, কাপড়ের পৃথক পৃথক বাজার গড়ে তুলেন। ব্যাবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্স সিস্টেম প্রবর্তন করেন। ২ লাখ রুপী দিয়ে সেই লাইসেন্স নিতে হত। ফলত ব্যবসায়ীদের আকাশছোঁয়া পুঁজির মালিক হবার সুযোগ এতে রহিত হয়। কঠোরভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা করা হত। কেউ বেশি মূল্য রাখলে নাক, কান কাটা হত।
জিজিযার প্রসঙ্গ বলা হয়, তিনি হিন্দুদের উপর অত্যাচার করেছেন। অথচ হিন্দুদের জন্য যেমন জিযিয়া আবশ্যক ছিল তেমনি মুসলমানদের থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে আদায় করা হত যাকাত। যাকাতের গড় পরিমাণ জিযিয়া থেকে ছিল বহুগুণ।
আলাউদ্দিন খিলজি ছিলেন একজন নিরক্ষর এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানুষ। অথচ তাঁর বাজার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল অনন্য এবং ভারতের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। তাঁর গুণগুলো উপমহাদেশের গৌরব হতে পারত। কিন্তু তিনি কলোনিয়াল আর হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসে চাপা পড়েছেন! সাম্প্রদায়িকতার আশ্রয় নিয়ে তার কাহিনী করা হচ্ছে বিকৃত।
এবং এতকিছুর পরও বহু অনেক মুসলমান এই চলচ্চিত্রটি উপভোগের আকাঙ্ক্ষায় দিনগুজার করছেন। পতনের এই কালে কেবল পতনের ইতিহাসই আমাদের লিখতে হচ্ছে!
লেখকঃ আরজু আহমাদ