অনেক জল্পনা কল্পনা আর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ডুব এ সকাল সকাল ডুব দিয়ে আসলাম। ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো তাও আবার এত এত আলোচিত এবং সমালোচিত ছবির। প্রসংগত, আমি ক্রিটিক না, ফিল্ম এর খুটি নাটি এত বুঝিও না, এবং আমি কারো পক্ষের লোক ও নই। তারচেয়ে বড় বিষয় জীবনে কোনদিন সিনেমার রিভিউ লিখিনি। এত কিছুর মাঝে নিরপেক্ষ ভাবে লেখার চেষ্টা করব।
কাহিনীঃ কাহিনী আমাদের অতি পরিচিত এবং সবার ই জানা। জাভেদ হাসান নাম এর নাম করা ফিল্ম মেকার, তার সংসার জীবন, সেই সংসার থেকে বের হয়ে আসা, মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করা, এবং সব শেষে চিরকালের দিকে যাত্রা করা। কি পরিচিত লাগছে না? জী, এটা উনার ই জীবন কাহিনী যদিও সম্পূর্ণ না কিছু অংশ নেয়া হয়েছে। কিংবা পরিচালকের ভাষায় কারো জীবন থেকে অনুপ্রানিত হয়ে গল্প রচিত হয়েছে। আসলে মূল বিষয় ওই একই। আমাদের আশে পাশে অনেকের জীবনে এমন গল্পের টুকরো অংশ থাকতেই পারে কিন্তু একজন অসাধারন লেখকের পুরো জীবনী যখন আমাদের সকলেরই জানা তখন আসলে স্বীকার না করলেও বুঝতে বাকি থাকেনা আমি কার গল্প পর্দায় দেখছি। আমি অবশ্য এতে কোন অসুবিধা দেখিনা। আমার পছন্দের লেখকের জীবনী নিশ্চিত হলে আরো বেশি পর্দায় দেখতে চাইতাম।
মেকিংঃ মেকিং এ পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারূকীর নিজস্ব পরিচিত ঢং রয়েছে যা আমরা সবাই দেখেছি, এখনের ফিল্ম মেকিং এর তোয়াক্কা না করে উনি তার নিজস্ব ঢং এই গল্প বলে গেছেন। বিশেষ করে কিছু শট খুব ছোট কিন্তু অর্থবহুল মনে হবে। ফিল্মের পাত্র পাত্রী বা গুরুতবপূর্ণ কিছু না দেখিয়ে, শুধু স্টিল ছবি বা সাধারন অবজেক্ট দেখিয়ে যে অনেক কিছু বলে ফেলা যায়, এটা পরিচালকের ক্যারিশ্মা। যেমন, শুধু পা এর মুভমেন্ট দেখিয়ে উনি বুঝিয়েছেন একজন কে অনেকজন ছেছড়ায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে। হল্ভর্তি দর্শক তখন হেসেছে। অনেক এনিম্যশন না দেখিয়ে সমুদ্রপাড়ে সূর্য অস্ত যাওয়া, আর সাথে একাকী নৌকা দাঁড়িয়ে থাকা দিয়ে উনি লেখকের জীবনের শেষ পরিণতি বুঝিয়েছেন। এরকম হাজারো সিন আছে, যা আপনাকে ভাবাবে।
অভিনয়ঃ ইরফান খান যে মাপের অভিনেতা উনাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছে কিছু ক্ষেত্রে নুসরাত ইমরোজ তিশা ইরফান খান কে ছাড়িয়ে গেছেন। অনেকদিন পর নতুন করে এজন্য নুসরাত ইমরোজ তিশা কে ভাল লাগলো। রোকেয়া প্রাচী আরেকজন, যিনি অসাধারন অভিনয় করেছেন। আর ইরফান খান?! থাক নাই বলি, হল এ যেয়ে নাহয় দেখে নিবেন!তবে আমরা যাকে মনে মনে কল্পনা করে রেখেছি, সেই লেখকের ক্যারেক্টার ইরফান খান ছাড়া আর কাউকেই মানাত না। পরিচালকের ছোট ভাই, হিসেবে নাদের চউধুরীকে ভালো লাগে নাই। বাকি থাকলো পার্ণো মিত্র। উনার ক্যারেক্তারের জন্য পারফেক্ট ছিলেন। কিন্তু অসাধারন এই সুন্দরীকে আরো ভালো ভাবে ইউটিলাইজ করা যেতে পারতো।
সিনেমাটোগ্রাফিঃ এই ব্যাপারটা ঠিক বুঝিনা! শুধু এটুকু বুঝি যখন আমি স্ক্রীন থেকে চোখ সরাতে পারিনা। এই যদি হয় সংজ্ঞা, আমি তাহলে সিনেমাটোগ্রাফি দেখে মুগ্ধ!! বান্দরবন এ কিছুদিন আগে ঘুরে আসার কারনেই এর রেশ আর নেশা দুইটাই আমার কাটে নাই। পর্দায় বান্দরবনের অসাধারন সব সিন গুলা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না। নয়নতারা ফিল্ম সিটির প্রত্যেক টা শট, এংগেল, যতভাবে ইরফান খান কে দেখানো যায়, ব্রিষ্টির সিন যখন পার্ণো মিত্র গারির ভেতর অপেক্ষা করছিল, আমি শুধু মুগ্ধের মত গিলছিলাম। ফারুকী সাহেব, ব্রিষ্টির মধ্যে প্রেম টা কি আরেকটু দেখানো যাইতো না?
মিউজিক এবং ব্যাঙ্কগ্রাউন্ড মিউজিকঃ অনেস্টলি বলি, যখন প্রথম শুনি আহারে জীবন গান টা আমার ভালো লাগে নাই! কিন্তু মুভি তে কাহিনী দেখার পর স্যুট করে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ভালো বাট গ্রেট ডিসাপয়েন্ট মেন্ট, বেশিরভাগ সিন গুলা ব্যাক গ্রাউন্ড মিউজিকের অভাবে তার আবেদন হারাচ্ছিল, ঝুলে যাচ্ছিল, কাহিনী কানেক্ট করতে সমস্যা হচ্ছিল।
ডায়ালগঃ এটা নতুন ফারুকীর ছবিতে। এই ছবিতে কিছু অসাধারন ডায়ালগ আছে আপনি মনে রাখবেন ই রাখবেন। একটা এমন“মানুষ মারা যায় তখন ই যখন প্রিয়জনের সাথে তার যোগাযোগহীনতা তৈরি হয়” । এরকম বেশ কিছু আছে। তবে সবচেয়ে পাওয়া আমার মনে হয়, ফারুকীর চলিত ভাষায় স্ক্রীপ্ট ছাড়া ডায়ালগ এর যে সমালোচনা হত, এই ছবি দিয়ে সেটা ঘুচবে। ডায়ালগ বেশ কম, যা আছে তা চমৎকার। আপনাকে ভাবাবে।
ডুব কেন দেখবেন? শুরুতেই বলি, এটা একটা ধীরগতির সিনেমা আপ্নারা অনেকেই হয়ত আগেই বুঝেছেন। কমার্শিয়াল বাংলা ফিল্ম এটা না। তাই সেই মানসীকতা নিয়ে হলে যাওয়াই শ্রেয়। জীবনের গভীর বোধ স্পর্শ করতে চাইলে, অন্যভাবে ভাবতে চাইলে ডুব দেখে আসতে পারেন। I think this is the right time to release DOOB. Dhaka Attack এর মত মারদাংগা ছবির পর ডুব এর মত ভাবনার ছবি একটু তো ডিমান্ড করেই। ছবি দেখে বিষণ্ণ হয়ে হল থেকে বের হতে হবে, বলে দিলাম কিন্তু!
পরিশেষঃ বাংলা ছবির জয়জইয়কার চাই বলে হয়ত অনেক ছোট খাট ত্রুটি এড়িয়ে গেলেও একটা বিষয় কোনভাবেই এড়ানো গেলো না। গল্প গুলো খুব দ্রুত জাম্প করছিল, কানেকশন খুব স্ট্রং মনে হয়নি কিছু যায়গায়। যেখানে আমি গল্প জানি, আমার কাছেই জাম্প গুলো খাপ ছাড়া লাগছিল, বিদেশের মাটিতে রিলিজ দিলে অবাংগালী অথবা যারা গল্প জানেনা তারা কিভাবে বুঝবে এটা ভেবে দেখার বিষয় আছে। তবে দেখে মনে হচ্ছিল, ডুব কে বেশ কয়েকবার সম্পাদনার টেবিলে যেতে হয়েছে, তাতে খাপ ছাড়া লাগতেই পারে। আবার এটাও নতুন করে বোঝা গেলো, এক হুমায়ুন আহমেদের ব্যাপ্তি এত বড়, যে তার জীবনের গল্প বলা এত সহজ না!
overall rating: 6/10
সব মিলায়ে ডুব উপভোগ্য, কাল ই কাছের সিনেমা হল থেকে ঘুরে আসুন! আমি যত সম্ভব নাম উলেখ না করে রিভিঊ লেখার চেষ্টা করেছি। তাই, একটাই অনুরোধ, শুধু সিনেমার গঠনমূলক সম্লোচনা করুন, কোন ব্যক্তি বিশেষ কে টেনে আনবেন না। Please do share your review here. Happy watching!
লেখকঃ Sadia Afrin