মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগেই কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গার হাতে রোহিঙ্গা খুন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের বিক্ষোভসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ তৎপরতার সৃষ্টি হয়েছে। ক্যাম্পে নিয়োজিত কিছু এনজিও’র বিরুদ্ধেও অস্থিতিশীলতায় উসকানি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব তৎপরতা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা বলে মনে করছেন অনেকেই।
গত বছরের ২৪ আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব নির্যাতন শুরুর পর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে অন্তত ৬ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু। তারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এর আগে ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকেও রাখাইনে একই ধরনের নিপীড়ন শুরুর পর অন্তত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। আর আগে গত দুই দশকে মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে বাংলাদেশে অবস্থান করছে আরও প্রায় সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা। নতুন পুরনো মিলিয়ে কক্সবাজারে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লাখের ওপরে। এত বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে মানবিক দৃষ্টিতে আশ্রয় দেয় বাংলাদেশ সরকার। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, লেখাপড়া, বিনোদনসহ বিভিন্ন ধরনের সহায়তা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে গত বছরের ২৩ নভেম্বর মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত একটি অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। পরে ১৯ ডিসেম্বর দুই দেশের ১৫ জন সদস্য করে মোট ৩০ সদস্যের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। সর্বশেষ গত ১৫ জানুয়ারি মিয়ানমারের নেপিদো শহরে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে সম্পাদিত চুক্তিতে ২৩ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা উল্লেখ করা হয়। তবে এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পরই উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ক্যাম্পগুলোতে প্রত্যাবাসনবিরোধী বিক্ষোভসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড দেখা গেছে। মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, ক্ষতিপূরণসহ ৫টি দাবিতে তারা বিক্ষোভ করার চেষ্টা করছে। গত ১০ দিনে রোহিঙ্গাদের নিজেদের মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে তিনটি।
তবে রোহিঙ্গারা যাতে বিক্ষোভ করতে না পারে সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে প্রশাসন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন রাত অভিযান চালাচ্ছে। গত কয়েকদিনে সন্ত্রাসী সন্দেহে সাত রোহিঙ্গাকে আটক, বিদেশি পিস্তল, কিরিচ, দা’সহ বিভিন্ন অস্ত্র উদ্ধার করেছে।
এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাধা সৃষ্টি করার জন্য রোহিঙ্গাদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগ করেছে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি, কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আন্দোলনসহ নানা সংগঠন। এসব সংগঠনের নেতারা বলছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত না যেতে কিছু এনজিও উসকানি দিচ্ছে। একইভাবে এসব এনজিও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। গত মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) উখিয়ায় এক সমাবেশে এসব সংগঠনের পক্ষে দাবি করা হয়, দেশি-বিদেশি এনজিও নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রোধে বিভিন্ন দাবি দাওয়া দিয়ে রোহিঙ্গাদের উসকে দিচ্ছে। এই সমাবেশে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করতে উসকানিদাতা এনজিওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ বেশ কিছু দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ে আগামী ৩০ জানুয়ারি উখিয়ায় অবস্থান ধর্মঘট ডেকেছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি।
এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলে কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের শুরু থেকে কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের উসকে দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে মিয়ানমারের ফেরত না যায় সে ব্যাপারে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কারণ রোহিঙ্গারা চলে গেলে এসব এনজিও লুটপাট করে খেতে পারবে না।’ তবে কোনও এনজিও সংস্থা এমনটি করছে জানতে চাইলে অভিযুক্ত এনজিওগুলোর সুনির্দিষ্ট নাম বলতে পারেননি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আন্দোলনের সভাপতি মাহমুদুল হক চৌধুরী বলেন, ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে সামনে রেখে কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের উসকানি দিচ্ছে। এসব এনজিও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে। নিজেদের স্বার্থে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রোধে বিভিন্ন দাবি দাওয়া দিয়ে রোহিঙ্গাদের উসকে দিচ্ছে। তাই উসকানিদাতা এনজিওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামী ৩০ জানুয়ারি উখিয়ায় অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়েছে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত কিছু কিছু রোহিঙ্গা উচ্ছৃঙ্খলার চেষ্টা করছে। গত ১০দিন রোহিঙ্গাদের হাতে তিন রোহিঙ্গা খুন হয়েছে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এবং ক্যাম্পে আধিপত্যসহ নানা কারণে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে। এছাড়াও বিভিন্ন সময় প্রত্যাবাসন বিরোধী বিক্ষোভ করার চেষ্টা করছে। গত জানুয়ারি মাসে সাত জন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে।’
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরকারি নির্দেশনা অমান্য ও বিভিন্ন অনৈতিক কার্যক্রমের কারণে ইতোমধ্যে ১২টি এনজিও’র কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এসব এনজিও হচ্ছে সাফজ, কালব, ওফকা, জাগরণ, এমপিডিআর, মানবাধিকার, শেড ওয়াশ, টাই বিডি, এসআরপিবি, গ্রামীণ ব্যাংক, লাচুন ও শিলাফ। এর আগে মুসলিম এইড বাংলাদেশ, ইসলামিক রিলিফ ও ইসলামিক এইড নামের এই তিনটি এনজিও নিষিদ্ধ করা হয়। সব মিলিয়ে আমরা কঠোর নজরদারি রেখেছি। এরপরও কিছু কিছু এনজিও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের উসকে দেওয়ার কথা শুনেছি। আমরা এসব এনজিও’র বিরুদ্ধে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’
র্যাব-৭ কক্সবাজার কার্যালয়ের কোম্পানি কমান্ডার মেজর মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আমাদের কঠোর নজরদারি রয়েছে। গত বুধবার ভোররাতেও রোহিঙ্গা নেতা ইউসুফ হত্যায় জড়িত সন্দেহে অস্ত্রসহ দুইজনকে আটক করা হয়েছে। এর আগেও অস্ত্রসহ তিন জনকে আটক করে র্যাব সদস্যরা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে র্যাব অভিযান অব্যাহত রেখেছে।’
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার ড. একেএম ইকবাল হোসেন বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য কাজ করছে। রাত-দিন বিভিন্ন ক্যাম্পে টহল দিচ্ছে পুলিশ। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।’