ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার প্রতিষ্ঠা ও কাতালুনিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের হাতিয়ার হয়ে ওঠার ইতিহাস

0

বার্সেলোনা স্পেনের একটি শহর হলেও বার্সেলোনা নাম শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে উঠে একটি ফুটবল ক্লাব এর ছবি। ভেসে ওঠেন রোনালদিনহো, মেসি, নেইমার, ইনিয়েস্তা, জাভির, সুয়ারেজদের শৈল্পিক ফুটবলের দৃশ্য। বার্সেলোনা বা বার্সা কিংবা ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা বা FCB (Futbol Club Barcelona) ইউরোপের স্পেনের কাতালুনিয়া রাজ্যের রাজধানী বার্সেলোনা শহরের একটি ক্লাব যারা বর্তমান এবং নিকট অতীতে রাজত্ব করেছে ইউরোপিয়ান ফুটবলে। [*স্প্যানিশ ভাষায় Football কে Futbol লেখা হয়।]

কিন্তু বার্সেলোনা শুধু কাতালুনিয়ার একটি ক্লাব হয়েই থাকেনি,  ‘Mes Que Un Club’ বা ‘More Than A Club’ নীতিবাক্যে ক্লাব বার্সেলোনা প্রতিনিধিত্ব করে কাতালুনিয়ানদের আবেগ, স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, রাজনীতির। কাতালানরা দীর্ঘদিন ধরে স্পেন থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছে। একটা সময় স্পেনের রাজতন্ত্রের বিরোদ্ধে কাতালুনিয়ার জনগনের প্রতিবাধের হাতিয়ারে পরিণত হল এই ক্লাবটি। কাতালানদের পরিচিতি হয়ে দাঁড়ায় ক্লাবটি। যতবারই সুযোগ এসেছে, ততবারই ক্লাবের মাধ্যমে নিজেদের আন্দোলনের স্বরূপ দেখিয়েছে কাতালানরা। তবে ক্লাবের চেয়ে বড় পরিচয় বহন করা ক্লাবটির জন্ম হয়েছিল ঠিক অন্য আর আট-দশটা ক্লাবের মতই। কোন এক বিদেশীর হাত ধরে।

বার্সেলোনার মাঠে বারবার উচ্চারিত হয়েছে কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার দাবী।
বার্সেলোনার মাঠে বারবার উচ্চারিত হয়েছে কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার দাবী।

ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার জন্ম ইতিহাসঃ

জোয়ান গ্যাম্পার; হান্স (Hans- জার্মান/ডাচ/সুইসদের বিশেষ উপাধি) গ্যাম্পারের জন্ম সুইজারল্যান্ডে। দুরন্ত গ্যাম্পারের শখ ছিলো বাইক রাইড করা। শুধু বাইক রাইড করেই কাটেনি তার জীবন। তিনি একাধারে দৌড়, রাগবি, টেনিস, গলফ সবই খেলতেন। এমনকি এফসি বাসেল এর বয়সভিত্তিক ফুটবল দলের অধিনায়কও ছিলেন। কাজের জন্য পাড়ি জমিয়েছিলেন ফ্রান্সের লিওঁ শহরে। ১৮৯৮ সালে কাতালুনিয়ার বার্সেলোনা শহরে বেড়াতে এসেছিলেন। বার্সেলোনা শহরটা দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। সম্পাদকের চাকরি নিলেন স্পোর্টসভিত্তিক ম্যাগাজিন ‘Los Deportes’ এ।

দিনটা ছিলো ১৮৯৯ সালের ২২শে অক্টোবর। নিজের ম্যাগাজিনে একটি বিজ্ঞাপন দিলেন গ্যাম্পার। বার্সেলোনা শহরে একটি ফুটবল ক্লাব দিতে চান তিনি। সাথে সাথেই হইহুল্লোড় লেগে গেল কাতালান শহরে, সাড়াও মিললো বেশ। এরঠিক একমাস পরেই, নভেম্বরের ২৯ তারিখে সুইজারল্যান্ড, বৃটিশ, স্পেন এবং কাতালানের কিছু কৌতূহলী ব্যাক্তি একত্রিত হয় এবং জন্ম হয় বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব ‘Football Club Barcelona’ তথা ‘FC Barcelona’ যা বার্সা (Barca) নামেও পরিচিত। ১৯০৯ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট গ্যাম্পার ৬০০০ সমর্থক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন LES CORTS STADIUM উদ্ভোধন করেন।

বার্সেলোনার প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরা

রাজতন্ত্র, গৃহযুদ্ধ এবং ক্লাব বার্সেলোনাঃ

১৯২৫ সালের ১৪ই জুন কাতালুনিয়ান সমর্থকরা ফুটবল মাঠে স্পেনের রাজতন্ত্রের বিপক্ষে স্বেচ্ছা বিদ্রোহ করে। তারা রাজকীয় কুচকাওয়াজকে দারুণ বিদ্রূপ করে। বিষয়টায় আঁতে ঘা লাগে স্পেন রাজপরিবারের। ফলশ্রুতিতে কাতালুনিয়ান ক্লাবটির মাঠ বন্ধ করে দেয়া হয় ছয়মাসের জন্য। এমনকি প্রেসিডেন্ট জোয়ান গ্যাম্পারকেও কাতালানিজম এর প্রচারের অভিযোগে বাধ্যকরা হয় অব্যাহতি নেয়ার জন্য। পরের বছর ১৯২৬ সালে ক্লাবটি প্রফেশনাল ফুটবল ক্লাব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২৭ সালের ৩ জুন ক্লাবটি স্পেন জাতীয় দলের বিপক্ষে নিজেদের দ্বিতীয় পরীক্ষাধীন ম্যাচ খেলে এবং জয় পায়। ১৯২৮ সালে বার্সেলোনা স্প্যানিশ কাপ জয়ের পর তা ‘Generation of 27’ এর সদস্য রাফায়েল আলবার্তির ‘Oda a Platko’ কবিতায় উৎযাপন করে যা লেখা হয়েছিলো বার্সার তৎকালীন গোলকিপার ফ্রাঞ্জ প্লাটকোর নায়কোচিত পারফর্মেন্স থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ১৯২৯ সালে বার্সেলোনা প্রথম লা লিগা শিরোপা জিতে। তার ঠিক এক বছর পর ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা জোয়ান গ্যাম্পার ব্যক্তিগত সমস্যার কারনে আত্মহত্যা করে।

এইসময় বার্সেলোনা আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। কেননা ক্লাবের অনেক সদস্যই ক্লাব ছেড়ে চলে যায় এবং রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। তবুও ১৯৩০-১৯৩৬ সালের মধ্যে কাতালান কাপে জয়ী হয়। ১৯৩৬ সালের স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় ক্লাবের প্রেসিডেন্ট Josep Sunyol স্পেনের একনায়ক ফ্রাঙ্কোর সৈন্যদের হাতে নিহত হয়। ক্লাবটির চুড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে ১৯৩৮ সালে ক্লাব ভবনে বোমা নিক্ষেপ করলে। এতে ক্লাব ভবনটি ধ্বসে যায়। গৃহযুদ্ধের ১৯৪০ সালে ফ্রাঙ্কো নিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট হয় বার্সেলোনার। শুরুতেই নন-স্প্যানিশ শব্দ ‘Football’ সরিয়ে তার স্থানে যুক্ত করে স্প্যানিশ প্রতিশব্দ ‘Futbol’. এরপর থেকেই ক্লাবটির নাম হয় ‘Club de Futbol Barcelona.’ এই সময় পরিবর্তন করা হয় ক্লাবের পতাকারও। চার স্ট্রেপের বদলে দেয়া হয় দুটি স্ট্রিপ। বলাবাহুল্য কাতালুনিয়া অঙ্গরাজ্যের পতাকায় চারটি স্ট্রেপ ব্যাবহৃত হয়। এসময় ক্লাবের সদস্য সংখ্যা দশ হাজার থেকে কমে সাড়ে তিন হাজারে নেমে আসে।

পুনরুত্থানঃ

১৯৪০ সালের পর বার্সেলোনা নিয়মিত সাফল্য পেতে থাকে। ১৯৪৯ সালে ক্লাবের পঞ্চাশ বছর ফুর্তিতে ক্লাবের ট্রফি কেইসে শোভা পায় ৯ টি কাতালুনিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফি, ৪টি স্প্যানিশ লা লিগা শিরোপা। ১৯৫১/৫২ সিজনে বার্সা জয় করে মোট ৫ টি শিরোপা। লা লিগা, কোপা দেল’রে, লাতিন কাপ, ইভা দৌয়ার্তে ট্রফি এবং মার্টিনি ট্রফি। সেই সময় বার্সাকে অভিহিত করা হত “Barça of the Five Trophies” নামে। ক্লাবের এমন ধারাবিক সাফল্যে ক্লাবের সদস্য সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এইসময় বার্সার মোট সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ত্রিশ হাজার।

ক্যাম্প ন্যু (Camp Nou):

ক্লাবের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় স্টেডিয়ামে জায়গা সংকুলান হচ্ছিলো না। তখন বার্সেলোনা উদ্যোগ নেয় নতুন একটি মাঠ নির্মানের। এরপর ১৯৫৭ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর উদ্ভোধন করাহয় বর্তমান মাঠ “Camp Nou” তথা ”New Camp” এর। তখন এর ধারণ ক্ষমতা ছিলো নব্বই হাজার দর্শক। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে তাতে আরো ত্রিশ হাজার সিট যোগ করা হয় বৃটিশ আর্কিটেক্ট নরম্যান ফস্টারের দিকনির্দেশনায়।

বার্সেলোনার মাঠ ক্যাম্প নু

পুরাতন বার্সেলোনা নতুন রূপেঃ

১৯৬৮ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট Narcís de Carreras ক্লাবের নতুন নীতিবাক্য “Més que un club” (More than a club)” দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে এটাই হয় ক্লাব বার্সার মটো। Carreras ফ্রাঙ্কো-ভক্ত মানুষ ছিলেন না। তিনি ক্লাব বার্সাকে পুনরায় কাতালুনিয়ানদের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। ফ্রাঙ্কো-শাসনের বিপক্ষে থাকা কাতালুনিয়া এবং কাতালুনিয়ার মানুষের আদর্শ তুলে ধরেন তিনি এর মাধ্যমে।
ক্লাবের নামও বদলে ফেলে আবার ‘Futbol Club Barcelona’ রাখেন। পতাকায়ও পরিবর্তন এনে আগের চার স্ট্রিপ দেন। এসময় কাতালুনিয়ায় খুব দ্রুতই জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় বার্সেলোনার। এটি ছিলো স্বৈরশাসনের বিপক্ষে অভিনব এক প্রতীবাদ।

পরবর্তী প্রেসিডেন্ট Agustí Montal i Costa ও সাবেক প্রেসিডেন্ট Narcís de Carreras এর দেখান পথে পরিচালিত করেন ক্লাবকে। তিনি ফ্রাঙ্কোর স্পোর্টস অথরিটির দেয়া রেসট্রিকশনের বিপক্ষে ক্লাব এবং খেলাধুলার অধিকারের পক্ষে লড়াই করে গিয়েছেন।

এরপর ক্লাব বার্সেলোনা প্রবেশ করে সাফল্যের আরেক অধ্যায়ে। পর্তুগীজ ফুটবল যুবরাজ ইয়োহান ক্রুইফ কিংবা তারো আগের কুবালা এরা ক্লাব বার্সেলোনাকে করেছে সাফল্যমণ্ডিত। ১৯৯২ সালের ড্রিম টিম বার্সার সাফল্যকে নিয়ে গিয়েছে অনন্য এক উচ্চতায়। আর্জেন্টাইন লিজেন্ড ম্যরাদোনা, ব্রাজিলের বিস্ময় রোনালদো, রোনালদিনহো বার্সেলোনাকে করেছে সমৃদ্ধ। এরপর বার্সেলোনা প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বফুটবলের সবচেয়ে সফল একাডেমি ‘লা মাসিয়া’। এখান থেকে বের হয়েছে বিশ্ববরণ্যে অনেক ফুটবলার। লিওনেল মেসি, কার্লোস পুয়োল, জাভি হার্নান্দেজ, আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সার্জিও বুস্কেটস, সেস্ক ফ্যাব্রেগাস, জেরার্ড পিকে, ভিক্টর ভালদেস তেমনই কিছু সফল নাম। দরিদ্র ও অসুস্থ লিওনেল মেসিকে বার্সেলোনা চিকিৎসা করিয়ে, একাডেমিতে প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করেছে এক মহা বিস্ময় হয়ে উঠতে। হয়তো এরই কৃতজ্ঞতায় মেসি অনেক বড় অঙ্কের টাকার অফার পেয়েও রয়ে গেছেন বার্সাতে!

বার্সেলোনার ৩ কিংবদন্তি রোনালদিনহো, মেসি ও ইতো
বার্সেলোনার জার্সিতে ম্যারাদোনা

এল ক্লাসিকোঃ

বলা হয় ‘যখন বার্সেলোনা এবং রিয়াল মাদ্রিদ একে অপরের মুখোমুখি হয় তখন সমগ্র পৃথিবী মুহুর্তের জন্য থেমে যায় এবং তাদের খেলা উপভোগ করে।” সমগ্র পৃথিবী থেমে না গেলেও স্পেন এবং কাতালুনিয়া অঙ্গরাজ্যের মানুষ যে কাজ থামিয়ে তাদের ফুটবল-যুদ্ধ দেখে তাতে কোন দ্বিমত নেই। কেননা এর সাথে জড়িত আছে অনেক ইতিহাস, অনেক বেদনা, অনেক স্মৃতি। কারন ‘রয়্যাল ক্লাব’ খ্যাত রিয়াল মাদ্রিদ যে প্রতিনিধিত্ব করে মাদ্রিদ রাজপরিবারের। অপরদিকে ক্লাব বার্সেলোনা প্রতিনিধিত্ব করে কাতালুনিয়ান মানুষের পরিচয়, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। এইজন্য সবসময় এই খেলাটা পেয়ে থাকে ‘খেলার চেয়ে বেশি’ কিছুর মর্যাদা। হয়ত ফলাফলের মাধ্যমে দেখিয়ে দিতে চায় ‘তোমাদের চেয়ে আমরা এগিয়ে’।

লেখকঃ সাব্বির আকিব