বগুড়ায় শাসনের নামে চলছে দুর্নীতি!

0

বগুড়ার পৌর ভবনে গিয়ে বর্তমান মেয়র এ কে এম মাহবুবর রহমানকে খুঁজতে গিয়ে পাওয়া গেল না। কর্মচারীদের সাথে কথা বলে জানা গেল, তিনি আদালতে তাঁর চেম্বারে আছেন। তাঁকে পাওয়া গেল বার কাউন্সিলের গহর আলী ভবনের ২২৫ নম্বর কক্ষে, জনাপাঁচেক মক্কেল নিয়ে বসে আছেন।

বগুড়ার মেয়র
বগুড়ার মেয়র এ কে এম মাহবুবর রহমান

বগুড়ার মতো ব্যস্ত পৌরসভার মেয়র কী করে ওকালতি করার সময় পান? প্রশ্ন করতেই হেসে উঠলেন মেয়র। বলেন “বগুড়াবাসীকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন এখানে কী হচ্ছে। তবে তিনি প্রতিদিন সকালের দিকে মেয়র কার্যালয়ে যান এবং কিছু সময় থাকেন বলে জানান”।

পৌরসভার একাধিক কাউন্সিলর প্রথম আলোকে বললেন, এখানে পৌরসভা বলে কিছু আছে কি না, মানুষ জানে না। শহরের বাসিন্দারা আদৌ কোন পৌরসেবা পান না। পুরো ব্যবস্থাকে একপ্রকার অকার্যকর করা হয়েছে। মেয়রকে কিছুই করতে দেওয়া হয় না। সব করেন ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন কাউন্সিলর। আর তাঁদের সকল ক্ষমতার উৎস ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দিন শেখ। তাঁকে পেছন থেকে সহায়তা করেন সদ্য বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা ও র‍্যাবের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী মতিন সরকার। ছাত্রী ধর্ষণ মামলার মূল আসামি তুফানের ভাই তিনি। তবে শামসুদ্দিন শেখ এর সাথে কথা বললে তিনি জানান মেয়রকে কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি আরো বলেন, ‘আমি আমার কাজ করছি। মেয়র তাঁর কাজ করছেন। আমাকে নিয়ে যা শুনেছেন, তা ঠিক না।’

বগুড়া পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর। মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মাহবুবর রহমান। ২৭ জন কাউন্সিলরের মধ্যে সংরক্ষিত ওয়ার্ডসহ বিএনপি-জামায়াতপন্থী কাউন্সিলর আছেন ১৬ জন। আর আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরের সংখ্যা ১২।

বিএনপিপন্থী একজন কাউন্সিলর বললেন, ‘নির্বাচিত হওয়ার পর হঠাৎ করে পুলিশ কর্মকর্তারা ফোন করে আমাদের পৌরসভায় যেতে নিষেধ করেন। সদর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল বাশার নিজে ফোন করে সবাইকে হুমকি দেন। এরপর ২০১৬ সালের ১০ মার্চ পৌরসভার ফটক বন্ধ করে দিয়ে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কাউন্সিলররা বৈঠক করেন। বৈঠকে তাঁরা ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও শ্রমিক লীগ নেতা শামসুদ্দিন শেখকে প্যানেল মেয়র-১ ও যুবলীগ নেতা আমিনুল ইসলামকে প্যানেল মেয়র-২ নির্বাচন করেন।’

পৌরসভার একজন কর্মচারীর সাথে কথা বললে জানা যায় প্যানেল মেয়র নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন শহর যুবলীগের নেতা মতিন সরকার। নির্বাচিত না হয়েও মতিন কেন ফলাফল ঘোষণা করলেন, এ নিয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুর রহিম প্রশ্ন তুললে তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন কাউন্সিলর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। পৌরসভার সবকিছু তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। প্রথমেই পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষ দখল করেন প্যানেল মেয়র শামসুদ্দিন শেখ।

একজন কর্মচারী জানান, তুফানের স্ত্রীর বড় বোন কাউন্সিলর মার্জিয়া আক্তার কিছুদিন আগে পৌরসভার লাইসেন্স পরিদর্শককে হুমকি ও ভয়ভীতি দেখান। জানতে চাইলে লাইসেন্স পরিদর্শক শামসুল হক বলেন, ‘আমরা সাধারণ কর্মচারী এসব নিয়ে কিছু বলতে চাই না।’ একইভাবে আরও দুজন কর্মচারীকে ভয় দেখানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পৌরসভার যান্ত্রিক প্রধান রবিউল ইসলাম বলেন, প্রথমদিকে কিছু ঝামেলা হয়েছিল। এখন সব ঠিক হয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মচারী জানান, এখন প্যানেল মেয়রই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সঙ্গে আছেন মতিন ও তাঁর সহযোগীরা। নির্মাণকাজ, ঠিকাদারি, সড়ক মেরামত, হাটবাজার ইজারা, রিকশার লাইসেন্স—সবকিছুর দায়িত্বে তাঁরা।

শহরে ১৫ হাজারে বেশি ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশা রয়েছে। হেলাল-মতিনের প্রভাব খাটিয়ে ধর্ষক তুফান নিজেই এসবের লাইসেন্স দেন। অবৈধ অটোরিকশার পেছনে তুফানের নাম ও ফোন নম্বর দেওয়া আছে। প্রতিটি অটোরিকশা প্রথমে রাস্তায় নামানোর জন্য দুই হাজার টাকা করে দিতে হয়। আর প্রতিদিন দিতে হতো ২০ টাকা করে। এসব টাকা চলে যেত তুফানের পকেটে।

মেয়র নিজেই বললেন, শহরের ভেতরে হাড্ডিপট্টির আন্তথানা বাস টার্মিনাল ও আন্তজেলা কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল দেড় বছর ইজারা দিতেই পারেননি। পরে কম টাকায় কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ইজারা দিতে হয়। আর হাড্ডিপট্টির আন্তথানা বাস টার্মিনাল পাঁচ বছর কেউ ইজারা নিতে পারেননি। এবার একজন মাত্র দরপত্র জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা এত কম ছিল যে ইজারা আর দেওয়া সম্ভব হয়নি।

সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটে শহরের রাজাবাজার, ফতেহ আলী বাজার ও চাষী বাজারে ইজারা নিয়ে। এত দিন মতিন ও তাঁর লোকজন এই তিন হাট কবজায় রাখেন। এবারও কোনো দরপত্র ছাড়াই এই তিনটি বাজার ইজারা নিতে মেয়রকে চাপ দেন তাঁরা। মেয়র তা দিতে না চাইলে গত ৩ এপ্রিল মতিন, শহর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আবদুল মান্নান, মতিনের ডান হাত হিসেবে পরিচিত কানাই লালসহ ১৪-১৫ জন মেয়রের বাসায় যান। তাঁরা মেয়রকে বলেন, দরপত্র ছাড়াই তাঁদের হাট দিতে হবে। নইলে পৌরসভায় গেলে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। মেয়র এ ঘটনার বর্ণনা দিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। পরে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দুই পক্ষকে বসিয়ে সমঝোতা করে দেন। মেয়র এসব ঘটনা জানিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে প্রতিকার চান।

জিডির তদন্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে সদর থানার ওসি এমদাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা নিজেরা সবকিছু মীমাংসা করেছেন। একপর্যায়ে জিডিও প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এ কারণে তদন্ত হয়নি।

বগুড়া শহরের একাধিক বাসিন্দা বলেন, নির্বাচিত মেয়র কাজ করতে না পারায় পৌরসভার কোনো উন্নয়ন হয়নি। জানতে চাইলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি তৌফিক হাসান বলেন, বগুড়া শহরে নাগরিক সেবার যে চিত্র তাতে বোঝা যায় না যে এখানে কোনো পৌরসভা আছে। ২১টি ওয়ার্ডের বিশাল পৌরসভা। অথচ এখানে কোনো নাগরিক সেবা নেই।

একই ধরনের মন্তব্য করেছেন সচেতন নাগরিক কমিটির জেলা শাখার সভাপতি মাসুদার রহমান। তিনি বলেন, বৃষ্টি হলে রাস্তাঘাটে হাঁটুপানি জমে, শহরজুড়ে রাস্তার ওপর যত্রতত্র অটোরিকশাস্ট্যান্ড। দিনভর যানজট। বেহাল রাস্তাঘাট, মশা-মাছিতে ভরা। শুধু কর দিতে গিয়েই মনে হয়, এখানে পৌরসভা বলে কিছু একটা আছে।

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে