বাংলদেশের ডাক্তাররা সরকারী হাসপাতালের বহিঃবিভাগে গড়ে ৪৮ সেকেন্ডে রোগী দেখেন!

0
বহির্বিভাগ

বাংলদেশের ডাক্তাররা সরকারী হাসপাতালের বহিঃবিভাগে গড়ে ৪৮ সেকেন্ডে রোগী দেখেন!

প্রথম আলোতে প্রকাশিত এই খবর নিয়ে সকলে এখন ছুটছেন ডাক্তারদের দোষ দিতে।

আসলে এই খবরের বাস্তবতা কতটুকু?

প্রথম কথা হল, খবরটি শতভাগ সঠিক। এটি একটি গবেষণা পত্র থেকে যা বিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল জুলাই মাসে গ্রহণ করে প্রকাশিত অনলাইন সংস্করণে প্রকাশ করে।

এটি আসলে ১৯৯৪ সালের ডাটা নিয়ে তৈরি রিসার্চ রিপোর্ট।

এবার আসি দেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে।

২০১৫ সালে মোট ১৭৮৬৯৭৯৫৮ বা ১৭৮.৭ মিলিয়ন জন রুগী বহিঃবিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে (DGHS ২০১৬)।
২০১৫ সালের ডাটা অনুযায়ী এ দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬১.২ মিলিয়ন (বিশ্বব্যাংক ২০১৫)।
এর মানে হল দেশের মোট যে জনসংখ্যা তার চেয়ে ১৭ মিলিয়ন বেশি মানুষ বহিঃ বিভাগে গিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিয়েছে। অর্থাৎ কিছু মানুষ একই বছরে বেশ কয়েকবার গিয়েছে।

এর অর্থ হল সরকারী হাসপাতালগুলোতে রুগীর চাপ কেমন থাকে সেটা সহজেই অনুমেয়।
দেশে রেজিস্টার্ড ডাক্তার ৭৮৫৭২ (বিএমডিসি ২০১৬)। এর মধ্যে ১০ হাজার ডাক্তার দেশের বাহিরে চলে গেছে। অর্থাৎ বর্তমানে দেশে রেজিস্টার্ড ডাক্তার ৭৮৫৭২ জন।

এ দেশে প্রতি ২০৩৯ জন মানুষের জন্য একজন ডাক্তার রয়েছে (DGHS ২০১৬)।
সরকারী সার্ভিসে আছে ২২৩৭৪ জন, অর্থাৎ প্রতি ১০০০০ হাজার লোকের জন্য সরকারী ডাক্তার ১.৪৩ জন।
এর মধ্যে রুগী বহিঃ বিভাগে রুগী দেখে ধরলাম ১০০০০ জন।

সরকারী সার্ভিস আটটা থেকে দুটো পর্যন্ত মোট ছয় ঘণ্টা হলে, অ্যাঁর শুক্রবার ও অন্য ছুটির দিন মিলে বছরে ৩০০ দিন ছয় ঘণ্টা করে হলে একেকজন ডাক্তারের মোট সার্ভিস হয় বছরে ১৮০০ ঘণ্টা।

আর ১০০০০ জন ডাক্তারের মোট সার্ভিস হয় ১৮০০০০০০০ বা ১৮০ মিলিয়ন ঘণ্টা বা ১০৮০ মিলিয়ন মিনিট।
এখানে মোট রুগীর সংখ্যা ১৭৮.৭ মিলিয়ন জন হলে, সব ডাক্তার যদি তাদের কর্ম ঘণ্টার সবটুকু সেকেন্ড দেয়, অর্থাৎ মেশিনের মত এক নাগাড়ে কাজ করে, তবে তারা সর্বোচ্য একজন রুগীকে সময় দিতে পারবে ৬.0৪ মিনিট বা ৩৬০ সেকেন্ড।

বাস্তবে এটা সম্ভব নয়, তবে থিওরিটিক্যালি এটা সম্ভব হলে প্র্যাক্টিক্যালি এটা সম্ভব নয়।

এবার আসি ৪৮ সেকেন্ডের ব্যাখ্যা। জার্নালে এসেছে ৪৮ সেকেন্ড, তবে সেটা ডাক্তাররা দেয় না, দেউ মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট। প্রথম আলোর শিশির মোড়ল সেটা এড়িয়ে গেছে অপসাংবাদিকতা করতে গিয়ে।

ডাক্তাররা দেয় গড়ে ৫৪ মিনিট, যেটা হল ১৯৯৪ সালের ডাটা থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট।
১৯৯২ সালে দেশে প্রতি ৫২৪২ জন লোকের জন্য একজন ডাক্তার ছিল। অর্থাৎ এখনকার চেয়ে প্রায় দেড়গুণ লোকের জন্য একজন ডাক্তার ছিল।

তাহলে ১৯৯৪ সালে যদি একজন ডাক্তার ৫৪ সেকেন্ড সময় দেয়, সেই হিসেবে এখন সেটা দেড়গুণ বেশি হওয়ার কথা। অর্থাৎ রুগী প্রতি ৮১ সেকেন্ড সময় দেওয়ার কথা।

২৫ বছরে ডাক্তারদের স্কিল বৃদ্ধি ও সার্ভিস প্রদানকে বীজগাণিতিক হারে বাড়িয়ে এডজাস্ট করলে এটা হয় ১৫০ মিনিট।
আবার সর্বোচ্চ্য সার্ভিস দিলে একজন ডাক্তার পারবে ৩৬০ সেকেন্ড সময় দিত একজন রুগীকে।

তাহলে বাকি ২১০ সেকেন্ড যাচ্ছে কোথায়?

একজন রুগী যখন বহিঃ বিভাগে চিকিৎসা দিতে যায়, তাহলে ডাক্তারকে শুধু চিকিৎসা দেওয়াই নয়, আরো কিছু কাজ সরকারী নিয়মে করতে হয়।

চিকিৎসা দেওয়ার খাতায় রুগীর, নাম, বয়স, লিঙ্গ ও সম্ভাব্য রোগের নাম এন্ট্রি করতে হয়। এরপর রুগীর কমপ্লেইনগুলো নোট করতে হয়। এরপর ওষুধ লিখতে হয়। ওষুধের নাম এক জায়গায় না, দু জায়গায় লিখতে হয়। একটা প্রেসক্রিপশনে, আরেকটা শর্ট স্লিপে। এসবে চলে যায় ২১০ সেকেন্ড।

বাকি ১৫০ সেকেন্ড চলে যায় রুগীকে পরীক্ষা করা ও চিকিৎসা প্ল্যান ঠিক করতে। অর্থাৎ একজন ডাক্তার চাইলেও এর চেয়ে বেশি সময় রুগীকে দিতে পারবে না।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, উন্নত দেশে ডাক্তাররা রুগীদের এতো সময় দেয় কি করে?

উন্নত দেশে বহিঃবিভাগে সেবা নিতে হলে এপয়েন্টমেন্ট করে নিতে হয় আগে। একদিনে নির্দিষ্ট পরিমাণ রুগীর বেশি দেখে না। ফলে সিরিয়াল দিলে দুই মাস, তিন মাস পর আপনার সিরিয়াল পড়বে। তখন গিয়ে ডাক্তার আপনাকে দেখবে।

এইজন্য তারা একজন রুগীকে বেশি সময় দিতে পারে। জরুরী মরপ্নাপন্ন কেস হলে অবশ্য সেটা ভিন্ন ব্যাপার, তখন সাথে সাথে দেখবে।
কিন্তু আমাদের দেশে এই সিস্টেম নেই। যার যখন ইচ্ছে বহিঃবিভাগে গিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। একজন ডাক্তার প্রতিদিন একশর বেশি লোক দেখছে বহিঃ বিভাগে। ফলে, চাইলেও রুগীদের বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

আমি ব্রিটিশ জার্নালের ঐ গবেষণা প্রবন্ধটি পড়েছি। তারা ডাক্তারদের সময় দেওয়াকে যতটা না হাইলাইট করেছে, তার চেয়ে তারা বের করেছে যে যেসব দেশে স্বাস্থ্যখাতে সরকার বাজেট কম, সেসব দেশের লোকেরা চিকিৎসার জন্য সময় কম পায়। এরপর সরকারের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে সমস্যা সমাধানে।

অথচ প্রথম আলো ডাক্তারদের টার্গেট করে ভিন্নভাবে সংবাদ পরিবেশন করেছে, যাতে ডাক্তারদের প্রতি আরো নেগেটিভ ধারণা তৈরি হয় জনগনের।

দেশের এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি করতে হলে দুটো দিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
১. বেশি করে সরকারী ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া।
২. স্বাস্থ্যখাতে বাজেট আরো বেশি করে বাড়ানো।
– Dr. Taraki Hasan Mehedi

আপনার মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে